জননিরাপত্তা যেসব কারণে প্রশ্নবিদ্ধ
27 May 2014, Tuesday
বাংলাদেশের রাজনীতি কদাচিৎ সরলপথে চলেছে। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ে এই রাজনীতি এখন রূপ পরিগ্রহ করেছে তাকে দানবীয় বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের চিরাচরিত ‘লেফট-রাইট’ মেনেই আমরা নিজেদের অজান্তে এমন দানবীয় রূপ ধারণ করেছি। যে জাতির অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার ঘাতকরা লুকিয়ে থাকতে পারে সেখানে সাত খুন এমন আর কি, যদিও আতঙ্কে শুধু শীতলক্ষ্যা বিধৌত নারায়ণগঞ্জ নয়, সব অঞ্চলের জনগণ তটস্থ। ফেনী, লক্ষ্মীপুর সর্বত্রই তো চিত্র প্রায় এক।
আমাদের রাজনীতিতে এত বাঁক এবং রাজনীতির চাইতে এক হাত দেখিয়ে নেয়ার প্রবণতা এত প্রকট, এর ফলে কেউ জানে না যে কখন কি ঘটবে। দেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যও নেই। একদল যদি নির্বুদ্ধিতায় প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়, অন্যটি ছলেবলে কৌশলে, এমনকি অঙ্গ-সংগঠনের সদস্যদের ভাড়া খাটিয়ে ওপরে উঠে যায়। এই মুহূর্তের সমস্যা ১৬ কোটি মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তি নিরাপত্তা। বিবেকহীন প্রতিপক্ষের কাছে যে কেউ দুর্বল, ভীত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই এখানে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মানবিকতা বোধ, একজনের অপহরণ বা খুনের ক্ষেত্রে সহমর্মিতা বোধ। শুধু এলোপাতাড়ি বিক্ষোভ, মিছিল ও বক্তৃতায় কি চিঁড়ে ভিজবে! দেশে আইন আছে, আদালত আছে গোটা ব্যাপারটিকে আইনি প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। এ দেশে এত বেশি অপরাধ দায়িত্বশীলদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে যে সরকার, বিরোধী দল ও বিশিষ্টজনরা বিভ্রান্ত। তারা জানে না যে, এমন জটিল সমস্যার সমাধান সূত্র কোথা থেকে এবং কীভাবে শুরু করতে হবে। শুধু তাই নয়, মোটামুটি সহজ সংকটগুলো পেছনে ফেলে দেশের ঘটনাপ্রবাহ এখন আরো জটিলতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সমাজ ও তার গ্রন্থি, নীতির প্রশ্নে কাঠিন্য এবং সমাজে দ্বিধাবিভাজন-এসব কিছুরই সমাধান আরো অসম্ভব হবে। সমস্যা শুধু গুম-অপহরণেরই নয়, তা ছাড়াও আছে ছাত্রলীগের ব্যবসায়ী আটক করে ছিনতাই। হাসপাতালে চিকিৎসায় ইন্টার্নদের কর্মবিরতিতে অচলাবস্থা। যারা নিত্য দুর্ভাগ্যের শিকার তাদের প্রাপ্তি শুধু সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস বাণীতেই! ব্যস, ওই পর্যন্তই। শোনা যাচ্ছে আরো অবাক অবাক কথা। গণজাগরণ মঞ্চে যার সঙ্গে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন তা নাকি ভেঙে গেছে। তরুণ মনস্তত্ত্বে যাদের মন্ত্র এতটা জায়গা করে নিয়েছিল, তাদের এখন কোথায় জায়গা হবে? তারা তো কোনো না কোনো অবয়বে অস্তিত্বে থেকেই যাচ্ছে। এখন তাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান কি হবে? আরো কৌতুকপ্রদ খবর এই যে, জামায়াত নাকি বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হতে চলেছে। তাহলে এই একীভূত সংগঠনের আদর্শ কি হবে? সামনে আমাদের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। না ঘটেই বা উপায় কি? মারমুখো সুসংগঠিত জামায়াত-শিবির যে কোনো প্রতিপক্ষ দলের জন্য সংকট সৃষ্টি করবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারেরই বা কি হতে যাচ্ছে? এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব তো শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। সব মিলিয়ে রাজনীতির পথ পিচ্ছিলই থেকে যাচ্ছে এবং এই পিচ্ছিলতা থেকে সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে বহুবিধ। অর্থাৎ সব সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে বিদ্যমান অশোভন রাজনীতি থেকেই।
এমন এক প্রেক্ষিতের বিপরীতে দেশের আইনশৃঙ্খলায় খুব একটা কিছু এদিক-সেদিক হবে তা মনে হয় না। মনে হয় না দেশের সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি সামগ্রিক সমস্যার সমাধানে কোনো ঐকমত্য গড়তে পারবে। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এটাই অত্যন্ত জরুরি। দেশের জননিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে সঙ্গত কারণেই বিদ্যমান রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনীতি অবশ্যই অপরিহার্য এবং রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন সে রাজনীতি? নিশ্চয়ই যে রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি এমন রাজনীতি নয়। আজকের বাংলাদেশে সৃষ্ট সব ক্ষত কিন্তু বিদ্যমান সংজ্ঞাহীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটজাত। রাজনীতি শ্রী হারিয়ে এখন তা জনগণের অকল্যাণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাজনীতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কীভাবে অপরাজনীতির জটাজাল ছিন্ন করে গণমুখী রাজনীতির স্রোত বেগবান করা যাবে এ বিষয়টি যাদের ভাবার কথা তারা এ ব্যাপারে যতটা মুখে বলেন বাস্তবে করেন এর উল্টোটা। অপরাজনীতির ধারা থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে বহুবিধ সামাজিক দুষ্কর্ম কিংবা অপরাধ। ‘সন্ত্রাসীরা কোনো দলের নয়’-এ কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বহুবার বলেছেন, আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সনও বহুবার বলেছেন। কিন্তু তাদের এই বলা যে কতটা অসার বিদ্যমান বাস্তবতাই এর সাক্ষ্যবহ। কিন্তু এর চূড়ান্ত পরিণতি ক্রমেই কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে তা কি তারা ভাবছেন যেমন করে প্রকৃতই ভাবা উচিত? বাংলাদেশের বিদ্যমান বিবর্ণ রাজনীতির চিত্র উজ্জ্বল করতে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সবাই দৃশ্যত গুরুত্বারোপ করলেও গোড়ায় যে গলদ রয়েছে অফুরন্ত তাও কিন্তু তারা জানেন। এ থেকে পরিত্রাণের পথ সন্ধান না করলে ভবিষ্যৎ যে আরো বেশি কণ্টকাকীর্ণ হবে তাও তাদের অজানা নয়। প্রকৃত কথা হলো, বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই সব গলদ নিহিত। কাজেই ব্যবস্থার বদল না করে অবস্থার বদল করাটা মোটেই সহজসাধ্য কোনো বিষয় নয় এবং তা সম্ভবও নয়। এই যে দেশে মানুষ চরম আতঙ্কে ভুগছেন, কে কখন অপহরণ-গুম-খুন হয়ে যান এ নিয়ে তটস্থ। কিন্তু পারস্পরিক দোষারূপের রাজনীতি এর পরও রয়েছে অত্যন্ত বেগবান। কাদা ছোড়াছুড়ির এই খেলা থেকে আশকারা পাচ্ছে জননিরাপত্তা কিংবা জনস্বার্থ হরণকারী অপশক্তি। তাদের শক্তির অন্যতম শক্তিটা কিন্তু এখানেই নিহিত।
রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি জাতীয় জীবনে শান্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তির সব আকাক্সক্ষা বিনাশ করছে। ‘ব্লেইস গেইম’-এর রাজনীতি আর যাই হোক কোনোভাবেই যে স্বস্তি ও শান্তির পথ সুগম করবে না তা তো নিশ্চিত করেই বলা যায়। গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান নির্দেশিত কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে যেগুলো প্রতিষ্ঠার পর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বের বাইরে স্বাধীনভাবে নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করার এখতিয়ার লাভ করে। এমন প্রতিষ্ঠান আমাদেরও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা-স্বাধীনতা কার্যক্ষেত্রে কতটা প্রতিফলিত করতে পারছে? নিশ্চয়ই জবাবটা প্রীতিকর নয় এবং সচেতন মানুষ মাত্রই এসব প্রশ্নের জবাব জানেন। আমাদের নির্বাচন কমিশন ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে আমাদের হতাশ ও উদ্বেগান্বিত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এ যাবৎকালের কার্যকারণ দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, ভারতের নির্বাচন কমিশন নিজের প্রতি যেমন আস্থাশীল তেমনি কর্তব্যও অবিচল। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে এমন একটি সমাজ-মানস ও রাজনৈতিক আবহ সেখানে তৈরি হয়েছে যাতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে সবাই সচেষ্ট। আর এ কারণেই রাজনীতির পথও সেখানে অনেকটাই হয়েছে মসৃণ। কিন্তু আমরা কি এ পথ অনুসরণ করতে পারি না? আমদানিনির্ভর এ দেশে তো নিত্যই অনেক কিছু আমদানি করতে হচ্ছে। সুচিন্তাটা আমদানি করার কথা এবার হয়তো ভাবা খুব প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
(মানবকণ্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন