ওবামা প্রশাসনের দোদুল্যমানতা এবং দুঃসাহসী আইএস
16 November 2014, Sunday
মিশন অসমাপ্ত রেখে নব্য রক্ষণশীলদের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে একটি যেনতেন ব্যবস্থার মধ্যে ইরাককে রেখে পশ্চাদপসারণ, সিদ্ধান্তহীনতা, ইসলামি জঙ্গিদের শক্তির অবমূল্যায়ন এসব কিছুই মৃত্যু ও ধ্বংসের স্তূপে সমগ্র অঞ্চলকে ঢেকে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিরাজমান উপসর্গগুলো স্পষ্টত আমেরিকান সংকল্পে দোদুল্যমানতার চিত্র বহন করে। বারাক ওবামাও প্রকারান্তরে সে কথা স্বীকার করেছেন, আমি তো জেনেশুনে গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়তে চাই না। এই মুহূর্তে ইসলামি স্টেট জঙ্গিদের লড়ার কোনো স্ট্র্যাটেজিই আমাদের নেই। বিশেষ করে সিরিয়ার ঘোলাটে পরিস্থিতিতে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা নাজুক। ওবামার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বৎসরাধিক পূর্বেই বাশার আল আসাদ মার্কিন প্রদত্ত রেডলাইন অতিক্রম করায় আইএস-এর যোদ্ধারা নিশ্চিতভাবে এখন দুর্জয়। ওবামার অকার্যকারিতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ইসলামি জঙ্গিরা প্রতি মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। যদিও ওবামা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের ডাক দিয়েছেন তা শুধু বিলম্বিতই নয়, কার্যত প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন বলে বিবেচিত।
আল আসাদ ২০১৩ সালের একুশে আগস্টে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কেমিক্যাল অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। সেটাও আবার তিনি করেছিলেন রাজধানী দামেস্কের সন্নিকটে এই নিষ্ঠুর পদক্ষেপে চারশ’ শিশুসহ ১৪০০ বেসামরিক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। বিস্ময়কর যে, যুক্তরাষ্ট্র বা কোনো বৃহৎ শক্তির পক্ষ থেকে এর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।
যেন অতি সহজেই তারা এটা মেনে নিয়েছিল। যেন সেই নিষ্ঠুরতার পেছনে বৃহত্তর কর্তৃত্বের সায় ছিল। অনেক বিশ্লেষকের প্রশ্ন, ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্ত ভেঙে পড়ায় আইএস-এর আদৌ উৎপত্তি ঘটেছিল? জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিরিয়ায় বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ ও আইএস-এর তৎপরতায় এক লাখ একানব্বই হাজার সিরিয়া নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা সম্ভবত দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার অতিক্রম করেছে। এছাড়া শত-সহস্র সিরীয়ও এই গৃহযুদ্ধে নিখোঁজ। তাছাড়া সিরিয়ার অভ্যন্তরেই লাখ লাখ উদ্বাস্তু। যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে, গৃহহীনদের আকর্ষণ তুরস্ক তার সীমান্ত বন্ধ করায় অধিকাংশ উদ্বাস্তু দেশের অভ্যন্তরেই আশ্রয় নিয়েছে। ভাগ্যের পরিহাস যে, আল আসাদ এসব হত্যা, বিতাড়ন এবং গ্যাস প্রয়োগ সংঘটনে সক্ষম হয়েছিল অথচ রেডলাইন অতিক্রমের পরেও মার্কিন প্রশাসনের তাক করা ক্রুজ মিসাইল আঘাত আল আসাদ এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে জানা গিয়েছিল যে, রুশ মধ্যস্থতায় আসাদ তার কেমিক্যাল অস্ত্রভাণ্ডার নিষ্ক্রিয় করায় যুক্তরাষ্ট্র সেটাকেই বৃহৎ অর্জন ভেবেছিল। দুঃখজনক যে, সেই হাস্যকর নিষ্ক্রিয়তার নাটক উšে§াচিত হওয়ার পর বিশ্বে তার অন্তঃসারশূন্যতার কথা জানাজানি হয়। আইএস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের যতই আড়ষ্টতা থাক এই পরাশক্তিকেই মধ্যপ্রাচ্যের সুদূর বিস্তৃত এই সংকটের জট খুলতে হবে বিশেষ করে যেনতেনভাবে ফেলে আসা বিভাজিত এক ইরাকে এবং কালক্রমে একীভূত এক সিরিয়াকে রাশিয়ার সহযোগিতায় অবদমিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের দোদুল্যমানতায় আইএস আরো নানা শক্তির সমন্বয়ে এই উদীয়মান জঙ্গি শক্তিকে রোমান্টিকতায় আকর্ষণীয় করে তুলবে। শোনা যায় ইউরোপীয় মুসলিম তরুণরা এই রোমান্টিকতায় প্রচণ্ডভাবে ইতোমধ্যেই আকর্ষিত হয়েছে। আরো বিস্ময়কর খবর আছে। সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেট অর্থাৎ আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শতাধিক পশ্চিমা মেয়েকে পাওয়া যাবে এমন দাবি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। এই খবরে অনেকে অবাক হয়েছেন।
কারণ পাশ্চাত্যের মেয়েদের প্রায় সবাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত।
বারাক ওবামা ইরাকে আরো ১ হাজার ৫শ’ সেনা পাঠানোর অনুমোদন করেছেন। লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে এর আগেই সেখানে এসব সেনা সদস্য পৌঁছে যাবে ধারণা করা যায়। ইসলামিক স্টেটের অর্থাৎ আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইরাকিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়ার জন্য দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েন সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণে দাঁড়াবে। ওবামার এই সিদ্ধান্তের ফলে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের উপস্থিতি ও ভৌগোলিকভাবে তাদের বিস্তৃতি বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এও মনে হচ্ছে যে, হোয়াইট হাউসের এ প্রস্তাব নিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের কাছে কর্তৃত্ব হারানোর মতো ঝামেলায় ডেমোক্র্যাটদের পড়তে হতে পারে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ধর্মান্ধ কিংবা উগ্রবাদীদের উত্থান নতুন করে অনেক প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে। আইএস-এর জঙ্গিদের উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অভিযানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এদিকে আমাদের অঞ্চলেও নানা আবরণে উগ্রবাদী কিংবা ধর্মান্ধ জঙ্গিদের অপতৎরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতে বাংলাদেশের কয়েক জঙ্গি (নারীসহ) আটক হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য মিলেছে যা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে, সেসবই বলে দিচ্ছে জঙ্গিদের নতুন করে সংগঠিত হওয়ার এই অপতৎরতা ও ছদ্মাবরণে তাদের ভয়ঙ্কর সব ছক এঁকে চলা উদ্বেগের কথা, যা উৎকণ্ঠার দাগ মোটা করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ আমাদের অঞ্চলে এবং ইউরোপের কোনো কোনো দেশে তারা যেভাবে সংগঠিত হচ্ছে তা বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কতটা আমলে নিচ্ছেন তা বলতে না পারলেও এটুকু তো বলা যায়ই যে, জঙ্গিবাদের উত্থানের পশ্চাৎকারণ চিহ্নিত করে শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি দেশের সরকারের মধ্যে একটি সমন্বয় ও সে রকম কার্যক্রম চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি ইয়েমেনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, সাম্প্রদায়িক সংঘাত জোরদার হওয়ার প্রেক্ষাপটে সে দেশটি ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে। অর্থাৎ শান্তির সুবাতাস কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জঙ্গিবাদের নব উত্থান কিংবা উগ্রবাদীদের আস্ফালন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন এক অন্ধকার পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর শেষ কোথায় এও এখন বলা খুব দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে জঙ্গিবাদ কিংবা উগ্রবাদীদের মোকাবেলায় বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম যে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুফল দেবে না এও ধারণা করা যায় খুব সঙ্গত কারণেই। কারণ এর শিকড়-বাকড় এখন অনেক ছড়িয়ে পড়েছে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
কলামিস্ট, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
( মানব কন্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন