আইসিসকে সামনে রেখে নব্য জঙ্গিবাদের বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি!
06 September 2014, Saturday
আইসিসের (ISIS-Islamic state of Iraq and Syria) বিধ্বংসী যোদ্ধারা যখন বিগত মাসের মাঝামাঝি উত্তর ইরাককে তছনছ করে এগোচ্ছিল সংগঠনটির একজন মুখপাত্র দেশটির বর্তমান তাঁবেদার সরকারকে বিদ্রূপ করে একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে ওই মুখপাত্র ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে 'আন্ডারওয়্যার (Underwear) ব্যবসায়ী' আখ্যায়িত করে তাঁকে সতর্ক করে দেয় এই বলে যে তাঁর বিরুদ্ধে শুধু বাগদাদের পতন ঘটিয়েই প্রতিশোধ নেওয়া হবে না, বরং তা আসবে নজফ বা কারবালার মতো শিয়াদের কোনো প্রতীকী তীর্থস্থান দখলের মধ্য দিয়েও।
উল্লেখ করা যেতে পারে, আইসিসের যোদ্ধারা সুন্নি ইসলামের কট্টরতম মতবাদের অনুসারী এবং মালিকির সরকারে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মগোষ্ঠী শিয়াদেরই প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি। দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠীগত ধারার শুরু থেকেই অনতিক্রম্যভাবে বিভাজিত, যা দুটি বিশ্বযুদ্ধে তাদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' রাজনীতি দিয়ে ইংরেজ ও ফরাসিরা আরব বিশ্বে তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চলগুলোতে কয়েক শতাব্দীর এই বিভাজনে আরো দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। অবশ্য তার নেপথ্যে আছে উভয় সম্প্রদায়ের নিজ নিজ পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে অন্ধ বিশ্বাস। উভয় সম্প্রদায়ই মনে করে যে তারাই ইসলামের মূল ধারা এবং ঐশী দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
অথচ উভয়েরই অভিন্ন শত্রু বা প্রতিপক্ষ রয়েছে। বিশ্ব মুসলিমের কাছে সবচেয়ে অন্যায্য বিষয় পশ্চিমা শক্তিদের ফিলিস্তিনিদের বাসস্থান ফিলিস্তিন থেকে তাদের বিতাড়ন এবং সেখানে আরব মুসলিমদের প্রায় হৃৎপিণ্ডের ওপর ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা। ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, আমেরিকায় যারা ৯/১১ ঘটিয়েছিল, সেই আল-কায়েদা ও তার আশ্রয়দাতা তালেবান সুন্নি মতাবলম্বী। আবার ইসরায়েলসহ আমেরিকার ঘোর শত্রু ইরানে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয়েছিল ইসলামী বিপ্লব, যার মন্ত্রে সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে দেশটির শাসন পরিচালিত হয়- তারা শিয়া বিশ্বাসের অনুসারী।
তবে ইরাকের ক্ষেত্রে একটি প্রবঞ্চনার বিষয় দেদীপ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একপর্যায়ে বিদেশি হস্তক্ষেপে ক্ষমতার দ্রুত পালাবদলে কিছু কথিত 'লৌহমানবের' প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তেমনই এক লৌহমানব ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, যিনি নিজে সুন্নি মতবাদের অনুসারী হলেও জাতি-ধর্ম-গোত্রে বিভক্ত ইরাকের জনগণ যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল শিয়া মতাবলম্বী, সাদ্দাম তাঁর ঐন্দ্রজালিক এক ক্ষমতায় তাদের ওপর একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের চিরাচরিত কৌশল ব্যবহার করে সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে শিয়াদের তাদের প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন করে এবং শিয়ারা রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন জনমত যখন সোচ্চার হয়ে উঠছিল, বিশেষ করে সাড়ে চার হাজার মার্কিন সেনা যুদ্ধে নিহত হওয়াসহ উভয় দেশের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের ডামাডোলে যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত নব্য রক্ষণশীলদের নেতা জর্জ বুশ নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিদায়ঘণ্টা বাজে। অতঃপর ইরাক যুদ্ধ শেষ করে মার্কিন সেনাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আশ্বাস দিয়ে একজন বারাক ওবামা ক্ষমতার হাল ধরেন। তখনই প্রশ্ন ওঠে, যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে এবং ইরাকও মোটামুটি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন হয়েছে, সে দেশটি থেকে কোন প্রক্রিয়ায় বা ব্যবস্থায় সেনা প্রত্যাহার করা যায় ইরাককে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে। ইরাকে মার্কিন সেনাদের হাল ধরবে কে বা কারা? এ ছাড়া বিশ্ব জনমত প্রতিকূলে থাকলেও জ্বালানিসমৃদ্ধ ইরাক তো মোটামুটি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন। দেশটিকে নিজেদের প্রভাবাধীন রাখতে মার্কিনরা অবশ্য আগে থেকেই ছক কেটে রেখেছিল।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা অন্তরে অন্য অভিলাষ পোষণ করলেও ইরাক আগ্রাসনের অপরাধ লাঘব করতে শুরু থেকে ওই একই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের কথাই বলেছিল আমেরিকা ইরাক আগ্রাসনের প্রাক্কালে। কোনো সেন্যা প্রত্যাহার বা ইরাককে কোনো ছাড় দেওয়ার আগে ইরাকে আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করবে এমন ব্যক্তি বা তাকে ক্ষমতায় আনার দীর্ঘ এক্সপেরিমেন্টের পর একজন শিয়া নুরি আল মালিকি মসনদে অধিষ্ঠিত হন।
আইসিসকে সামনে রেখে নব্য জঙ্গিবাদের বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি!
দুর্ভাগ্যক্রমে মালিকি সব সম্প্রদায়ের ইরাকিদের অন্তর্ভুক্ত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকার গঠনে ব্যর্থ হলেন। সাদ্দামের জন্য অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টি ছিল গৌণ। কেননা তিনি বাথ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসে তাঁর শাসনব্যবস্থায় এক ধরনের অন্তর্ভুক্তিকরণেরই রাজনীতি করতেন। কিন্তু সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে এই Inclusiveness-এর প্রশ্ন মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। কারণ মালিকির স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় অন্যরা তো দূরের কথা, সংখ্যালঘু মুসলিম সুন্নি মতাবলম্বীরাও অচ্ছুৎ পরিগণিত হতে থাকে। ইরাক যুদ্ধের শুরু থেকে যে মার্কিনবিরোধী একটি দুর্বল প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, সেখানে শিয়াদের পাশাপাশি মুকতাদা আল সদরের নেতৃত্বে একটি সুন্নি সংস্থাও সক্রিয় ছিল। কিন্তু শিয়া-সুন্নি পারস্পরিক সন্দেহের কারণে উভয়ে যতটা না মার্কিনদের ত্রাস ছিল, তার অধিক ছিল তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে।
একজন বাধ্য ও অনুগত মালিকিকে মসনদে বসিয়ে মার্কিনরা আশ্বস্ত থাকলেও যখন ইরাকে পরবর্তী সময়ে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে, মার্কিনরা তখন তার মন্ত্রিসভাকে inclusive অর্থাৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বমূলক ফোরামে পরিণত করার পরামর্শ দিলেও মালিকি তা অগ্রাহ্য করে এবং একই সমান্তরালে ইরাকে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। ইরাক যুদ্ধে নাস্তানাবুদ মার্কিন প্রশাসন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের খুশি করতে একজন শিয়া নুরি আল মালিকিকে ক্ষমতায় পেয়ে একটি স্থিতি, বন্ধুসুলভ ইরাকের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিল। অন্তর্ভুক্তির কারণে Inclusiveness-এর বিরুদ্ধে মালিকির অবস্থান স্পষ্টতই এখন তা ভেস্তে দিচ্ছে। আইসিস কিছুদিন আগেই উত্তর ইরাকে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল এবং জ্বালানিসমৃদ্ধ তিকরিত যেখানে ইরাকের বৃহত্তম তেল শোধনাগার অবস্থিত, তা দখলে নিয়েছে।
আইসিসের মতাদর্শ, কায়দাকানুন ও কৌশল আল-কায়েদা বা তালেবানের অনুরূপ। ওসামা বিন লাদেনের এককালের সহযোগী আয়মান আল জাওয়াহিরি কোনো অজ্ঞাত স্থানে আইসিসের সংস্পর্শে এসে এর নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতা দর্শনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কিছুটা মডারেট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
নতুন করে এই যে জঙ্গিবাদের অপ্রতিরোধ্য উত্থান এবং আইসিসের সেই উত্থানপ্রক্রিয়ার তৎপরতা বিশ্বব্যাপী কথিত জিহাদের একটি মাত্র ফ্রন্ট। এই জিহাদের রণাঙ্গন পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং সেখান থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। আইসিস যখন মসুল দখলে নিচ্ছিল, পাকিস্তানের জিহাদিরা দেশটির ব্যস্ততম বিমানবন্দরে অজ্ঞাত কারণে হামলা চালিয়ে ৩৬ জনকে হত্যা করেছে। জিহাদি মন্ত্রই আল শাবাব উগ্রবাদীদের অন্তত ৪৮ জনকে ব্লাসফেমি নির্মূলে কেনিয়ার একটি উপকূলীয় শহরে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। গত মাসের ১৫ তারিখে সন্দেহভাজন আল-কায়েদা যোদ্ধারা ইয়েমেনে একটি হাসপাতালের বাসভর্তি স্টাফকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের লক্ষ্যবস্তুরূপে বেছে নিয়েছে। একই মতাদর্শের অনুসারী নাইজেরিয়ার বোকো হারাম আপাতভাবে অজ্ঞাত কারণে বেশ কিছু স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করেছে।
ইরাকের প্রয়াত লৌহমানব সাদ্দাম হোসেন সুন্নি মতাবলম্বী হলেও তাঁর সম্পর্কে আল-কায়েদা বা কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতার অপবাদ ছিল না। সন্ত্রাসের জন্য পশ্চিমা শক্তি তাঁকে বিধ্বংসী অস্ত্রের বা Smoking Gun-এর অপবাদ দিলেও অধিকৃত ইরাক তন্ন তন্ন করেও এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। আবার ওই একই সুন্নি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত আফগানিস্তানের তালেবান দেশের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটদাতাদের আঙুল কর্তন করেছে।
ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন নেভি সিলের কমান্ডোরা তাঁর অ্যাবোটাবাদের আস্তানা থেকে মৃত অথবা জীবিত কিন্তু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নয়, ৯/১১-এর পরিকল্পককে নিয়ে পালাবার সময় আরব সাগরে তাঁর সলিল সমাধি নিশ্চিত করলেও তাঁর লিগ্যাসি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণে ওসামার মৌলবাদী আদর্শের আবেদন এখন আরো প্রগাঢ়। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় জীবনদান ও জীবন হরণ উভয়কেই সৌদি রাজপরিবারে বংশানুক্রমিকভাবে ঠিকাদারিতে লিপ্ত এই ধনাঢ্য 'সন্ত্রাসী উম্মাহর' দুর্দশায় ব্যথিত হৃদয়ে তাঁর জীবনের সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। যে কারণগুলো তাঁকে সর্বদা কষ্ট দিয়েছে, সেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা কি লাঘব হয়েছে? সারা বিশ্বে পশ্চাৎপদ আরব মুসলিম জনগণ কি আলোর পথে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হয়েছে? অথচ তারা তো এক গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতার উত্তরাধিকারী। একই কারণ যা ওসামা বিন লাদেনকে পর্বতে-গুহায় যাযাবরের জীবনযাপন করিয়েছে- বিদ্যমান ওই একই কারণগুলো আইসিসের উদ্ভব ঘটায়। ওসামা থাকুক বা না থাকুক এক ক্যারিশমাসম্পন্ন আবু বকর বাগদাদির হাতে এখন সাম্রাজ্যবাদের খপ্পর থেকে বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইরাকের গৃহহীন উদ্বাস্তুরা তাই আল-কায়েদা জঙ্গিবাদের এক নতুন সংস্করণের জন্ম দিয়েছে। পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিবাদ অবধারিত অন্য এক সংস্করণে রূপান্তরিত হবে। তাই ভাবার কোনো কারণ নেই যে বিন লাদেনের কথিত মৃত্যু বা জাওয়াহিরির ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার রটনা বা তালেবানের খলিফা মোল্লা ওমরের এখনো নিখোঁজ থাকাকে ঘিরে আন্দাজ-অনুমান চলতেই থাকবে যেমন সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভাব হবে আইসিস ও তাদের খলিফা আবু বকর বাগদাদির উত্থান।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব, কাতারসহ উপসাগরীয় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রপুঞ্জ, যা অবিশ্বাস্যভাবে তেলসমৃদ্ধ সিরিয়ার 'বিদ্রোহী' শিবিরে তাদের সমাগমে তাদের অনুরূপ আইসিসের সুন্নি মতাবলম্বীরা জিহাদে অংশ নিয়েছে বলে জানা যায়। তার সঙ্গে আইসিসের মতবাদ একীভূত হয়ে 'সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।'
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন