স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যাবর্তন!
25 June 2014, Wednesday
ক্রিমিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপ ও পশ্চিম ঘেঁষা দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার বিবাদকে আজকাল ১৯৮৯ সালে স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্তির পর সবচেয়ে মারাত্মক পূর্ব-পশ্চিম সংকট বলে অভিহিত করা হচ্ছে। যদি রাশিয়ার প্রচেষ্টায় স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা পুনর্লিখিত হয়, ভবিষ্যতের ইতিহাসবেত্তারা সম্ভবত বিশ্বরাজনীতির এক নতুন প্রভাব থেকে ফিরে তাকাবেন এবং এমন এক বিবর্তনের মূল্যায়ন করবেন।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রাশিয়ার ক্রিমিয়ায় শুধু হস্তক্ষেপ নয়- উপদ্বীপটির দখলকে হিটলারের অস্ট্রিয়া আগ্রাসন ও চেকস্লোভাকিয়ার সুভেটানল্যান্ডকে ১৯৩৮ সালে জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এমন পরিস্থিতিকে একুশ শতকে ইউরোপের সর্ববৃহৎ সংকট বলে আখ্যায়িত করেছেন। ন্যাটোর মহাসচিব রাসমুসেন এটাকে ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ের সর্ববৃহৎ হুমকি বলেছেন।
পশ্চিমা মৈত্রীর এই অসন্তোষ বোধগম্য। বৃহৎ শক্তিপুঞ্জের কেউই এর আগে এমন প্রকাশ্য ও নগ্নভাবে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস করেনি, যেমনটা রাশিয়া ক্রিমিয়াকে তার অন্তর্ভুক্ত করার ভেতর দিয়ে করেছে। এমনকি রাশিয়া জর্জ বুশকে তাঁর 'গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা' জর্জিয়ার ব্যাপারে একচোট নেওয়ায়ও এতটা অসন্তোষ জন্মেনি; কারণ পশ্চিমা মৈত্রী তখন, ২০০৮ সালে, তাতে প্রত্যক্ষভাবে জড়ায়নি। ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিকেও তার গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন।
পুতিন স্পষ্টতই বলেছেন, ক্রিমিয়ায় তাঁর পদক্ষেপ ছিল রাশিয়াকে পশ্চিমা মৈত্রীর পরিবেষ্টন (Containment) নীতির প্রত্যুত্তর। রুশ প্রেসিডেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী পশ্চিমা শক্তি যেভাবে রাশিয়াকে কুখ্যাত পরিবেষ্টন নীতি দিয়ে ঘায়েল করতে চেয়েছিল, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। তারা বিরতিহীনভাবে রাশিয়াকে শক্তিবলয়ের এক কোনায় ঠেলে রাখতে চায়, কেননা আমরা একটি সার্বভৌম অবস্থান থেকে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করতে চাই।
স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যাবর্তন!
পুতিনের কথায় 'সব কিছুরই একটা চূড়ান্ত সীমা আছে' এবং আমরা সেটা মেনে চলি। যে বস্তুটা যেমন, আমরা সেটাকে সেভাবেই দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের পশ্চিমা বন্ধুরা অনেক আগেই সেই নিয়মের গণ্ডি অতিক্রম করেছে।
ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে পুনঃসংযুক্তির এক অনুষ্ঠানে পুতিন এসব উক্তি করেন। ২০০৪ সালের তথাকথিত রঙের বিপ্লব ঘটিয়ে ইউক্রেনেও পশ্চিমা জোট ভব্যতার সীমারেখা অতিক্রম করেছিল। কিন্তু সব কিছুরই একটি সীমারেখা থাকার প্রয়োজন আছে। রুশরা যখন তাদের জাতীয় স্বার্থে আঘাত করার মতো কিছুতে নিজেদের নিপতিত হতে দেখে, তারা তো আর সে অবস্থায় নিজেদের গুটিয়ে নিতে পারে না।
পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া শুধু তাদের ন্যায্য অধিকারকেই সুরক্ষা দেয়নি, তাঁর দেশ যাকে ন্যাটো প্রধান নিয়মের দস্তাবেজ বলেন এবং যা রচনায় জোটের সদস্যরা কয়েক যুগ অতিবাহিত করেছে, তার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হতে অনাগ্রহী, তারা বরং সেটা হওয়াতে চায় সেসব শক্তির 'আইনের' মাধ্যমে। তারা এত দিন শুধু তাদের অভিজাত স্বাতন্ত্র্যের সচেতনতায়ই পরিপক্ব হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী আভিজাত্যবোধ সুদৃঢ় হয়েছে, যা তাদের সর্বক্ষণ সর্বাবস্থায় নির্ভুলতার মনস্তত্ত্ব দিয়েছে।
যেখানে যখন প্রয়োজন, তারা তাদের মতো করেই পরিস্থিতি সামলায়। বিবর্তনের ধারায় রুশ নেতৃত্ব রাশিয়াকে এমন এক স্থানে পৌঁছিয়েছে, যাতে তাদের এখন বিশ্বরাজনীতির অঙ্গনে প্রতিবাদী করে তুলেছে। কেননা পশ্চিমা জোট রুশদের স্বার্থে অবলীলায় আঘাত হানে- রাশিয়া এখন আর পশ্চিমা জোটের এমন আপ্তবাক্য মানতে রাজি নয় যে 'যদি কেউ আমাদের সঙ্গে নেই তার অর্থ এই যে সে আমাদের বিরুদ্ধে।' রাশিয়াসহ বিশ্ব এখন বোঝে যে তাদের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসনের নীতির সপক্ষে তারা বিশ্ব সংস্থায় জুতসই প্রস্তাব গ্রহণ করাতে সক্ষম বিধায় তারা তা নির্বিঘ্নে করে নেয়। সেটা যদি ভেটোসহ অন্য কোনো কারণে কার্যকর না হয়, তাতেও কিছু আসে-যায় না। এতে তো তাদের ক্রুর শক্তির কোনো ঘাটতি হয় না।
সময়ের বিবর্তনে ও ঘটনার তাৎপর্যে বুঝতে বাকি থাকে না যে পশ্চিম রাশিয়ার সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সমতার ভিত্তিতে দাঁড় করাতে অনিচ্ছুক। পক্ষান্তরে তারা মিথ্যাচারসহ প্রতিপক্ষের অজান্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত বলে পুতিন অভিযোগ করেন!
ন্যাটোর পূর্বমুখী বিস্তৃতি ও আমাদের সীমান্তে অস্ত্র মোতায়েন ইত্যাদি ইস্যুতে তারা তা করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার আওতায় আলোচ্য অস্ত্রের স্থান নির্বাচনে রুশ আপত্তি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাপারে নিজস্ব সিদ্ধান্তেই অটল থাকা, ভিসা সমস্যার সমাধানে অব্যাহত মার্কিন অনীহা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা ও বিশ্ববাজারে উন্মুক্ত প্রবেশ ইত্যাদির আলোচনার প্রশ্নে দীর্ঘসূত্রতা পশ্চিমের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে রুশ সংশয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে।
পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্কে বর্তমান সংকট শুধু ইউক্রেনকে ঘিরেই নয়। তবে ইউক্রেন বর্তমান সংকটে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাশিয়ার অবজ্ঞাপূর্ণ বিরোধিতার সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ণীত হবে।
ক্রিমিয়া দখল রাশিয়ার কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত নৌবহরের সমস্যা সমাধান করলেও ইউক্রেনের নতুন নেতৃত্ব তাতে নাখোশ। তারা চেয়েছিল সেভাস্তাপল থেকে রুশ নৌবহর বিতাড়ন করতে। কিন্তু রুশরা ক্রিমিয়া দখলে নিয়ে ওই অঞ্চলে তাদের কৌশলগত (Strategic) অবস্থানকে বরং সংহত করেছে। এখন সেখান থেকে তারা ভূমধ্যসাগর বা তা-ও পেরিয়ে তাদের নৌবহরের মহড়ার শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হওয়া ছাড়া তাদের যুদ্ধবিমান ওই অঞ্চলে সহজে উড়াল দিতে পারবে।
ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ কিন্তু শুরুই হয়নি। পুতিনের সম্ভবত যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনাও নেই। তাঁর মূল দাবি, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হলেই তিনি সন্তুষ্ট। এখানে পুতিনের আরেক কৌশলী দাবি ইউক্রেনকে ইউনিটারি থেকে ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোয় নিয়ে আসা। এতে ইউক্রেনের রুশ সমর্থক দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার ভেটো প্রয়োগ শক্তি কিয়েভের বৈদেশিক নীতির সিদ্ধান্ত, যথা ন্যাটোর আওতায় যাওয়া না যাওয়া প্রভাবান্বিত করতে পারবে। তাতে ইউক্রেনের রাশিয়ার বৃত্তবলয়ে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
ক্রিমিয়া ছিল পুতিনের তুরুপের তাস। তিনি সেটা ভালোই খেলেছেন। রুশ পার্লামেন্ট থেকে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত পুতিন সংগতভাবেই ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছেন রুশ জাতিসত্তাকে সুরক্ষা দিতে। কিন্তু ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে যেকোনো উদ্দেশ্যে সৈন্য প্রেরণ সম্ভবত কোনো নিরাপদ অপশন নয়। কেননা এতে অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে সামরিক সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।
পুতিনের অবশ্য ইউক্রেনে ফেডারেলিজম এজেন্ডা বাস্তবায়নের একাধিক সুযোগ আছে। মস্কো এ কথা স্পষ্ট করেছে, রাশিয়া ইতিমধ্যেই ১৫ বিলিয়ন ডলারের এইড প্যাকেজ, যা পুতিন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সরকারকে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, সেটা মুলতবি হয়েছে এবং বিপুল ডিসকাউন্ট, যা তিনি ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহের জন্য দিতে চেয়েছিলেন, সেটাও এখন বাতিলের আশঙ্কায় রয়েছে।
ইউক্রেন সংকট আর যাই হোক, এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কাকে উসকে দিয়েছে রাশিয়া ও পশ্চিমা মৈত্রীর মধ্যে। কিন্তু পুতিনের হিসাব-নিকাশে এটি একটি অসম্ভব দৃশ্যপট। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা স্বতন্ত্র। পুতিনের রাশিয়া তো নিবিড়ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত। আজকের রাশিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তৃতীয় বৃহত্তম ট্রেডিং পার্টনার এবং রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ ইউরোপের ৮০ শতাংশ চাহিদা মেটায়। যুক্তরাষ্ট্রেরও খুব প্রয়োজন রুশ সহযোগিতা; যদি তাকে সিরিয়া, ইরান বা আফগানিস্তানের সমস্যাগুলোর নিষ্পত্তি করতে হয়।
রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত চাপ দেশটিকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে। তখন সত্যি সত্যিই একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তব রূপ নেবে। এখনকার মতো ইউক্রেন সংকটের সুযোগ নিয়ে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের ভেতর দিয়ে দেশটির ভূমধ্যসাগরের প্রবেশপথ লাভ একটি বিরাট স্ট্র্যাটেজিক বিজয়।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
(কালের কন্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন