শেষ হাসি যারই হোক, ক্ষতিটা জনগণের
31 January 2015, Saturday
বিএনপির চলমান আন্দোলনের কর্মসূচি যৌক্তিক কিনা, তাতে কার কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে- এসব নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এ আন্দোলন সরকারের প্রচণ্ড বাধার মুখে হতে পারাটাই একটি বিরাট খবর, যেখানে আমরা মাত্র ক’মাস আগেও বিএনপির আন্দোলন করার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। তাই বিএনপির আন্দোলন দুর্বল কী সবল এবং তা আদৌ বিপাকে নিপতিত বিএনপির জন্য কোনো অর্জনের ইঙ্গিত বহন করে কিনা, সেসব প্রশ্ন এ মুহূর্তে অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক। মুমূর্ষু রোগী যে কিছু সময়ের জন্য তার চৈতন্য ফিরে পেয়েছে, সেটাই বড় কথা।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দোর্দণ্ড প্রতাপের আওয়ামী লীগের কথাই ভেবে দেখুন। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে দলটি প্রায় তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছিল। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রায় নির্বাসিত সেই দলটির এখনকার তর্জন-গর্জন শুনছেন তো! রাজনীতিতে উত্থান-পতন এমনই।
সে সময়ের আওয়ামী লীগের অবস্থা এখনকার বিএনপির চেয়েও খারাপ ছিল। এত খারাপ যে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে একুশ বছর সময় লেগেছিল। তারপরও জনতার মঞ্চ করে এবং একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে সংসদে কোনোমতে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেও ক্ষমতায় আসতে তাকে বিএনপি প্রদত্ত কারাভোগে পর্যুদস্ত এরশাদ সাহেবের সাহায্য নিতে হয়েছিল। জানি না হালের আওয়ামী কুশীলবরা সেসব কথা মনে রেখেছেন কিনা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ অষ্টম সংসদেও তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাইলে উন্নতশির সাহাবুদ্দীন তা হতে দেননি।
বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে আওয়ামী লীগ রণরূপ ধারণ করে আবার আন্দোলনের পথই বেছে নেয় এবং তাতে অভিনবত্ব আনতে লগি-বৈঠার সংযোগ ঘটায়। সেই আন্দোলনের তীব্রতার মুখে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ‘এক-এগারো’র আগমন ঘটে। এক-এগারোর প্রত্যক্ষ নায়ক মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের নেপথ্যে দেশী-বিদেশী আওয়ামী বন্ধুরা পুরো দু’বছর সক্রিয় থেকে যে ফর্মুলার উদ্ভাবন ঘটান, তা স্বভাবতই আওয়ামী লীগের পক্ষেই যায় এবং বিএনপি আপেক্ষিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অসাংবিধানিক মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের মেজাজ ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। তার সঙ্গত কারণও ছিল। প্রাক এক-এগারো বিএনপি সরকার দেশবাসীকে সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। সে সময় হাওয়া ভবন কেলেংকারিসহ জঙ্গিবাদের উত্থান এবং কুখ্যাত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
তা সত্ত্বেও বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার মতোই তিন আসনে জয়ী হয়ে প্রমাণ করেছিলেন, তখনও তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছে। সংসদে বিএনপি আসন কম পেয়ে পরাজিত হলেও উভয় দলের প্রাপ্ত পপুলার ভোট ছিল খুবই কাছাকাছি। তবে সংসদে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ আসন পেলেও ভূমি ধস ধরনের কিছু ঘটেনি। সে যাই হোক, নবম সংসদে আওয়ামী বিজয় ছিল ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের পর সর্ববৃহৎ বিজয়।
বিজয়ের এ ধারাকে স্থায়িত্ব দিতে আওয়ামী লীগ তার নবম সংসদকালীন সরকারে কিছু চমক সৃষ্টির প্রয়াস পায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও দেশের চেহারায় দৈন্যদশা আগের মতোই রয়ে যায়। এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে এ নিবন্ধকার একটি কলাম লিখেছিল : ‘গরুর গাড়ির হেডলাইট হয় না।’ আসলে সামগ্রিক দৃষ্টিতে এসব চটকদার অভিধা সত্ত্বেও এখনও একই মন্থর গতিতে চলছে দেশ। তবে উন্নতি যেটা হয়েছে তা হল, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করলেও এ দেশে কয়েক হাজার কোটিপতির একটি এলিট শ্রেণী তৈরি করেছে। বলা বাহুল্য, তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী পরিবারের লোক।
কিন্তু প্রতিশ্র“তি দিতে তো কোনো বাধা নেই। শুরু থেকে আওয়ামী লীগের সেটাই রীতি। নবম সংসদের নির্বাচনের প্রাক্কালেও আওয়ামী লীগ আকর্ষণীয় প্রতিশ্র“তিমালার ফুলঝুরি সাজিয়েছিল। কিন্তু দেশের অর্থনীতি, আইন-শৃংখলা, জননিরাপত্তা ইত্যাদির অবনতি এবং লুণ্ঠন, দখলদারিত্ব ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে অল্পদিনের মধ্যে দেশে আতংক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হতে থাকল।
সে যাই হোক, নবম সংসদের আওয়ামী ট্রেন যখন অনেক ঝাঁকুনির সঙ্গে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগোতে থাকল, তখন তার অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর থাকেনি। আওয়ামী কুশীলবদের কারসাজিতে শেয়ার মার্কেট কেলেংকারি হল, নিঃস্ব হয়ে অনেক বিনিয়োগকারী পথে বসল। আগের বারও যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, শেয়ারবাজারে এমনই কেলেংকারি হয়েছিল। জানি না, কেন জানি দলটি ক্ষমতায় এলেই কতগুলো একই ধরনের দুর্বিপাক ঘটতে থাকে। ভেঙে পড়ে আইন-শৃংখলা, বিস্তার লাভ করে দুর্নীতি, দলের অঙ্গসংগঠনগুলো নর্দমার নোংরা পানির মতো প্লাবিত করে লোকালয়। বিশেষ করে দলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগ তাদের আখের গোছানোর তৎপরতায় মেতে ওঠে। পিছিয়ে থাকে না কেউ। যুব, স্বেচ্ছাসেবক এবং আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সবাই নেমে আসে লুণ্ঠন, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের মচ্ছবে।
মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণের পর বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ অনেকে নিখোঁজ, গুম ও অপহরণের শিকার হন। এসব ঘটনা জাতিকে স্তম্ভিত করে তোলে। সাগর-রুনি হত্যা, হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেংকারি, পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির আভাসে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়া- এসব ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতাই প্রকাশ পায়। তবে এমন অপশাসনের চিত্র বিএনপি আমলে কম পীড়াদায়ক ছিল না। কিন্তু বিএনপির তো কোনো ‘রূপকল্প’ ছিল না। কেননা ক্ষমতার খেলায় বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি সুদূরপ্রসারী নয়।
আওয়ামী লীগের রূপকল্প বাস্তবায়িত হতে হলে তো শুধু ২০২১ সাল নয়, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে। কিন্তু নবম সংসদের সমগ্র সময়ে দলটির যে ইমেজ সংকট দেখা দিতে থাকে, তাতে দলটি স্বাভাবিক পথে ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে আস্থা রাখতে পারছিল না। স্থানীয় সরকার এবং চারটি প্রধান পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল এবং জনসমর্থনের প্রবণতা দেখে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার বিকল্প কৌশলের কথা না ভেবে উপায় থাকল না। এর আগেই শুরু হয় সংবিধান নিয়ে আওয়ামী কুশলীবদের ঘাঁটাঘাঁটি। সংসদ তো রয়েছেই তাদের কব্জায়। তৈরি হল ক্ষমতাসীনদের অপকৌশলের রূপরেখা। যে আওয়ামী লীগ একসময় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য প্রাণপাত করেছিল, তারাই এবার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। নির্বাচনকে নিজেদের হাতে রেখে তাতে ফাঁকফোকরের ব্যবস্থা না রাখতে পারলে তারা ক্ষমতায় আসতে পারত না।
বিএনপি কি মহাসংকটের এ অপকৌশলের জটাজাল ছিন্ন করে রাজনৈতিক পরিসরে তার আগের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে? কিছুদিন আগে পর্যন্ত এর জবাব নেতিবাচক ছিল। জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক বিএনপির শক্তি একবারে নিঃশেষিত হয়ে না গেলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার জন্য শেষ কামড়ের যে উপসর্গগুলো দৃশ্যমান হয়ে চলেছে, তাকে প্রতিহত করে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোকে অবিশ্বাস্যই মনে হবে। ক্ষমতার দণ্ড যখন হাতে থাকে, তখন যে কেউ বা যে কোনো মহল দুর্দমনীয় ও দানবীয় শক্তিতে পরিণত হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় কাপুরুষোচিত প্রবণতা। সেখানেই সমস্যা। কোনো শক্তি যখন যুক্তিতর্ক এবং শুভ-অশুভের বিবেচনার ঊর্ধ্বে চলে যায়, তখন তো যে কোনো পক্ষের শেষ দম পর্যন্ত না লড়ে উপায় থাকে না।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই এখন মল্লযুদ্ধের পাটাতনে। এক পক্ষ তার লৌহ দস্তানা ছুড়ে দিয়েছে এবং অপর পক্ষ তো কুড়িয়ে নিয়েছে। সারা দেশ রুদ্ধশ্বাসে সেই যুদ্ধের দৃশ্য দেখছে। এখানে ইতিবাচক কিছু করার অবস্থায় আওয়ামী লীগই আছে। বিএনপি সেই সুবিধাবঞ্চিত। হারলেও বিএনপিকে লড়েই হারতে হবে। সেটাই আমাদের ট্রাজেডি। এ অসম যুদ্ধে আওয়ামী লীগ জিতলেও তারা সেই বিজয়ের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারবে না। দেশ, জাতি ও জনগণ দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার অভিশাপ কুড়াবে। কেননা অনৈতিকতার ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো সরকার স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ক্ষমতায় তারা যতদিন থাকবে, লড়েই থাকতে হবে। কোনো এক পর্যায়ে অনৈতিকতার গুরুভার জাতির বিবেকবোধের জন্য অসহনীয় হলে সরকারের ক্ষমতার মসনদ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে পড়বে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেশ ও জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার ক্ষমতাদুর্গ স্বাধীনতা সংগ্রামের তোড়ে ভেঙে পড়লেও এ দেশের সাত কোটি মানুষকে তার মাশুল কম দিতে হয়নি।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
( যুগাঁতর )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন