ক্রেমলিন থেকে নির্গত হিমেল অবসাদ
16 October 2014, Thursday
ভøাদিমির পুতিন যা-ই কিছু করেন বা বলেন, তা অহংকার মিশ্রিতই হোক বা পদমর্যাদা আহরণেই হোক তা দুর্গন্ধ ছড়ায়। বিশেষ করে কাউকে নিজের পরিতৃপ্তির জন্য আঘাত দিতে রুশদের জন্য তা কার্যকর। পুতিন এবার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মস্কের লেক সোলগারে কিছুটা ঐতিহ্য জড়িত হলেও তার এবারের বার্ষিক যাত্রা স্থগিত করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট তার জিন্স এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরিধেয় থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মাইক্রোফোন হাতে আগ্রহী যুবকদের মিশ্র প্রশ্ন করতে লাগলেন। অতঃপর তীক্ষœ কিছু মন্তব্য করলেন, যা মনে হলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল।
এ বছর পুতিনের মন্তব্য অন্যবারের চেয়ে তীক্ষœতর ছিল। পুতিন ধীরকণ্ঠে শুরু করলেন : রাশিয়া কিন্তু এবার কোনো বিশাল সংঘর্ষে জড়ায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের তৈরি থাকতে হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে কোনো আঘাতকে প্রতিহত করতে। পুতিনের পরবর্তী উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি পরবর্তীতে বলেন, রাশিয়ার মিত্রদের বোঝা উচিত, কিছুতেই আমাদের সঙ্গে তাদের মাখামাখিতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। আমি পরিষ্কারভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, রাশিয়া এ মুহূর্তে বিশ্বের বৃহত্তম নিউক্লিয়ার শক্তি।
কোনো এক ভাষ্যকার পুতিনের ক্লাসিক ভাবলেশহীন এ মুহূর্তের মুখাবয়বকে তুলনা করেছেন যেন তা তার ঘানেপ্রিয়কে তার প্রিয় ওটসের ডালিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বহিরাগত যে কারো জন্য তা দেখাবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভের মতো। তিনি যেন সমবেত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের (পাশ্চাত্যের) বলছেন : ‘আমরা তোমাদের জ্ব্যান্ত কবর দেব। তবে যে কথাটি ক্রুশ্চেভ উহ্য রেখেছিলেন তা হলো তোমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক এটিই ইতিহাস।’
পুতিন এখন যা-ই করুন বা বলুন তাতে কিছুটা ঔদ্ধত্য ও পদমর্যাদা লাভের দুর্গন্ধ থাকবেই। বিগত ১৪ বছর ধরে একনাগাড়ে ক্ষমতার শীর্ষ থেকে পুতিন পাশ্চাত্যে বা রুশ শ্রেষ্ঠত্বের ওপর ঔদ্ধত্য, অসন্তোষ নিয়ে নিজের গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয় ভাবমূর্তি গড়তেই পারেন। পুতিন মনে করেন অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়ারও অবশ্যই শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, যা পাশ্চাত্যের রুচি মোতাবেক গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। পাশ্চাত্যের ভালো লাগুক বা না লাগুক রাশিয়ারও এক প্রকার ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ আছে।
এমন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্যের ন্যাটোকে বিস্তৃত ও প্রসারিত করার সিদ্ধান্তে এবং কালক্রমে মধ্য এশিয়ায় নয়/এগারোর পর প্রবেশের লিপ্সা, একটি অবাধ্য জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে বলদৃপ্ত করার প্রয়াস রাশিয়ার আহত গর্ববোধকে উসকে দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ভালো হতো যদি এমন নীরব ক্ষমতাদ্বন্দ্বে স্নায়ুযুদ্ধের উপসর্গগুলোকে এড়ানো যেত। কিন্তু এমন সম্ভাবনা তো ক্ষীণ। রাশিয়ার ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ নিয়ে কথাও আছে বিস্তর, যদিও পুতিন এসব গ্রাহ্য করেন বলে মনে হয় না। কারণ রাশিয়ার নিউক্লিয়ার শক্তির সামর্থ্য সম্পর্কে যারা জ্ঞাত আছেন, তারা সহজেই পুতিনের ঔদ্ধত্যের উৎসও খুঁজে পাবেন।
ভøাদিমির পুতিনের নানা বক্তব্য কিংবা মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায় এর পেছনের রহস্যও কম বিস্তৃত নয়।
কিন্তু কথা সেটি নয়। বিশ্বে বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধের যে দামামা বাজছে তাতে শঙ্কার মাত্রা সঙ্গতই ক্রমে পুষ্ট হচ্ছে। ভøাদিমির পুতিন আজ রাশিয়ার সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কিংবা নিজেদের দাম্ভিকতা প্রকাশের জোরেই হোক কিংবা অন্য যেকোনোভাবেই হোক তিনি কখনো কখনো এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন, বিশ্বের নানা পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করছেন তাতে অসন্তোষের ছায়া ক্রমপ্রলম্বিত হচ্ছে। রাশিয়ার অনেক ক্ষেত্রেই যে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তা পুতিনের মতো আরো অনেকেই মনে করেন এবং এই মনে করাটা অসঙ্গত নয়। পাশ্চাত্যের অন্যদের কাছে রাশিয়ার ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ গ্রহণীয় কিংবা অগ্রহণীয় কি-না সেটা বিবেচ্য বিষয় নয় অন্তত পুতিনের কাছে। পুতিন তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এমনটিই অহরহ প্রকাশ করে চলেছেন। মধ্য এশিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজকের পর্যবেক্ষণও ভিন্ন। এই ভিন্নতার প্রেক্ষাপটও অন্য রকম। নীরব ক্ষমতাদ্বন্দ্বে স্নায়ুযুদ্ধের উপসর্গগুলো কোনো মতেই যেন এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে শঙ্কার কারণ রয়েছে বহুবিদ এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মাত্রা ক্রমে পুষ্ট হলেও তাতে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রকদের কিছু যায়-আসে না।
কিন্তু এতে যায়-আসে অন্য অনেকের এবং এর কারণও রয়েছে সঙ্গতই। স্নায়ুযুদ্ধের উপসর্গগুলো সরাতে যাদের প্রয়াস চালানোর কথা বা সে রকম ক্ষমতা ও অবস্থান রয়েছে, তারা তো নানা কারণেই মৌন। এই কারণগুলোর প্রেক্ষাপটও আমাদের অজানা নয়। তারাই তো নানাভাবে এমন উপসর্গের জন্মদাতাও আবার একই সঙ্গে পরিচর্যাকারীও। ভøাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ড ও বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার অনুকূলে যে নয় এ নিয়েও কথা আছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে বিশ্বের ক্ষমতাধররা নিষ্ঠ হলে ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পথটি কণ্টকমুক্ত করা যেত।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন