ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের নিয়ামক
17 September 2014, Wednesday
পাকিস্তানি শাসনামলে ভিন্নমত প্রকাশের সামান্যই সুযোগ ছিল। আমরা এ অঞ্চলের মানুষরা যখনই গণতন্ত্র, জাতীয়তা বা যে কোনো রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ নিয়ে, দেশের সামষ্টিক কল্যাণে কিছু ভেবেছি, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার টুঁটি চেপে ধরেছে। নানা রকম কালাকানুন প্রণয়ন বা সামরিক ফরমান জারি করে গণতন্ত্রের বিকাশকে হরণ করেছে বারবার। গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলেও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবে এবং রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের অযাচিত প্রাধান্যে পাকিস্তানের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত, মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি নিয়মতান্ত্রিক বিতর্কের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে সম্ভাবনা ছিল, তাকে ব্যক্তি-গোষ্ঠী প্রভাবান্বিত করে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়। অতঃপর পাকিস্তান- যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিলাম আমরা বাঙালিরা- তার পরিণতি দেখা গেল বিশ্বের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক সামরিক শাসনে দেশটির জন্মের মাত্র এক দশকের মাথায়।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের রাজনৈতিক যাত্রাপথ স্বভাবতই অভিন্ন থাকল না; যদিও তা একটি পরিণতিতে পৌঁছতে আরও কিছু সময় লেগেছিল। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবেই হোক বা সর্বভারতীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তিক্ততার প্রভাবেই হোক, এ উপমহাদেশের প্রধান দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রথম বিভক্তি বা বিভাজনটি ঘটে যায়। ১৯৪৭ সালের অনেক আগ থেকেই ভারতীয় নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বিশ্ব দর্শন (ওয়ার্ল্ড ভিউ) ছিল। কিন্তু হাজার বছরের সাম্রাজ্য হারানো ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের তা ছিল না। যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সচেতন হিন্দু সম্প্রদায় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আনুকূল্যে বেঙ্গল রেনেসাঁ এবং পরে হিন্দু প্রভাবান্বিত মডার্ন ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজমের সূচনা করছিল, সারা ভারতের মুসলমানরা তখন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে জায়গিরদারির তক্মা সংগ্রহে ব্যস্ত। দেশ বিভাগের পর দেখা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানে দেশের রাজধানী এবং জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্র। পাঞ্জাবি ও পাঠান জাতিগোষ্ঠী, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং ভারত থেকে আসা শীর্ষ আমলারা গোটা পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। পাকিস্তানের পূর্বাংশ- যেখানকার মুসলমানরা স্বাধীনতা তথা দেশ বিভাগের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল- তারা আগের মতোই রয়ে গেল।
শেখ মুজিবুর রহমান (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি) সাফল্যের সঙ্গে এ ভূখণ্ডের মানুষকে সংগঠিত করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ- কেউ কখনও অতিমানব হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুও ভালো-মন্দে মিশ্রিত একজন মানুষ ছিলেন। যার বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ। তারও সীমাবদ্ধতা বা মানবিক বিচ্যুতি থাকতে পারে। সুখ-দুঃখ এমন অসাধারণ মানুষকেও স্পর্শ করতে পারে। এ সত্যটি তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীরা বুঝতে বা স্বীকার করতে অক্ষম।
এর প্রমাণ বর্তমানে পাকিস্তানিদের অনুকরণে এ দেশে সামরিক ও বেসামরিক স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মতোই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন একটি বিতর্কিত সরকারের ভূমিকা ও তার আত্মম্ভরিতা। পরিতাপের বিষয় হল, তাদের চাতুর্যের বিষয়টি যে অন্যরা বুঝতে পারে, এটা তারা আমলে নিতে চায় না। অবশ্য এর কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখি না। সেটাও স্বাভাবিক। প্রতিক্রিয়া প্রতিদিন ঘটে না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানও প্রতিদিন ঘটেনি, তার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে কিছু সময় লেগেছিল।
এই একই বিতর্কিত সরকার পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের মতোই আমাদের কণ্ঠরোধ করছে। বিচারপতিদের অভিশংসনের অধিকার সংসদকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছে- যে সংসদ অনির্বাচিতদের সংসদ। পাকিস্তানের এবডো স্টাইলের আইন-কানুন বিধিবদ্ধ করতে যাচ্ছে এ সরকার। এ সবকিছুরই তিক্ত প্রতিক্রিয়া জনগণের মনে দীর্ঘদিন ধরে দানা বাঁধছে। একটি পর্যায়ে এসে হয়তো এর বিস্ফোরণ ঘটবে।
এ দেশে মুক্তচিন্তার দরজা ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি একে খন্দকার বীর উত্তম তার মতো করে বই লিখতে পারবেন না। লিখতে হবে ক্ষমতাসীনদের চিন্তা ও বক্তব্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে! ক্ষমতাসীনদের ফরম্যাট অনুযায়ী দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন অক্ষত রেখে! তা না হলে তিনি দেশদ্রোহিতার অপরাধে দণ্ড প্রাপ্তির জন্য সাব্যস্ত হবেন। দেশের উভয় রাজনৈতিক শক্তির বলয়ে আমার কিছু বন্ধু ও সুহৃদ আছে। কিন্তু এতদিন এমন কঠোর বক্তব্য কোনো আওয়ামীপন্থীর কাছে শুনিনি।
ক্ষমতা কখনোই কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়। অনেক ক্ষমতাবানকে ক্ষমতার বলয় থেকে বাইরে নিক্ষিপ্ত হতে দেখেছি এবং আমি তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর কেউ না হলেও সর্বক্ষেত্রে তাদের দুর্বিপাকে দুঃখবোধ করেছি। অথচ এমন দুর্বিপাক ও দুঃখবোধ কিন্তু এড়ানো সম্ভব। শর্ত শুধু হৃদয়কে প্রসারিত করার। সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বা ভাসানীর মতো বিশাল হৃদয়ের রাজনৈতিক নেতাদের আজ বড়ই প্রয়োজন, যারা আপাতদৃষ্টিতে শত্র“কেও বুকে টেনে নিতে পারতেন। আজ ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মনোবৃত্তিসম্পন্ন নেতা ও রাজনীতিকদের ভিড়ে এ দেশের রাজনীতির স্বর্ণযুগের নেতাকর্মীরা হারিয়ে গেছেন।
দেশে একটি সুস্থ রাজনীতি বা তার সংস্কৃতির উন্মেষ যদি ঘটাতে হয়, তাহলে কোনো দল বা নেতাকর্মীরা মর্মাহত হন এমন কোনো কটাক্ষ বা কটুকাটব্য সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত। একে খন্দকার তার লিখিত বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের কী এমন মৌলিক মূল্যবোধের ব্যত্যয় ঘটালেন, যা নিয়ে এত হৈচৈ, তা আমার বোধগম্য নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরসেনানী যাকে বঙ্গবন্ধু নিজে বীরউত্তম খেতাব দিয়েছেন এবং যিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত মৃদু ও মিষ্টভাষী, তার ভাগ্যে যদি দেশদ্রোহিতার খক্ষ ঝোলে, তাহলে আমাদের মতো অধম পাকিস্তান প্রত্যাগতদের কোন আলোকে দেখা হবে তা ভেবে শংকিত হই।
এ দীর্ঘ জীবনে সমাজ সংসার রাজনীতির কতই না বিবর্তন দেখলাম। এখন মনে হয়, আজকের এ অবস্থা দেখতে নাই বা বাঁচতাম- তাতে কার কী এসে যেত। তবু তো আজকের রাজনীতির প্রতারণা, মহামারী সদৃশ দুর্নীতির বিস্তার, মিথ্যাচার, পরস্পরকে দোষারোপ, তুচ্ছ কারণে ক্ষমতার দাপট, খুনখারাবি, ছিনতাই, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, মুক্তিপণ দিতে অপারগতায় হত্যা, বগুড়ার বানভাসিদের কান্না, দুর্ভোগ, এমনকি ত্রাণ-সাহায্যেও কর্মকর্তাদের ভাগ বসানো- এসব দেখতে হতো না। শুনতেও হতো না।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পাকিস্তান প্রত্যাগত আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। ভেবেছিলাম, এ দেশ অন্তত একটি বিভাজিত দেশ হবে না। কিন্তু দেশে ফিরেই লক্ষ করছিলাম একটি অদৃশ্য বিভাজন রেখা। সেই বিভাজন রেখার এক ধারে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ ও তার গুণদর্শী অঙ্গসংগঠন, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী এবং নাম না জানা আরও সব বাহিনী; অন্য ধারে আমাদের মতো পাকিস্তান প্রত্যাগতরা, যারা হাল ধরেছিলাম একটি সেনাবাহিনীর এবং আশা করেছিলাম পাকিস্তানে নেয়া ইতিবাচক প্রশিক্ষণ দিয়ে এই বাহিনীকে গড়ে তোলার। এ প্রক্রিয়ায় যদিও আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো বড় একটা সুখকর ছিল না।
পাকিস্তানে কখনও কোথাও একে খন্দকারের মতো মহৎ সজ্জনের দেখা হলেও হয়ে থাকতে পারে। তবে তাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনেছিলাম ১৯৮২ সালে জেনারেল মঞ্জুরের সফরসঙ্গী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা সফরের সময়। পরবর্তী সাক্ষাৎ হয়েছিল দিল্লিতে, যখন তিনি হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতুল বারী, যিনি তখন ভারতে মিলিটারি এটাশে হিসেবে নিযুক্ত, তার কাছে শুনেছিলাম ভারতীয়দের কাছে খন্দকার সাহেবের ক্রেডেনশিয়ালের কথা। শুনেছিলাম তিনিই ছিলেন দিল্লিতে একমাত্র রাষ্ট্রদূত, যাকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কোনো অ্যাপয়েনমেন্ট নিতে হতো না। তার সঙ্গে ক্যানবেরা ও দিল্লিতে আলাপচারিতায় বুঝেছি, তিনি প্রচণ্ডভাবে মুজিবভক্ত ছিলেন। এমন একজন মুজিবভক্তের যদি এই দশা হয়, তাহলে সাধারণের ভাগ্য কী হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।
এম আবদুল হাফিজ : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
( যুগান্তর )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন