নবান্ন ও বাংলাদেশের কৃষক সমাজ
12 November 2014, Wednesday
‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ জীবনানন্দ দাশের এই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিটির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে কবির একান্ত নিজস্ব ক্যালেন্ডারের নবান্ন। যদিও এই ভরা হেমন্তেও অনেক অঞ্চলেই নতুন ফসলের এখনো তেমন ঘ্রাণ নেই, আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ে মাঠে পৌষ সন্ধ্যায়। হয়তো বা কবিতার কোনো নিজস্ব ব্যাকরণ নেই। তাই কবিতার খাতির এলোমেলো অপ্রাসঙ্গিক ও অসংলগ্ন শব্দ চয়ন বা রূপকল্প রূপসী বাংলার নির্জনতম এক রচনাশৈলী। তবু কেউ সময়-কালের অসঙ্গতি নিয়ে মাথা ঘামায় না নবান্ন নয় নিছক কবিতাই সেখানে প্রতিপাদ্য। ধানসিঁড়ি-জলসিঁড়ি নিয়ে কারোরই অস্বস্তি নেই শুধু তা ভালো লাগলেই হলো। আমি নিশ্চিত যে কার্তিকের অকালে বা টানাপড়েনের মাসে কদাচিৎ কেউ সদ্য শিশিরস্নাত সন্ধ্যায় পিঠে-পুলি বা মোয়া-নাড়– নিয়ে বসে না বা তার অভাবে কেউ হৈচৈও করে না। হৈমন্তিক প্রশান্তিতে এই আমি প্রাণভরে বাংলার মুখ দেখিয়াছি এবং বারবার দেখবার ইচ্ছে পোষণ করি সেটাই কি এক বিরাট পাওয়া নয়? বাংলার মুখাবয়বের সঙ্গে ভালোবাসা ‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন’ এক অনির্বাচনীয় অভিমান কার্তিক ছাড়া কবে আর তার শতভাগ অনুভব ভাগ্যে জোটে। কোনো জাতি যদি তার মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চায় তাকে অর্থনৈতিকভাবেও শক্তিশালী হতে হয়। পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগোতে দিন।
আমাদের গ্রীষ্ম প্রধান দেশে একটি প্রলম্বিত নবান্ন কারোই বা না কাম্য। কার্তিকে নবান্ন না জমলেও অঘ্রাণে তা উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করে। নতুন চালের গুঁড়োয় তৈরি ভাপা পিঠার গন্ধে ম-ম করে চারদিক। শহরের অভিজাত এলাকায় রীতিমতো পিঠে-পুলির মেলা বসে। এর খানিকটা অবশ্যই জীবনানন্দীয়। তিনি ছাড়া আর কে দিতে পারতেন আবহমান বাংলার নস্টালজিয়া যা আমাদের নাতিদীর্ঘ শীতের মৌসুমকে আবিষ্ট করে রাখে। জীবনানন্দ কী কারণে ‘মরা’ কার্তিকে নবান্নের উৎসবকে টেনে এনেছিলেন তা আমরা হয়তো কোনোদিনই জানব না তবে তিনি যে সংবৎসর শিশির ভেজা হেমন্তের জন্য উন্মুখ থাকতেন তা আন্দাজ করা যায়। এটা বুঝতে পারি যখন আমি আমার মহাখালীর বাড়ির পার্ক রোড থেকে জানুয়ারি শুরুর দিক থেকেই বার্ষিক পিঠে মেলার উদ্যোগ, আয়োজন শুরু হয়ে যায়। আমাদের গতানুগতিক জীবনে সেও এক আনন্দ ঘন অনুষ্ঠান!
অবশ্য রাজধানীর অধিক আকর্ষণীয় স্পটগুলোতে পিঠে উৎসব রীতিমতো কার্নিভালের মতো যেখানে তরুণ-তরুণীরা সেজেগুজে আসে। কালে-ভদ্রে গ্রামে পিতৃপুরুষদের ভিটেমাটিতে যাই। গ্রামীণ জনপদে এখন স্বভাবতই অনেক বৈচিত্র্য নেই, প্রাচুর্যও নেই। কিন্তু স্মৃতি আছে, রহস্য আছে। সেই সমস্তই ঘুরে ফিরে দেখি, স্মৃতির রোমন্থন আছে, আছে পূর্বপুরুষদের কবরস্থান, বাঁশের ঝাড়, হঠাৎ কোথা থেকে যেন হুতুম পেঁচার ডাক। জীবন এক অপূর্ব সম্পদ। জীবনানন্দ তাকে বহুমুখী রূপ দিয়ে গেছেন। তা না হলে হয়তো বা তা নিতান্তই এক ঘেয়েই হতে পারত। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। এর মধ্যেও গ্রাম-বাংলার কৃষককুল ঘটা করে সব উৎসব সাড়ম্বরে পালন করেন। একটা কথা একেবারেই অনস্বীকার্য যে, বাংলার কৃষি সমাজে বাংলা পঞ্জিকা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। চৈত্রে রবিশস্য, বৈশাখে বোরো ধান, জ্যৈষ্ঠে ফল-ফলাদি, পৌষের পিঠাপুলি আর কনকনে শীত। এসবই লোকজীবনের অনুষঙ্গ এবং খুবই পরিচিত। গাছের তলায়, বাগ-বাগিচায়, সর্বোপরি নিসর্গের বুকজুড়ে মৌসুমে মৌসুমে যে পরিবর্তন আসে, সেদিকে খেয়াল করার অবকাশ নাগরিক জীবনে এতটা না থাকলেও গ্রামের মানুষ এই আনন্দঘন বিষয় উপেক্ষা করতে পারেন না। কারণ এর সঙ্গে যোগ যে তাদের জীবনসূত্রের কৃষি অর্থনীতির। কাজেই গ্রাম-বাংলায় নবান্ন এক অনন্য উৎসব। নবান্ন আসে জনমানুষের অন্তরজুড়ে, অকৃত্রিম আনন্দ-আবেগ নিয়ে।
গ্রামীণ লোকজীবনে চিরায়ত এই পার্বণ গ্রামীণ নাগরিক জীবনে হয়ে ওঠে উৎসের দিকে ফিরে তাকানোর উৎসবে। অনস্বীকার্য যে, এও আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই একটি অংশ আর এসব খণ্ড খণ্ড অংশ মিলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়ে ওঠে আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথ। যে কোনো জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পরও আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুস্থ গণতান্ত্রিক পথে রাজনৈতিক বিকাশের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। কিন্তু গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল কৃষি উৎপাদকরা সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে সুখী-সমৃদ্ধিশালী-শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের প্রত্যাশা করেন। তাদের চাহিদা খুব কম। তারাই আমাদের স্বপ্নের মূল কারিগর, অর্থনীতির মূল জোগানদার। তাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা-শ্রম-উৎপাদন আমাদের জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখে অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো তারা নানা ক্ষেত্রে উপেক্ষিত, তাদের জন্য বরাদ্দে থাবা বসান ক্ষমতাবান কেউ কেউ। এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্ট নয়। তারপরও তারা এগিয়েই যেতে চান, উৎসব-আনন্দে সব কিছু মাতিয়ে রাখতে চান। নবান্ন এরই একটি অংশ।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
( মানব কন্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন