আন্দোলনের পূর্বশর্তগুলো আগে জানুন
11 August 2014, Monday
সমরাঙ্গনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থানে, সে সময়ের অবস্থাকে ইংরেজিতে ঊুবনধষষ ঃড় বুবনধষষ রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনের অবস্থাও ঊুবনধষষ ঃড় বুবনধষষ এর অনুরূপ হলেও একটি জুৎসই প্রতিশব্দ খুঁজে না পাওয়ায় নিবন্ধের বর্তমান শিরোনামটিই ব্যবহার করা হলো। আসলে কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যারা বাংলাদেশে পরস্পরের চক্ষুশূল, তারা এখন মনে হচ্ছে যে, একটি চূড়ান্ত বোঝাপড়ার সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিক জনগণ এক্ষুণি এদের এই মরণ খেলা নিবৃত্ত করতে না পারলে যে ক্ষতির সম্ভাবনা তার জন্য আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদেরই দুষবে। রাজনীতির অপর নাম জনকল্যাণ হলেও এ দেশের রাজনীতিতে এই বিষয়টি দৃশ্যত পরিলক্ষিত হলেও মূলত এ থেকে অনেক দূরে অবস্থান আমাদের রাজনীতিকদের। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের রাজনীতিকদের রাজনীতির উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া এবং টিকে থাকার লক্ষ্য। এই পথ তো দেশ-জাতির কল্যাণে নিশ্চিতকরণের পথ নয়।
বলা বাহুল্য, আলোচ্য রাজনৈতিক শক্তি দুটির মধ্যে আসন্ন যুদ্ধে বিএনপি অতি দুর্বল পক্ষ বিধায় তাদের সংঘাত হবে অসম। ঢেউয়ের মধ্যকার একটি অসম রাজনৈতিক যুদ্ধে বিএনপি কোনো সাফল্যের মুখ দেখবে বলে কেউ মনে করেন না। বিএনপির কিছু অন্দর মহলের সঙ্গে আলাপচারিতায় বুঝেছি, তারাও তা বোঝে। কিন্তু রাজনীতিতে নিছক তাদের প্রাসঙ্গিকতা জিইয়ে রাখতে বিএনপি এখন মরিয়া। আরো বুঝেছি যে, এই দুই শক্তির মধ্যে এটাই চূড়ান্ত সংঘাত নয়। বিএনপি ভবিষ্যতে আরো শক্তি সঞ্চয় করে একটি উপযুক্ত সময়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। এমন পরিস্থিতি তাদের জন্য কখন, কীভাবে উদ্ভব হবে এর জবাব দেবে ভবিষ্যৎ। কিন্তু এটা তো সত্য যে, বিএনপির জন্য সেই উপযুক্ত সময় বের করা এত সহজ নয়। তারা সাংগঠনিকভাবে এখন এতটা শক্তিশালী নয়, যতটা শক্তিশালী হওয়া দরকার নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে। তাছাড়া সহিংস পথে যে কোনো আন্দোলন-কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের সায়ও মিলবে বলে মনে হয় না।
অনেকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, হালের আন্দোলন প্রচেষ্টায় বিএনপি শুধু পাথরে মাথা ঠুকবে। যে কোনো সরকারের হাতে থাকে অবদমনের অপরিসীম শক্তি। বর্তমান সরকার তো তার সমর্থকদের মিলিয়ে একটি ভয়ঙ্কর শক্তি। অতীতেও দেখা গেছে যে, এই সরকার বিএনপির আন্দোলনকারীদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়নি। অসংখ্য মামলার জালে আবদ্ধ এবং কারাগারে আটক নেতাকর্মীরা হাল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করেছে। সব মিলিয়ে বিএনপির সামনের পথ জটিল। এই জটিল পথে তারা তাদের মিত্রদেরও সেভাবে চালাতে পারছে না বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া জামায়াত তাদের কাছে ক্রমেই বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে তাদের সখ্য বিএনপির রাজনীতির জন্য কল্যাণ তো নয়ই; বরং ক্ষতির কারণই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তা সত্ত্বেও আন্দোলন হতে পারে যেমনটি আওয়ামী লীগ বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অষ্টম সংসদের সময় করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়টি জুড়ে আওয়ামী লীগ একের পর এক বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছিল। দলটির মধ্যে ছয় দফার আন্দোলন বা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সংগঠকরা রয়েছেন। বিএনপি রাজনীতির বৈশিষ্ট্যগত দিক কখনো ছিল না, এখনো নেই। রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন কোনো আন্দোলনের ফলই ইতিবাচক হতে পারে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অনেক তিক্ত। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা বলা যায় যে, আমরা আবারো এক কঠিন সময়ের ঘূর্ণাবর্তে ঢুকছি।
তাহলে? বিএনপিকে তাহলে নাকে খত দিয়ে আগামী নির্বাচনের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? আমি মনে করি, বিএনপিকে আগে দল গোছাতে হবে, প্রয়োজনে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। সময়ের বিবর্তনে অনেক অদৃশ্য চালিকাশক্তির প্রভাবে তখন বিএনপির আজকের দৈন্যদশা ঘুচলেও ঘুচতে পারে। যেখানে দৃশ্যমান কোনো প্রস্তুতি ছাড়া বিএনপির আন্দোলনের হুঙ্কার শুধু জনগণের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে। এরশাদেরও গণআন্দোলনের হুমকি রয়েছে। এরশাদও আজকাল গণআন্দোলন করতে চান। বুঝুন তাহলে আমরা কোথায় আছি। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আপসহীন মনোভাবের ওপর আন্দোলনের সাফল্য নির্ভরশীল। মাত্র গুটিকতক ত্যাগী নেতাকর্মী ছাড়া বাকিরা প্রাজ্ঞ হলেও মাঠের রাজনীতিবিমুখ। বিলাসী জীবনশৈলী আন্দোলনের সঙ্গে যায় না। লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিতপ্রাণ না হয়ে আধা খিচড়া আন্দোলনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা তো দূরের কথা; বরং তা নিজেদের দুর্বল স্থানের ক্ষতগুলোকেই উšে§াচিত করে। তাই বলব, আন্দোলনের ইতিহাস ঘেঁটে আগে আন্দোলন করার পূর্বশর্তগুলোকে জানুন ও শিখুন। তারপর প্রয়োজনে আন্দোলন করুন। নতুবা একটি আন্দোলনের ফলাফল ব্যর্থ হবে জেনেও নিজেদের এবং জনগণকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? নিকট অতীতেও আন্দোলনের নামে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনা শুধু মর্মন্তুদ নয়; প্রকৃত পক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংজ্ঞাসূত্র সিদ্ধ নয়। দেশ-জাতির সর্বনাশের পথটাই এমন আন্দোলনে প্রশস্ত হয় এবং হয়েছেও তাই। এমন অধ্যায়ে আমরা আর কখনোই প্রবেশ করতে চাই না। রাজনীতিকরা দায়িত্বশীল হলে মঙ্গল।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
(মানব কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন