নতুন অবয়বে আত্মপ্রকাশ করছে মধ্যপ্রাচ্য
26 June 2015, Friday
অতীতে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোই বিশ্বের স্ট্র্যাটেজিক ভরকেন্দ্রের বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস, ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ এবং নীতি নির্ধারণ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কৌশলগত এ অঞ্চলটি ব্রিটিশ ও ফরাসি কর্তৃত্বাধীনে আসে। বিগত চল্লিশের দশকে মার্কিনিরা ওই কর্তৃত্বের স্থানটি দখল করে নেয় এবং সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত প্রায় গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল মার্কিন দাপটেই থাকে। এ অঞ্চলের জ্বালানি সম্পদ কিংবদন্তিতুল্য। সেখানে অবস্থিত পূর্ব-পশ্চিমের একমাত্র সংযোগস্থল সুয়েজ খাল এবং সারা বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর পথ স্পর্শকাতর হরমুজ প্রণালী। যুদ্ধোত্তর কালের ব্রিটেন, যার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, মধ্যপ্রাচ্যে তার কর্তৃত্ব প্রায় শতাব্দীকাল অটুট থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি যুদ্ধবাজ প্রশাসনের বেহিসেবি অ্যাডভেঞ্চারের পর মার্কিনিরা বিশ্বের একক পরাশক্তি হয়েও এত শিগগির পৃথিবীর ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে, তা কেউ ভাবেনি।
ফলে এখন যে মধ্যপ্রাচ্য পরিদৃষ্ট হতে চলেছে, তার নেপথ্যে আগের মতো কোনো কর্তৃত্ববাদী বৃহৎ শক্তির ভূমিকা থাকবে না। এমনকি এ অঞ্চলে এখন কোনো আঞ্চলিক শক্তিধর মোড়লও নেই যার দাপটে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা পাবে। ফলে কৌশলগত ভারসাম্যের অভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এখন বিরাজ করছে এক ধরনের কৌশলগত শূন্যতা। যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গত কারণেই এবং প্রত্যাশিতভাবেই তার পূর্বপরিচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে অনিচ্ছুক ও অপরাগও। যদিও এই ‘একক’ পরাশক্তি এ অঞ্চল থেকে তার সামরিক শক্তি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে চায় না, তবু সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এখন তার নীতিবিরুদ্ধ কাজ, বিশেষ করে স্থলবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে। ইরাকে সামরিক আগ্রাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর কিছুতেই তার লক্ষ্য অর্জনে বা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সামরিক বিকল্পকে প্রাধান্য দেবে না- যদি না (মধ্যপ্রাচ্যের) আঞ্চলিক ভারসাম্যে মার্কিন স্বার্থবিরোধী কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসার উপক্রম হয়।
এ কারণেই বিধ্বংসী উগ্রবাদী ‘আইএস’ জঙ্গিদের অহরহ প্ররোচনার মুখেও যুক্তরাষ্ট্র সীমিত বিমান হামলার অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ তাদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যসব সংকট, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেসব সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের পথই খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যসহ সর্বত্রই সংকটকে উৎস মূলেই প্রতিরোধ বা পরিবেষ্টনের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে সচেষ্ট। দৃষ্টান্তস্বরূপ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে উদ্ভূত উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের মিত্র যুদ্ধবাজ ইসরাইলকে অসন্তুষ্ট রেখেই একটি কূটনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে এগোচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অপসৃয়মান উপস্থিতির কারণে এবং সেখানকার একাধিক ইস্যুতে এই পরাশক্তির খবরদারি হ্রাস পাওয়ায় ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের এবং বিরাষ্ট্রীয় সত্তাগুলো যেমন আইএসের তৎপরতা ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের একসময়ের সর্বত্র বিরাজিত শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের গুটিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ার বিপরীতে ওই অঞ্চলে স্বভাবতই আধিপত্য প্রত্যাশী ইরান ও সৌদি আরব। আঞ্চলিক কর্তৃত্ব লাভের লড়াইয়ে উভয় দেশই এখন লেবানন, ইরাক, সিরিয়া এবং সর্বশেষ ইয়েমেনে প্রচণ্ড প্রক্সিযুদ্ধে নিয়োজিত। ইয়েমেনের আল হুতি বিদ্রোহ বাস্তবিকই বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের একটি দৃশ্যমান উদাহরণ। এখানেই আমরা স্পষ্ট দেখছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকাবিহীন আঞ্চলিক আধিপত্য প্রত্যাশীদের সংঘাত। এই বিদ্রোহ চলছেও আঞ্চলিক আধিপত্যের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের সীমান্তে। এ সংঘাতে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বিদ্রোহী হুতিদের সমর্থক ইরানের সঙ্গে সৌদিদের আঞ্চলিক আধিপত্য লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সামনে তুলে এনেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যেমনটি অতীতেও ঘটেছে- ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভেদ ও কলহ মুখ্য ভূমিকা রাখছে। এর ফলে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যে’ ভূ-রাজনীতি এবং ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত উপাদানগুলো একটি বিসদৃশ রাজনৈতিক ও কৌশলগত মিশ্রণের উদ্ভব ঘটাবে, যার উপসর্গগুলো আমরা এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণহীন একটি পরিবর্তন ইতিবাচক কিছু ঘটাবে- তা ভাবার কারণ নেই। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ সংকটের সমাধান দেয় না, বরং তা আরও ঘনীভূত করে।
এখন এও প্রতীয়মান হতে চলেছে যে, যৌক্তিক পথ ধরে প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা অগ্রসর হতে না চাইলে সেটাও এ অঞ্চলের সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তিকে দুঃসাধ্য করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের বা অন্য কোনো বহিঃশক্তির সরাসরি ভূমিকা না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মোড়লরা নিজেদের মধ্যেও কোনো সমঝোতায় আসতে পারছে না। ফলে অনিবার্য হয়ে পড়ছে আইএসের অপ্রতিরোধ্যতা, ইসরাইলের প্রতিরোধহীন দস্যুতা, একটি আরব সংহতির স্বপ্ন বিচূর্ণ হওয়া এবং আরব বসন্তের আগমনে সমগ্র অঞ্চলে গণতন্ত্রের প্রত্যাশা ভেঙে পড়া।
এম আব্দুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন