নিষ্ঠুরতার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়
27 August 2014, Wednesday
তখনো এই নিবন্ধকার সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণরত একজন ক্যাডেট। আমাদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষক ছিলেন একজন সুদর্শন চৌকস পাঠান ক্যাপ্টেন। তিনি ক্লাসের শুরুতেই একটি চুটকি গল্প বলে আমাদের মনোযোগ বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিতেন। একদিন প্রত্যুষে আমাদের পাঠ্যবিষয় ছিল 'গ্রেনেড', অস্ত্রটির মেকানিজম ও গ্রেনেডের ব্যবহারবিধি। ক্লাসের শুরুই তাঁর চুটকি গল্প দিয়ে। প্রথমেই তাঁর প্রশ্ন যে আমরা কী করে আত্মরক্ষা করব, যদি একটি গ্রেনেড সেফটিপিন খোলার পর হাত থেকে ফসকে পড়ে যায়? গ্রেডিং সচেতন ক্যাডেটরা যার যার মতো করে তাদের ব্যাখ্যা দিতে থাকল এবং ক্যাপ্টেন ওসমান ক্যাম্পস্টুলে বসে মিট মিট করে হাসতে থাকলেন।
বলা বাহুল্য, ক্যাডেটদের মধ্য থেকে আত্মরক্ষার তাবত পদ্ধতি বেরিয়ে আসতে লাগল। কেউ বলল, আমি তো অকুস্থল থেকে বিপরীতমুখী রাস্তা দিয়ে স্প্রিন্ট করব। কারো মতে, সে নিকটেই পরিত্যক্ত একটি পরিখায় ঢুকে পড়বে। আবার কাউকে দৌড়ঝাঁপ না করে নিকটেই লাইং পজিশন নিতে আগ্রহী মনে হলো। কেউ বা বলল যে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সে কোনো কিছুর, অর্থাৎ কোনো বিল্ডিং বা দেয়ালের অন্তরালে অবস্থান নেবে।
কিছুক্ষণ ধরে ক্যাডেটদের এসব আবোলতাবোল শোনার পর ক্যাপ্টেন ওসমান এবার মুখ খুললেন। বললেন : Once the grenade slipped আউট অব হ্যান্ড, ইউর ফেইট ওয়াজ অলরেডি সিলড্। তারপর আত্মরক্ষার যেকোনো প্রচেষ্টা পাগলামি। একটাই তখন করার থাকে যে How to minimise the damage। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের গ্রেনেড আক্রান্ত নেতা-কর্মীরা তা-ই করেছিলেন। আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দলে তাঁর গুরুত্ব বুঝে তাঁকে ঘিরে মানববর্ম রচনা করেছিলেন দলীয় কর্মীরা। তাতেই শেখ হাসিনা সে যাত্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। আমি তখন ঢাকায় অবস্থানরত এবং টিভি চ্যানেলে ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় বিমূঢ় ছিলাম। আজ দীর্ঘ এক দশক পর যখন ভাবি, তখন মনে হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রশিক্ষিত আওয়ামী লীগ তাদের নেত্রীকে বাঁচাতে যথার্থ কৌশলই গ্রহণ করেছিল, যদিও ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল না।
বিস্ফোরক যেকোনো বস্তুই তো নিশ্চিত প্রাণঘাতী অস্ত্র। কিন্তু প্রচলিত সমর কৌশলের জন্য সমরাঙ্গনে এই গ্রেনেডই সর্বাধিক কার্যকর। তৎকালীন সরকার এবং এই নিষ্ঠুর পদক্ষেপের খলনায়করা সেটা বুঝেই 'একুশে আগস্ট' মঞ্চস্থ করে থাকবে। এখন যখন এই দিবসটি উদ্যাপনে একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে এই নিষ্ঠুর গ্রেনেড হামলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং যুগপৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তাঁর মন্ত্রিসভার কতিপয় মন্ত্রী ও হাওয়া ভবনের কর্ণধার এবং বর্তমানে পলাতক তারেক রহমানকে এই ন্যক্কারজনক এপিসোড্টির সংঘটক বলে শনাক্ত করেন। আমি জানি না, এখনো বিচারাধীন এই হামলার জন্য এটা সঠিক কি না। তবে ক্ষমতাসীন তৎকালীন সরকারের এর সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা থাকবে না তাও অবিশ্বাস্য।
সম্ভবত খালেদা জিয়া এবং এই দুষ্কর্মে তাঁর সহযোগীরা এখন তাঁদের পাপাচারের খেসারত দিচ্ছেন অথবা প্রায়শ্চিত্ত করছেন। যে ক্ষমতায় নিষ্কণ্টক হওয়ার জন্যই তিনি যদি এই বহুল নিন্দিত নিষ্ঠুরতার দিকে পা বাড়িয়ে থাকেন, সেই ক্ষমতার বলয় থেকে আজ তিনি কার্যত নির্বাসিত। পুনরায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আন্দোলন-আন্দোলন খেলা কিছুতেই জমে উঠছে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট আলবৎ একটার পর একটা বাড়াবাড়ি করেই যাচ্ছে এবং তাতে করে জনগণকে আন্দোলনমুখী করারও অনেক ইস্যু থাকছে বা তৈরি হচ্ছে; কিন্তু আজকের সত্তর বছর বয়সী ভগ্নস্বাস্থ্য বিএনপি নেত্রী কিছুতেই তাঁর 'কঠোর আন্দোলনের' ইস্যু বা অনুকূল অবস্থা তাতে খুঁজে পাচ্ছেন না বা তৈরি হচ্ছে না। ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁর কঠোর আন্দোলনের দিনক্ষণ। হয়তো এখনো বিএনপির মাঠকর্মী ও সমর্থকের কমতি নেই। কিন্তু নেতৃত্বের দোদুল্যমানতায় এবং ইস্যু বাছাইয়ে অপরিপক্বতায় হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা করছেন নতুন গন্তব্যের সন্ধান। আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে একসময়ের আপসহীন নেত্রী মনে হয় আজ এক বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় নিপতিত। একুশে আগস্টের কারিগররা যখন একদিন আইনি প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত হবেন এবং সেদিনের অমানবিকতার অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হবে- একটি নতুন মেরুকরণের ভেতর দিয়ে বিএনপি হয়তো একটি চূড়ান্ত অস্তিত্ব-সংকটে পড়বে।
রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টিতে কোনো অসংগতির স্থান নেই। যার যা প্রাপ্য, তা তাকে পেতেই হবে, ইতিবাচক বা নেতিবাচক পথে। শাস্তি প্রদান বা পুরস্কৃত করার তাঁর অজস্র পথ আছে। কোনটা কখন ব্যবহৃত হবে, আমরা সেটা জানি না। আল্লাহ তায়ালা তাদের নবীর অবাধ্যতার কারণে বনি ইসরাইল কওমকে অভিনব শাস্তি দিয়েছিলেন। পর্বতাকীর্ণ এক দুর্গম স্থানে তারা ৪০ বছর ঘুরপাক খেয়েছিল, নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পায়নি। আজ যখন দেখি, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও বিএনপি অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সেটা কিসের সংকেত? অবশ্য এমন পরিণতি যেকোনো দল, গোষ্ঠী বা জোটের জন্যই প্রযোজ্য।
তবে একজন প্রয়াত জিয়াউর রহমানকে খালেদা-হাসিনা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়ানো যৌক্তিক নয়। তিনি একুশে আগস্ট তো দূরের কথা, পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, যদিও তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারি হয়েছিলেন। সেটা তো তাঁর কোনো অপরাধ নয়। তবে আমি মাননীয়া শেখ হাসিনাকেও জিয়াবিদ্বেষের জন্য শতভাগ দোষ দিই না। পিতৃ-প্রাণ কন্যার কাছে নানা রটনাও উষ্মার কারণ ঘটাতে পারে। প্রার্থনা করি, আমাদের রাজনৈতিক পরিসরের নিছক ধারণাগত উক্তি, কটাক্ষ ও দোষারোপের অবসান হোক।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন