জটিলতার বৃত্ত: মুক্ত হওয়ার পথ যেন রুদ্ধ
29 August 2014, Friday
রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বিএনপির জন্য কদাচিৎ কোনো সুসংবাদ থাকে সংবাদপত্রে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। স্পষ্টতই আজকাল দলটির দুর্দিন চলছে। তবে অনেক বিজয়ের সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিজয়ী মহাজোটও কি খুব একটা স্বস্তিতে আছে? মনে হয় না। গণতান্ত্রিক লেবাস পরে অগণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। সব সময়েই একটি অপরাধবোধ প্রচ্ছন্নভাবে অনেক অর্জন সত্ত্বেও সেই অর্জনের কারিগরদের ওপর এক প্রকার অশুভ ছায়া বিস্তার করে থাকে। মুখে সরকার তার বৈধতার দাবি করলেও এবং তার পক্ষে চীন-জাপান-রাশিয়া-ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর বহুল প্রচারিত সফরনামার বয়ান দল করলেও এবং সামগ্রিকভাবে গণপ্রতিনিধিত্বহীন একটি দশম সংসদের দ্বারা গঠিত একটি সরকারের স্নায়ুবিক দুর্বলতা এবং মনোবৈকল্য স্বীকার না করলেও তা যে তাদের সারাক্ষণ অস্বস্তিতে রাখে তার প্রমাণ কোনো কোনো মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের কোনো কোনো ক্ষমতাবানের সর্বক্ষণিক দম্ভ ও আস্ফালন ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। সঙ্গে রয়েছে হাজারো রকমের দমননীতির উদ্ভাবন, প্রণয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা।
তবে এ কথা না বলে উপায় নেই যে, এ দেশে চার দশকের শাসক ও তাদের শাসনশৈলী বিশ্লেষণ করলে কোনো ব্যতিক্রম পাওয়া যায় না। তা সে সামরিক স্বৈরশাসকই হোক বা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের লেবাস পরা তিন মেয়াদের স্বৈরশাসনই হোক কিংবা এখন কি ধরনের শাসন চলছে তাও দেখছে জনগণ এবং সেটা তারাই ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন। অবশ্য মহাজোটের শাসন ব্যবস্থায় এলিট শ্রেণীর জন্য কসমেটিক বেশ কিছু চমক এসেছে। কিন্তু অন্দর মহলের কদর্যতা বেড়েই চলেছে। আওয়ামী লীগ নবম সংসদের পরে তার প্রলম্বিত শাসনের মেয়াদকালে প্রধানমন্ত্রীকে মনে হয় একাই একশ’। তিনি অনর্গল তার অর্জন এবং পরিকল্পনার কথা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, অর্জন তো আছেই কিন্তু অনেক অর্জনের যে কি সব কারণ বিসর্জন ঘটছে তাও তিনি নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছেন। নানাবিধ শঙ্কার জটাজাল ক্রম বিস্তৃত হচ্ছে। এর নিরসন আশ্বাস জরুরি।
এত পরিকল্পনা যে সরকারের রয়েছে সে সব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কি দলীয়কৃত আমলারা যথেষ্ট? আজ সর্বত্র সব খাতে বেহাল অবস্থা। যখন লেখাটি লিখছি তখন আমার সামনে রয়েছে দেশের প্রচার বহুল একটি দৈনিক পত্রিকা। পত্রিকাটির শুধু একদিনের সংবাদ শিরোনাম উদ্ধৃত করছি। ক. শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধা নিয়ে স্বেচ্ছাচার, খ. উৎপাদনশীলতায় কাজে লাগছে না প্রবাস আয়, গ. জনবলসহ অনেক সংকটে ধুঁকছে বন্ড কমিশনারেট, ঘ. অন্ধকার ঘরে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয় যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিএনপি নেতাকে। শিরোনামগুলো শুধু প্রথম পৃষ্ঠার। এমন সংবাদ শিরোনাম প্রত্যহ পড়ে পড়ে পাঠকদের অবশ্যই অরুচি ধরে থাকবে। কিন্তু সেগুলোই তো দেশ শাসনের নামে আজকের বাস্তবতা।
নবম সংসদের আমলের প্রায় একই সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কথা নাইবা বললাম। নাইবা পুনরাবৃত্তি করলাম বহুল আলোচিত হলমার্ক দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা, বিসিএল ও অন্যান্য আওয়ামী অঙ্গ সংগঠনগুলোর হাজারো প্রকারের রমরমা বাণিজ্যের কথা। চোখ-কান খোলা থাকলে ইচ্ছে না থাকলেও এসব তথ্য-উপাত্ত দেশ ও দেশবাসীকে ভাবায়, কাঁদায়। বাংলাদেশের রাজনীতির এই যে শ্রীহীন দশা তা তো একদিনে সৃষ্ট নয়। কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হলো যে, এসবের নিরসনকল্পে রাজনীতিকদের নেই যথাযথ সদিচ্ছা কিংবা আন্তরিকতা বরং পরিবেশ-পরিস্থিতি আরো কীভাবে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলা যায় এরই অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কাজেই রাজনীতি নিয়ে শঙ্কার মাত্রাও এসব কারণে প্রকট থেকে হচ্ছে প্রকটতর। কিন্তু উত্তরণের পথ যেন রুদ্ধ। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই এ কথাটি রাজনৈতিক মহল থেকেও অহরহ উচ্চারিত হয় বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কি এর কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাই? এসব প্রশ্নের উত্তর প্রীতিকর নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ হবে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু আমরা সংসদের কি রূপ দেখতে পাই? নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলেও রাজনীতিতে গুণগত কোনোই পরিবর্তন হয়নি। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীরা যেভাবে পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার করেন কিংবা করে চলেছেন এতে শ্রীহীন রাজনীতির চিত্র আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। ‘দেখতে নারী চলন বাঁকা’ নীতিতে চলছে দেশের রাজনীতি। গুণগত মান পরিবর্তন না হওয়ায় পরমতসহিষ্ণুতা নেই রাজনীতিতে যা গণতন্ত্রের অপরিহার্য একটি অন্যতম শর্ত। মানতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাব ও আস্থার সংকট থেকেই আজকের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। একটি শক্তিশালী সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য যা প্রয়োজন তা তো দীর্ঘকাল থেকেই অনুপস্থিত।
যদি সুস্থ ধারার রাজনীতি বিকশিত করা না যায় এবং এর জন্য রাজনীতিকরা কোনোই দায়বোধ না করেন তবে আমাদের ভবিষ্যৎ যে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে এ আর বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না। দেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে রাজনীতির গুণগত মান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে এই দায়বোধ কতটা উপস্থিত? এ প্রশ্নের জবাব নিহিত আছে বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হলে প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিকদের বড় বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সে রকম প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিকরা কোথায়? মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশে আজ রাজনীতির চিত্র তো এত বিবর্ণ হওয়ার কথা ছিল না।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন