পেশোয়ারের ঘটনা পৈশাচিক কিন্তু কেন?
24 December 2014, Wednesday
কে জানত যে প্রায় দেড় শ শিশু-কিশোর নিধনযজ্ঞটি পাকিস্তানিদের জন্য আরেকটি 'কৃষ্ণ দিবস' ১৬ ডিসেম্বরেই ঘটবে! সব কিছু যখন শেষ, অর্থাৎ তালেবান নিজেদের আত্মস্মৃতি বরণ করার আগে তাদের ভয়াবহ মিশনও সমাপ্ত করেছে, দিনের প্রথম প্রহরে পেশোয়ারে আর্মি পরিচালিত স্কুলের আশপাশে কৌতূহলী ভিড়ের মধ্য থেকে মানুষকে বুক চাপড়িয়ে তাদের জন্য আরেকটি কালো দিবসের প্রাদুর্ভাবে হাহুতাশ করতে দেখা গেছে। ঘটনার অব্যবহিত পরেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানে সন্ত্রাস নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। চির বৈরী প্রতিবেশী ভারতও এমন ঘোষণার প্রতিধ্বনি করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের পাশে থাকার কথা বলেছেন। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের সেন্টিমেন্ট প্রদর্শন করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবসহ আরো বিশ্বনেতারা গতানুগতিকতার অনুসরণে নৃশংস এই ঘটনার জন্য বার্তা প্রেরণ করেছেন বা বিবৃতি দিয়েছেন।
শোকাবহ ঘটনাটির জন্য এসব ড্রিল অত্যন্ত নিখুঁত হলেও তা কিন্তু এবারই প্রথম নয়। আল্লাহ পাকই জানেন এ পর্যন্ত অনুরূপ সন্ত্রাসে ওই দেশটির কত মানুষ নিহত হয়েছে। যাঁরা এখন প্রথাগত শোক প্রকাশ করছেন তাঁদেরই বা বিশ্বে এবং পাকিস্তানে সন্ত্রাস দমন ও পরিচালনায় কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ত্রাস যেখানে ছিল আজও সেখানেই আছে।
আজকের বিশ্বে সন্ত্রাসের প্রতীকী নামে পরিণত হয়েছে হিন্দুকুশ পর্বতের কৌশলগত অঞ্চল, যার অন্তর্গত আফগানিস্তান-পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ দূরত্ব এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাস-বিরোধিতার কলকাঠি নাড়ছে, যাতে সন্ত্রাস উত্তরোত্তর ঘনীভূতই হয়ে চলেছে। এ অঞ্চলকে তাদের প্রভাববলয়ে রাখতে পাকিস্তানই একসময় তালেবান শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তারও আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য ও সমর্থনে দখলদার সোভিয়েত বাহিনী বিতাড়নে আফগান মুজাহিদীনদের উসকে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মিশন সফল হওয়ার পর মুজাহিদীনরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়লে মূলত সৌদি অর্থ এবং পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসাগামী ছাত্রের হাতে জিহাদের সবক দিয়ে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় আল-কায়েদার মন্ত্র। তালেবান কাবুলে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে ওসামা বিন লাদেন তালেবান সরকারের আতিথ্য নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে আফগানিস্তানে আসেন। তাঁর আগে পূর্ব আফ্রিকায় আল-কায়েদার কয়েকটি মিশন সফল হলেও তিনি ছিলেন নেহাতই পলাতক রাষ্ট্রবিহীন একজন সন্ত্রাস সমর্থক ধনকুবের, যিনি তাঁর বিপুল অর্থ মুসলিম বিশ্বে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলেন।
পেশোয়ারের ঘটনা পৈশাচিক কিন্তু কেন?
এদিকে তালেবান তাদের খলিফা খুঁজে পায় সোভিয়েত-বিতাড়নের যুদ্ধে একচক্ষু হারানো দৃঢ়চেতা একজন মোল্লা ওমরের মধ্যে, যাঁর জীবিত বা মৃত শিরের জন্য বিপুল অঙ্কের পুরস্কার এখনো ঝুলছে। দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তানেই খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম শুরু এবং এটিই ছিল পশ্চিমা মৈত্রীর প্রথম সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ৯/১১-র অব্যবহিত পর বিশ্বের জন্য ত্রাস সঞ্চার করে শুরু করেছিলেন। অবৈধ শাসক পরিচালিত কিছু আরব মুসলিম দেশসহ বিশ্বব্যবস্থায় যে অসংগতির কারণে লাদেন আল-কায়েদার পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেই অসংগতিগুলোই এ যুদ্ধের পরিণতিতে আরো প্রকট হয়। মার্কিনরা ক্ষমতা দখলকারী পাকিস্তানের জেনারেল মোশাররফকে বৈধতাদানের বিনিময়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ঢালাও সমর্থন ও সুযোগ-সুবিধা পায়। অনেক জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগান জনগোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে তার ফায়দা গ্রহণ করে, যেমনটি ওই জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত দেশের হামিদ কারজাইয়ের মতো সুযোগসন্ধানীরাও যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহন করে ব্যক্তিগত ফায়দা লোটে। ফলে আফগানিস্তানে একটি ত্বরিত বিজয় অর্জিত হলেও সেখানকার তালেবান শক্তি কখনোই অবদমিত হয়নি এবং মার্কিনরা সেখানে তালেবান লালিত আদর্শের বিকল্প হিসেবে কোনো মূল্যবোধ দাঁড় করাতে পারেনি। গত এক দশকে মধ্যম সারির কিছু তালেবান নেতাকে তাদের অনুসৃত পথ পরিহার করাতে পারলেও মোল্লা ওমর তখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও ওসামা বিন লাদেনের সন্ধান তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফাঁস না করলে তিনিও ওবামার কমান্ডো নেভি সিলের আকস্মিক আক্রমণে অ্যাবোটাবাদে তাঁর আস্তানায় নিহত হতেন না, যা মার্কিনরা দাবি করে। এত কিছুর পরও আমেরিকান বা তাদের পাকিস্তানি দোসররা কখনো আত্মজিজ্ঞাসা করেনি যে কেন কোনো মানুষ অবলীলায় আত্মঘাতী হয়। এর পরিণতিতে এই জিহাদি আত্মঘাতিত্বের পরিসর আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের নতুন নতুন সংস্করণ, বিস্তৃতি ও জিহাদের আঙ্গিক আমরা দেখি। কিন্তু এই জিহাদের প্রক্রিয়া অগ্রহণযোগ্য হলেও মুসলিম আরব ও মুসলিম বিশ্বকে ঘিরে একই প্রকার প্রবঞ্চনা, শক্তিপুঞ্জের ভণ্ডামি এবং পাকিস্তানের মতো দেশেও তার প্রতি সমর্থন এক ধরনের নৈরাজ্যের জন্ম দেয়, যা থেকে স্কুলে শিশু-কিশোর বধের মতো বেপরোয়া মনোভাবের উৎপত্তি হয়।
কেউ যদি শুধু ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য নিয়ে পশ্চিমা শক্তিপুঞ্জের খেলা ও নাটক দেখে, তারা বিরাজমান অসংগতিতে কী মনোভাব পোষণ করবে? যাদের মননে বিন্দুমাত্র অনুভূতি আছে, তারা তো এমন অন্যায় ও অসংগতি দর্শনে বিক্ষুব্ধ হবেই। সেই প্রতিক্রিয়া যদি কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়, তা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু অপ্রতিরোধ্য নয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে পাকিস্তানে জিহাদের জনক ভাবা হয়। তিনিই প্রথম পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রবর্তন করেন এবং তার দেশ শাসনের মেয়াদেই আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব ঠেকাতে রিগ্যান প্রশাসন হিন্দুকুশ অঞ্চলকে মার্কিন অস্ত্রে সয়লাব করেন। উল্লেখ্য, সেই রাজনীতিতে সেই জিয়াউল হকের ভাবশিষ্য নওয়াজ শরিফ যখন সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেন, তা অনেকেই ফাঁকা বুলি হিসেবেই বিবেচনা করেন। এত বড় একটি পৈশাচিক ঘটনায় বলতে হয় তাই বলা। অনেকে আশ্চর্য হয়ে এও ভাবেন যে এক দশক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পর যখন নওয়াজ শরিফ আফগান তালেবানের অনুপ্রবেশ বন্ধে পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে মার্কিনদের ড্রোন হামলা বন্ধে নিশ্চুপ, তারই দেশ পাকিস্তানে গজিয়ে উঠেছে তালেবানের পাকিস্তানি সংস্করণ।
ইত্যবসরে সন্ত্রাসে সংশ্লিষ্টদের কোনো অসুবিধা নেই তা তারা উন্নত শক্তিধর দেশেরই হোক বা পশ্চাৎপদ কিংবা শক্তিধরদের আজ্ঞাবহই হোন। সংঘাত ও সংঘর্ষ যত দিন পৃথিবীতে জিইয়ে রাখা যাবে এবং সংঘাতে ব্যবহৃত অস্ত্র সরঞ্জামের চাহিদা অব্যাহত থাকবে এর মাসুল আগের মতোই দিতে থাকবে তাদেরই, যারা এই অবস্থার পরিবর্তন চাইবে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস
( কালের কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন