এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব
22 June 2015, Monday
চীন ২০১৪ সালের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যয় করেছে তার একটি পুরনো ধারণা বাস্তবায়নে- যার আওতায় ছিল জাপান। জাপান সাত দশক আগে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এশিয়াবাসীর মধ্যে ধুয়া তুলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সে সময় জাপান তার ওই প্রচেষ্টার সাফল্য পায়নি। একই পথে চলা চীনা প্রচেষ্টাও কি একইভাবে ব্যর্থ হবে? এর উত্তর সরাসরি না দিয়েও নির্দ্বিধায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অবশ্যই অস্থিতিশীল হয় শক্তির ভারসাম্যহীনতায় এবং তা ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটায়। যে কোনো দেশ বা বৃহৎ শক্তি এমন প্রচেষ্টা নিক না কেন, ক্ষতির আশংকাগ্রস্ত দেশগুলো একক বা যৌথভাবে তা প্রতিহত করতে গেলেই অস্থিতিশীলতা বাড়বে এবং সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার মিত্রদের এ অঞ্চলে স্বার্থ থাকায় চীন নিছক তার ধারণা ও অভিপ্রায়ের বশবর্তী হয়ে ৭০ বছর আগেকার সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মতোই ব্যর্থ হবে। তাছাড়া বিরাজমান বিশ্বব্যবস্থার মুরব্বিদের তা ঘটতে দেয়ার কথা নয়।
এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব অভিনব কিছু নয়। এরই প্রেক্ষাপটে চীনের ‘এশিয়া কার্ড’ অবলম্বনের কৌশলেও কোনো অভিনবত্ব নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হবেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ, গত নভেম্বরে চীন এশিয়া প্যাসিফিকের আঞ্চলিক ‘শক্তির ভারসাম্যে’ কম্পন আনে তার এককভাবে ঘোষিত ‘এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন’ সৃষ্টির মাধ্যমে। যার অন্তর্ভুক্ত পূর্ব চীন সাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা- যার বেশিরভাগ অংশই বিবদমান অবস্থায় রয়েছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে সেনকাবু দ্বীপপুঞ্জ, যার মালিকানা দাবি করে চীন, জাপান ও তাইওয়ান। চীনের এ পদক্ষেপ বিবদমান এই অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, চীন সেনকাবু দ্বীপপুঞ্জে প্রয়োজনে শুধু একটি শক্তি বিস্তারের প্রত্যয় ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি, প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নির্দেশনায় চীনারা দ্বীপপুঞ্জটি বেষ্টনকারী সমুদ্রেও নজরদারির উদ্দেশে টহল জাহাজ পাঠাতে শুরু করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে তীব্র প্রতিবাদ আসা শুরু হয়। তারা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র এবং তাদের প্রতিরক্ষা বিধানেও চুক্তিবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র তাই বাধ্য হয়েই মিত্রদের অসন্তোষ প্রশমনকল্পে এরই মধ্যে চীন ঘোষিত air defense identification zone-এ বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠিয়েছে। এতে করে উত্তেজনায় আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
২০১৪ সালের গোড়ার দিকে এই উত্তেজনা অব্যাহত ছিল। চীন-জাপান সম্ভাব্য যুদ্ধের উদ্বেগও বাড়তে থাকে এজন্য যে, পরিকল্পিত না হলেও অসতর্কতাজনিত কারণেও যে কোনো সময় যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। বলা বাহুল্য, সে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশংকাও বিস্তর। কেননা গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দেশের স্বার্থ জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলে। তাদের সবারই মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও যে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত বছরের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার এক সফরে টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন সংশ্লিষ্টতা ও সাহায্যের আভাস দিয়েছিলেন। তবে সামরিক সংঘর্ষের আশংকা শুধু সেনকাবু দ্বীপপুঞ্জেই সীমাবদ্ধ নয়, তার চেয়েও জটিল এবং বেশি পুরনো চীনের জ্বালানিসমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনা মালিকানার দাবি। এ দাবির বিপক্ষে রয়েছে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। দেশ দুটি দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা দাবি করে আসছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, জ্বালানিসমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সাগরের স্পর্শকাতর এ এলাকায় একটি চীন-মার্কিন সংঘাত ক্রমেই অনিবার্য ও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় এ মুহূর্তে শীর্ষে আছে রাশিয়া, যে কিনা স্নায়ুযুদ্ধ আমলের সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যাটাস ফিরে পেতে সচেষ্ট। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও তার ভূ-রাজনৈতিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে দেশটি বদ্ধপরিকর। ফলে ইউরোপে সৃষ্টি হতে পারে বা হতে যাচ্ছে এমন একটি সংঘাতে চীন আবার যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রের আসনে অভিষিক্ত হতে পারে- যদিও চীন জ্বালানিসমৃদ্ধ রাশিয়ার কাছ থেকে দীর্ঘ দরকষাকষির পর একটি অনুকূল জ্বালানি সরবরাহ চুক্তি করতে পেরেছে। বলাবাহুল্য, রাশিয়া ও চীনের এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া চীনকে প্রচুর সুবিধা দেয়ায় চীন-রাশিয়া সম্পর্কও গভীর হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের প্রতিক্রিয়ায় দেশটিতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, চীন রাশিয়াকে বড়জোর গ্যাস ও জ্বালানি তেলের আড়ৎদার হিসেবেই দেখে, মিত্র হিসেবে নয়।
এছাড়া ২০১৪ সালে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে চীনা ও মার্কিন নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্পষ্টভাবে সমধর্মী প্রমাণিত হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ইস্যুতে অবাধ্যতা ও শৃংখলাভঙ্গ বরদাশত করতে চাননি। উত্তর কোরীয় শাসকগোষ্ঠীর অবিশ্বাসযোগ্যতারও কঠোর সমালোচক চীনা প্রেসিডেন্ট। চীনের এমন দায়িত্বশীল মনোভাবের কারণেই উত্তর কোরিয়া, যা কিনা চীনা অনুদানের মুখাপেক্ষী, তার কূটনৈতিক আলোচকদের জাপান, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কঠোর প্রস্তাব গ্রহণের পর উত্তর কোরিয়া সরকার তাদের চতুর্থ পারমাণবিক পরীক্ষার ঘোষণা দেয়।
যা হোক, এ সময় নাগাদ শক্তি বা শক্তির উপাদানগুলোর স্থানান্তর যতটা না রাশিয়ার সম্প্রসারণ নীতির পরিণতি- তার চেয়ে বেশি চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থানের ফল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার পড়ন্ত বৈশ্বিক নেতৃত্ব। মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়া সংকটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নেতৃত্ব দিতে অক্ষম হওয়ায় ২০১৪ সাল নাগাদ বিশ্বে মার্কিন প্রভাব ও প্রাধান্য বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেনকাবু দ্বীপপুঞ্জকে তাক করে চীনের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি সেই চ্যালেঞ্জেরই অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের অক্ষমতায় সৃষ্ট কৌশলগত শূন্যতায় কোনো নতুন শক্তি পা ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। বৈশ্বিক শক্তির শূন্যতা পূরণে দ্বিধা বা সিদ্ধান্তহীনতা অবশ্যই পরিত্যায্য। তবু ভালো যে, শূন্যতা পূরণে চীনের পদক্ষেপে অন্তত পেশিশক্তির প্রদর্শন নেই। চীনা প্রেসিডেন্ট শি তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে উদার হস্তে প্রদত্ত অর্থনৈতিক উদ্দীপনাকে বশ করে রেখেছেন, যাতে তারা জোটবদ্ধ হয়ে চীনের বিরুদ্ধাচরণ না করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভিয়েতনাম একপর্যায়ে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটালে চীন তার অর্থনৈতিক অস্ত্রের জাদুবলে ভিয়েতনামকে পক্ষে নিয়ে আসে। শি প্রমাণ করেছেন যে, একটি বৃহৎশক্তি শুধু যুদ্ধংদেহি অস্ত্র প্রয়োগে বৃহৎ হয় না। কূটনীতির সৌকর্য এবং সংকট সমাধানে উদার দৃষ্টিভঙ্গিও তাকে বিশ্বব্যবস্থার শীর্ষে বসাতে সাহায্য করে। চীনের উত্তরোত্তর সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিতে এই উত্থানরত দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের স্পর্শকাতরতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাকে পারস্পরিক কল্যাণকর সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধতে চায়। যদিও বিশ্বের আঞ্চলিক ইস্যুগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের হ্রাসপ্রাপ্ত ভূমিকা বা সংকটে জড়ানোর আশংকা থেকে চীনের গা বাঁচানোর প্রবণতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায় না।
এম আব্দুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন