সিআইএর নির্যাতন ও দায় মুক্তির সংস্কৃতি
21 April 2015, Tuesday
নয়-এগারো পরবর্তীকালে গুয়ানতোনামো, আবু গারাইবসহ অসংখ্য মার্কিন নিয়ন্ত্রিত আস্তানায় সন্দেহভাজন 'সন্ত্রাসীদের' যন্ত্রণাদায়ক আত্মসমর্পণসহ গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদকবলিত হওয়ার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করার দুঃসহ প্রক্রিয়া নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলে উৎকণ্ঠা ও চাপা গুঞ্জন ছিল অনেক দিন ধরে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও যেখান থেকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ও তৎপরতার সূচনা হয়েছিল সেখানেও সংশ্লিষ্টরা সন্ত্রাস দমনের নামে গোয়েন্দা তৎপরতার স্বরূপ জানতে উদগ্রীব ছিলেন। বলা বাহুল্য, আলোচ্য গোয়েন্দা তৎপরতার শীর্ষে ছিল সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের শীর্ষে বা নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যার অতীত কর্মকাণ্ডেরও খুব একটা সুখ্যাতি ছিল না। অবশেষে বিশ্বব্যাপী অপবাদ ও সোচ্চার অভিযোগ থেকে অবমুক্ত হতে মার্কিন সিনেট যখন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, বস্তুত সারা বিশ্ব রুদ্ধশ্বাসে সিআইএ নির্যাতনের অনেক অজানা তথ্য জানার আশায় প্রতীক্ষারত থাকে। নির্যাতনের কুশীলবদেরই বা মার্কিন প্রশাসন কী পুরস্কারে ভূষিত করে বা কোন তিরস্কারে ধিক্কৃত করে তা দেখার বাসনাও কম উদগ্র ছিল না বিশ্ববাসীর।
কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটেনি। সিনেটের আটপৌরে প্রতিবেদনটির অভিজ্ঞতা ছিল হতাশার, যদিও সন্ত্রাসের 'ভিলেনদের' বর্ণনাশৈলীতে ছিল অভিনবত্ব। প্রতিবেদন অনুযায়ী সন্ত্রাসের কয়েদিদের সঙ্গে গোয়েন্দা এজেন্টরা জন্তু-জানোয়ারের মতোই ব্যবহার করত। সিআইএ জেরাকারীরা এমন দৃশ্যে পুলকিতই হতো। অন্তত কিছু পর্যবেক্ষকের জবানবন্দি থেকে বোঝা যেত যে চোখ ও পশ্চাতে হাত বাঁধা অবস্থায় কয়েদিদের খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। পাহাড়টির গোড়ায় থাকত কুণ্ডলী পাকানো কাঁটাতার। প্রথম নিক্ষেপে নিক্ষেপিত ব্যক্তির হাঁটু সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হতো কাঁটাতারের কুণ্ডলীতে। অতঃপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় নিক্ষেপে মস্তক উপুড় করে নিচে ফেলে দিয়ে এই নির্যাতনের সমাপ্তি ঘটত। তবে এই নির্যাতন পদ্ধতিটি সিআইএ নয়-এগারোর পর উদ্ভাবন করেনি। সিআইএ মার্কিন, অস্ট্রেলীয় ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম মিলিটারির সঙ্গে একযোগে এই পদ্ধতির উদ্ভাবন করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। ১৯৬৫ ও ১৯৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ভিয়েতকং দমন ও নিপীড়নে এ পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার হয়।
এর ফলে সে সময়ে ৬০ হাজার মানুষ নির্যাতিত ও নিহত হয়। কিন্তু এই নির্যাতন ও হত্যার দায়ে কোনো রাজনীতিক, জেনারেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। হয়তো তাঁদের এ জন্য মাঝেমধ্যে জনরোষ বা বৈরী গণমাধ্যম মোকাবিলা করতে হয়েছে, তবে এক প্রকার দায়মুক্তির সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত তাদের নিষ্কৃতি দিয়েছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে মার্কিন কংগ্রেসের অপারেশনস সাব-কমিটিতে ভিয়েতকং নির্যাতন সম্পর্কে সিআইএপ্রধান উইলিয়াম কলবি তখন যে ভাষায় নির্যাতনের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতেও তা পরিচিত ও অপরিবর্তিত। কলবির ব্যাখ্যায় তৎকালীন মার্কিন মিত্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের মানুষকে ভিয়েতকং সন্ত্রাস থেকে বাঁচাতে ওই সব কিছু করা হয়েছিল। কিছু ভাষাগত পরিবর্তন থাকলেও এখন নির্যাতনকে ওই একই কারণ দেখিয়ে যৌক্তিক দেখানো হয়।
আজকের সিআইএপ্রধান জন ব্রেনান, যিনি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তাঁর সংগঠনের ব্যবহারকে 'অনেক ভালো কাজ' বলে দাবি করেন। তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্যাটার্ন একই প্রতীয়মান হয়।
ফরাসিরা প্রথম ভিয়েতনামে বৈদ্যুতিক নির্যাতন প্রয়োগ করলেও মার্কিনরাই দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের শিখিয়েছিল যে এমন নির্যাতনকে কি করে আরো কার্যকর ও যন্ত্রণাদায়ক করা যায়। মার্কিন সাংবাদিক মাইক ওটারম্যানের গ্রন্থ 'দি আমেরিকান টরচার'-এ এসব তথ্য পাওয়া যায়। মাইক ওটারম্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন নির্যাতন আর অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে পরিগণিত হয়নি, বরং আপেক্ষিকভাবে বর্ণনাযোগ্য অনবচ্ছেদ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, পরিণত হয়েছে কৈফিয়তহীন মার্কিন নিষ্ঠুরতার, যার ভূরি ভূরি নিদর্শন বিশ্ববাসী দেখেছে লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়ায় অথবা মধ্যপ্রাচ্যে। এটা নতুন খবর মনে হতে পারে, কিন্তু এসব নিদর্শনের নিন্দাবাদের হিড়িকে কদাচিৎ নির্যাতনের কুলুঙ্গি ঘেঁটে দেখার অবকাশ হয়েছে কারো কারো।
ওয়াশিংটন পরিচালিত প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও বারাক ওবামার মেয়াদকালীন নিষ্ঠুরতার পরিপূর্ণ ফিরিস্তি আজও আলোর মুখ দেখেনি; হয়তো ভবিষ্যতেও দেখবে না। মার্কিন নির্যাতনের ভয়ংকর লিগ্যাসি- বিশেষ করে আফগানিস্তানে হয়তো কখনোই পরিপূর্ণভাবে উন্মোচিত হবে না। কেননা সেই সব মার্কিন জিঘাংসাপ্রসূত ওই অঞ্চলের তালেবান, আল-কায়েদা নিধনের সামান্য সংবাদও ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রথম প্রহরে বহির্বিশ্বে প্রেরিত হতে পেরেছে।
সিনেটের সিআইএ নির্যাতন প্রতিবেদন সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যদিও অপরাধীদের দায়মুক্তির কারণে অর্থহীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণ প্রেসিডেন্ট সারা বিশ্বের প্রত্যাশাকে পদদলিত করে এ ব্যাপারে এমন এক অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যাতে তাঁর শ্বেত পূর্বসূরিদের নিষ্ঠুরতায় তাঁর মৌন সম্মতি স্পষ্ট হয়। তবে সিনেটের নির্যাতন প্রতিবেদনে অল্প হলেও কিছু রাজনীতিক আরো স্বচ্ছতা আনয়নের পক্ষপাতী, বিশেষ করে নির্যাতনকালীন প্রশাসনগুলোর ভূমিকা তারা ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে চান। এখনো বিশ্বজুড়ে কালো মেঘের আনাগোনার মধ্যে ক্ষীণ হলেও এটি একটি আশার আলো।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন