প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যই রুখে দিতে পারে জঙ্গিদের উত্থান
27 November 2014, Thursday
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো একটি মর্মন্তুদ অধ্যায়ের জন্ম হলো। প্রগতিবাদী, শিক্ষক, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে নৃশংস কায়দায় খুনের মধ্য দিয়ে যে অপদৃষ্টান্ত পুনর্বার স্থাপিত হলো তা রাষ্ট্র-সমাজ-সমাজে বসবাসকারী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কারোর জন্যই কোনো সুবার্তা নয়, বরং চরম অশুভ বার্তা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অন্যতম কারণ। তাকে হত্যার দায় স্বীকার করে ওই মর্মন্তুদ ঘটনার পর পরই একটি উগ্রবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে যে বার্তা প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে তাও চরম অশুভ ইঙ্গিতবহই। ধর্মান্ধ অপশক্তি এই রাষ্ট্র ও সমাজে ইতোমধ্যে যেসব ক্ষত সৃষ্টি করেছে, সেসব সহজে উপশম হওয়ার নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশ ও র্যাব তথ্য দিয়েছে দুই রকম। পুলিশ উগ্র মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততার কথাই বলেছে, কিন্তু র্যাব বলেছে নারীর সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যেভাবেই কিংবা যে কারণেই ঘটুক তিনি খুন হয়েছেন এটিই সত্য। পুরো তদন্ত শেষে হয়তো সঠিক চিত্র আমরা পাব। তবে এটি তো সত্য যে, এ দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তির মদতে-পৃষ্ঠপোষকতায়-আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ধর্মান্ধ উগ্রবাদীরা নানা নামে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে একের পর এক সংঘটিত করে চলেছে পৈশাচিকতা-বর্বরতা-নৃশংসতার বহুবিধ দৃষ্টান্ত, যা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক। এই সত্যতা এড়ানো যাবে না। জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে সম্প্রতি এমন আশঙ্কা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এ আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা এরই মধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। তারা আবার নানাভাবে সংগঠিত হচ্ছে এটিই হলো বিদ্যমান বাস্তবতা। জঙ্গিবিরোধী অভিযান ক্রমেই জোরদার করাটা বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুজন শিক্ষককে ইতিপূর্বে অপশক্তির ছোবলে প্রাণ হারাতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অপশক্তির শিকড়-বাকড় ছড়ানোর অপক্রিয়া আজো রাষ্ট্রশক্তি বন্ধ করতে পারেনি কেন? এ ব্যাপারে রাজনৈতিক যে ঐকমত্য প্রয়োজন তাও গড়ে উঠেছে না এবং এর পশ্চাৎকারণ সচেতন মানুষ মাত্রই জানা। আজ প্রায় বিশ্বব্যাপী ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অপকাণ্ড সমাজদেহে নতুন করে যে কাঁপন ধরিয়েছে এবং ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে এর জন্য প্রত্যেকটি দেশের সরকারের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের কাজটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এখন এ ধরনের অপক্রিয়া শুধু একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়েই থাকছে না; বরং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ত্রাসবাদ-উগ্রবাদ-ধর্মান্ধতা নতুন নতুন সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি করে চলেছে, যা কেবল সভ্যতা-মানবতা-নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি; উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হয়েও দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সংঘটিত উগ্রবাদীদের ঘটানো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং উভয় দেশ সন্ত্রাস নির্মূলে যা যা ভেবেছে করণীয় সম্পর্কে, সে সবই বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজনীয়। এখন দরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও এ রকম কৌশল নির্ধারণে যথাযথ কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে পদক্ষেপ নেয়া।
আমাদের স্মরণে আছে এ দেশে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে জঙ্গি-ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীরা সারাদেশে তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল। দেশের সব জেলাতে একযোগে বোমা হামলা করে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের ক্ষমতার কথা।
তারা বিগত তিন দশকে এ ভূখণ্ডে রক্তাক্ত ঘটনা কম ঘটায়নি এবং উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অতীতে এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের লক্ষ্যে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা হয়েছে খোদ রাষ্ট্রশক্তির তরফে কখনো কখনো। এমন অভিযোগের ভিত্তিমূল দুর্বল নয়। এখন আবার এই জঙ্গি-ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীরা নানা নামে, নানা ব্যানারে সংঘবদ্ধ হয়ে নানা রকম বিধ্বংসী কার্যক্রম পরিচালিত করার জন্য নতুন করে ছক কেটে চলেছে। সম্প্রতি যেসব জঙ্গি-উগ্রবাদী-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের হাতে বন্দি হয়েছে, তাদের জবানিতেই মিলেছে অনেক উদ্বেগজনক তথ্যচিত্র। তারা যে কত রকম নীলনকশা প্রণয়ন করে চলেছে এবং তাদের শিকড়-বাকড় নতুন করে কীভাবে ছড়াচ্ছে এরও স্পষ্টই আলামত মিলছে। জঙ্গিদের উত্থানরোধে সর্বাগ্রে দরকার প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য। বিষয়টি যেহেতু রাজনৈতিক, তাই দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত। একটা কথা সত্য, এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। এই সহজ-সরল মানুষরা অতীতেও ধর্মের নামে খুনোখুনি, রক্তারক্তি মেনে নেয়নি, এসবে সমর্থন জানায়নি এবং ভবিষ্যতেও তারা এ পথে অবিচলই থাকবে এটি অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্ট করেই বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশে এই অবস্থা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ও সরকারের জন্যও সহায়ক। সরকার এ ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারে এবং উগ্রবাদী-জঙ্গি-ধর্মান্ধদের মূলোৎপাটনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে সাধারণ মানুষের এই অমিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, তাদের সহযোগিতা নিয়ে। সরকারকে এ জন্য কালক্ষেপণ না করে যথাযথ সব পদক্ষেপ নিতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত প্রত্যেকটি বাহিনীর সদস্যদের এ জন্য অধিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হবে।
জঙ্গিরা এখনো নিঃশেষ হয়নি। বিগত সেনা সমর্থিত সরকার ও তারপর মহাজোট সরকারের কঠোর অবস্থান এবং কার্যকর পদক্ষেপের কারণে তারা ঘাপটি মেরে বসেছিল। এখন আবার কোন শক্তি বলে তারা সংঘবদ্ধ হচ্ছে, এর উৎস সন্ধানের পাশাপাশি অর্থের জোগানদাতাদেরও সন্ধান করে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। আবারো বলি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী যে কোনো অভিযান এবং অবস্থানের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন অব্যাহত থাকবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে, এ কথা স্পষ্ট করেই বলা যায়। আমরা চাই শান্তি ও নিরাপত্তা, আমরা চাই সব ধরনের জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদের শিকড় উৎপাটন। এ দেশ কখনোই জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমি হতে পারে না। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সব রকম প্রতিক্রিয়াশীলতা, পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির কবর রচনা হলেও রক্তস্নাত বাংলাদেশে আজ দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা আবার এসবেই আক্রান্ত। এর অবসান ঘটাতেই হবে। চাই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, চেতনাকে আরো শাণিত করে প্রগতিবাদী সব শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ মসৃণ করা এবং এই শক্তির ওপর ভর দিয়েই ভবিষ্যৎ নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে সব রকম কর্মপরিকল্পনা নেয়া, কার্যক্রম পরিচালিত করা।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
( মানব কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন