ক্যামেরনের 'লিটল ইংল্যান্ড'
24 June 2015, Wednesday
২০১৩ সালে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল যখন জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন, বহির্বিশ্ব সেটাকে তাঁর সাফল্য রূপেই দেখেছিল। ভেবেছিল যে দেশটিতে সব ঠিকঠাকই যাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে ডেভিড ক্যামেরনের বিশাল বিজয়ের ভাগ্যে জুটছে শুধু সংশয়বাদ, যার আভাস বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে। অন্য কথায় মিসেস মার্কেল অনুকূল 'প্রেস' পেয়েছিলেন, ক্যামেরন যা তাঁর সম্প্রতিক নির্বাচনে পাননি। 'ওয়াশিংটন পোস্ট' তো এক শিরোনামে ঘোষণাই দিয়েছে যে ব্রিটেনের নির্বাচনী ফলাফলের পরিণতি দেশটিকে একটি ক্ষুদ্র ইংল্যান্ডে পরিণত হওয়ার পথে ঠেলে দেবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন কলামিস্ট একধাপ এগিয়ে এই ফলাফলকে 'ব্রিটেনের আত্মহনন' বলেছেন।
বেশ কিছু ইউরোপীয় ইত্যবসরে ক্রুদ্ধ ও অবিশ্বাসী যে ক্যামেরনের নতুন সরকার এবার সত্যি সত্যিই ইইউতে থাকা না থাকার ইস্যুতে গণভোট করতে যাচ্ছে, যার ঘোষণা তিনি আগেই দিয়ে রেখেছেন। এদিকে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) অপ্রতিরোধ্যতা যা অবশ্যই ইংল্যান্ডের ঐক্যের প্রতি হুমকি, সেটাও বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে দৃশ্যমান এসব প্রবণতার অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়েও। যুক্তরাজ্য যদি আয়তনে ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে এবং ইইউয়ের সমষ্টিগত শক্তি অর্জিত হয়, তার পরও এককালের এই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ শক্তিটি কি আর বৃহৎ শক্তিপুঞ্জের কাতারে থাকতে পারবে?
ব্রিটেনের বামপন্থীরাও কিছু মাত্রায় এই মোহভঙ্গের অংশীদার। তারাও মনে করে যে তাদের নির্বাচনী পরাজয়ে ব্রিটিশ জাতির একটি গভীর অস্বস্তির সংকেত প্রচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যে ব্রিটিশ নির্বাচনে দেশটির একটি অস্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরেছে তা-ও সর্বৈব সত্যি নয়। এমন ব্যাখ্যা সহজেই দেওয়া গেলেও তা মিথ্যাও হতে পারে। অবশ্য ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ এবং স্কটল্যান্ডের ব্রিটেন ত্যাগ কোনোটাই অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এও তো আরো অধিক সম্ভবপর যে পাঁচ বছরের মাথায় যখন ক্যামেরনের বর্তমান সরকারের মেয়াদ ফুরোবে, যুক্তরাজ্য তখনো ঐক্যবদ্ধই থাকবে এবং ইইউতেও তার সদস্য পদ বহাল থাকবে।
শুধু তা-ই নয়, ইইউয়ের সদস্য পদকে যে ব্রিটেন তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় ভাবে, সংগঠনটিতে থেকেও ব্রিটেন সেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করার সক্ষমতা রাখে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অগ্রসর চিন্তাধারার আঁতুড়ঘর হিসেবে যুক্তরাজ্যের ঈর্ষণীয় অবস্থান অপরিবর্তিতই থাকবে। ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে ক্যামেরনের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মূলত তাঁর দলকে খুশি রাখতেই ক্যামেরন করেছিলেন এবং তা ছিল কনজারভেটিভদের একটি জুয়ার (Gamble) চাল।
ব্রিটেনের ইইউতে অব্যাহত সদস্য পদ নিয়ে বাদানুবাদের প্রভাব ব্রিটেন বা ইইউয়ের জন্য নেহাতই তুচ্ছ। তাই এমন সম্ভাবনাই প্রবল যে ব্রিটিশরা ইউরোপের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় দেবে। তা ছাড়া দরকষাকষির প্যাঁচালো প্রক্রিয়া এবং একটি গণভোটের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতেও ব্রিটিশরা স্ট্যাটাসকো বহাল রাখাই উত্তম মনে করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে জনমত জরিপের ফলাফলও একই রকম সংকেত বহন করে।
কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, একটি সাধারণ নির্বাচনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া নতুন কিছু নয়। এতে ভোটারদের মনের পুঞ্জীভূত দাবি-দাওয়ার একটি স্বাভাবিক সুযোগ থাকে। কিন্তু একেবারে স্বাধীনতার দাবিতে ভোটদান অন্য ব্যাপার। তাতে অনেক হিসাব-নিকাশ ও ভালোমন্দের চিন্তাভাবনা জড়িত থাকে। প্রশ্ন থাকে রাজস্ব আদায়ের অনুপাত নির্ণয়ের। একটি স্বাধীন স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় গত কয়েক বছর থেকেই ভাটা পড়ে, যখন থেকে জ্বালানির মূল্য হ্রাসের সূত্রপাত হয়। উল্লেখ্য, উত্তর সাগরের জ্বালানি এক সময়ে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের আশার পালে হাওয়া জুগিয়েছিল। স্কটদের যদি স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাদের স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়ানোর বিষয়গুলো আবার বিবেচনায় উঠে আসবে। তবে একাধিক কারণে স্কটদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইস্যু এখনো অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যৌক্তিক বৈদেশিক নীতির উদ্বেগ হলো এই যে দেশটি যদি বিভক্তির পথে অগ্রসর নাও হয়, তার সামনে থাকবে একটি জটিল অন্তর্দর্শনের দীর্ঘ সময়। ব্রিটিশদের নতুন করে ভাবতে হবে তাদের জাতীয় পরিচিতির বিষয়টি নিয়ে। ইদানীং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের নতুন সমীকরণ এবং স্কটদের স্বাধীনতা লিপ্সা দেশটিকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। একটি দীর্ঘ অন্তর্দর্শনের মাধ্যমেই তার সমাপ্তি ঘটতে পারে।
ওয়াশিংটনের সম্প্রতি একটি ধারণা যে ক্যামেরনের ব্রিটেন বৈশ্বিক রাজনৈতিক মঞ্চের একটি নগণ্য কুশীলব হলেও তাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করা কঠিন। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ হাউস অব কমনসে সিরিয়ায় সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্রমবর্ধমানভাবে ব্রিটেনের দুর্বলতাকেই উন্মোচন করেছে। শুধু ওয়াশিংটন নয়, সারা বিশ্বই বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থার নিয়ামক এবং যুক্তরাজ্য বড়জোর তার বিশ্বস্ত সহকারী।
ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ ব্রিটেনের বহির্বিশ্বে যুদ্ধে জড়ানোর লিপ্সাকে আসলেই অবদমিত করেছে। বিষয়টি ব্রিটেনের ক্রমসংকুচিত প্রতিরক্ষা বাজেট থেকেও আঁচ করা যায়। আইএস জঙ্গি দমনে পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের কিছু লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা অবশ্যই দেশটির আন্তর্জাতিক ভূমিকার কোনো উল্লেখযোগ্য লক্ষণ নয়। এবং ক্যামেরনের ব্রিটেন যে ক্রমেই একটি নির্লিপ্ত আঁটসাঁট ক্ষুদ্রায়তনের ইংল্যান্ডে পরিণত হতে যাচ্ছে, সেটাই অধিক স্পষ্ট। অথচ লন্ডন সম্ভবত আজকের পৃথিবীতে সর্বাধিক বিশ্বায়িত নগরী। এখানকার ৩৭ শতাংশ বসবাসকারীই জন্মেছে লন্ডনের বাইরে। লন্ডন বিশ্বে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও যোগাযোগ, সংস্কৃতি ও পর্যটনের কেন্দ্র। ব্রিটিশরা ব্যবসায়ী জাতি এবং বাণিজ্য এদের মজ্জাগত। এই নগরী বিশ্বের মূলধনের চুম্বক।
এ মুহূর্তে দেশটির রাজনীতি হয়তো তার জনগণকে অন্তর্মুখী করেছে; কিন্তু এই রাজনীতির চেয়েও শক্তিশালী সামাজিক প্রযুক্তিগত এবং জনসংখ্যাগত চালিকাশক্তি অবশ্যই ক্যামেরনের ব্রিটেনকে বিশ্বায়নের সামনের কাতারে তুলে আনবে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন