এর শেষটা কোথায় কেউ কি বলবেন?
11 May 2014, Sunday
একটি জনপদ ক্ষোভে-দুঃখে-প্রতিহিংসা-স্পৃহায় যখন একই সঙ্গে ভয়, আতঙ্ক ও লজ্জায় সন্তর্পণে মুখ লুকায় তা কি তখনো কোনো ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু বা ব্যাপার থাকে? সম্প্রতি সংঘটিত নারায়ণগঞ্জ এপিসোডকে বুঝতে হলে দেশের রাজনীতি, সমাজ ও মনস্তাত্ত্বিক যে পরিবর্তনগুলো দ্রুত বহমান সময়ের প্রবাহে ঘটে চলেছে, কতিপয় মানুষের মধ্যে যে নৈতিক স্খলন ও ব্যাপক অবক্ষয় বাসা বেঁধেছে তা না বুঝে উপায় নেই। আলোচ্য অপহরণ ও হত্যা আমার-আপনার সবার কাছেই চাঞ্চল্যকর। অর্থের মোহ, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাও আবার র্যাবের মতো পরীক্ষিত সৈনিকদের ছুড়ে দেয়া টোপ গলাধকরণ খেলতামাশা মাত্র নয়। কোনো কোনো পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে যে, র্যাবেরই একজন সদস্য চট্টগ্রামে পটিয়ার দরবার শরিফ থেকে লুণ্ঠিত অর্থ গলাধকরণ করতে না পেরে পলাতক হন। শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি কী হয়েছিল আমার মনে নেই।
তার পরও এখনো কোনো কোনো র্যাব সদস্য এমন টোপ গিলতে প্রবৃত্ত হন বিদ্যমান চিত্র এ সাক্ষ্যই বহন করছে। তাদের বিরুদ্ধে এখন আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বা কিছু না কিছু একটা হবে। সেনাবাহিনীতে যখন চাকরি শুরু করেছিলাম সাকল্য বেতন ছিল তিনশ’ টাকা। একজন যুবা অফিসারের সব ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। তবু এই মুহূর্তেই তার জন্য কোটি টাকার প্রয়োজন কেন হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা ও বন্দরনগরীর আকর্ষণ কি শুধু হত্যাপণ বা মুক্তিপণ বাবদ কোটি কোটি টাকা রোজগার!
এই যে হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ হওয়ার রীতিতে গড়ে ওঠা সমাজ তা টিকতে পারে না। কোনো না কোনো পর্যায়ে তা বিস্ফোরিত হবেই। ছোট্ট সংবাদ যে, এই হত্যা-অপহরণ-এপিসোডে সরকার বিব্রত। কিন্তু বিব্রত হওয়াই কি যথেষ্ট? আমরা সত্বরই ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে পরিণত হতে চলেছি এমন আশাবাদ অহরহ ব্যক্ত হয়। কিন্তু সেসব দেশের ঐতিহ্যকে আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছি। দেশের আজকের যে পরিস্থিতি তা হঠাৎ করে কিংবা একদিনে হয়নি। এর পশ্চাৎকারণ বহুবিধ এবং ব্যাপক। তিলে তিলে যখন এমন ঘটতে ঘটতে আজ তালে পরিণত হলো, এর আগেই তো উপশম করা যেত।
যখন অপহৃতদের পেট ফুটো করে তাদের অঙ্গে ইট বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, এই নৃশংসতার প্রতিবাদে অন্তত এক বা দু’জন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে পারতেন। অপহৃতদের হত্যার সময় তাদের দীর্ঘশ্বাসের একটি প্রচণ্ড শক্তি আছে। এই দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে নিতে যেতে পারে হীনবল ইয়াবাসেবী হন্তারকদের সাত মহলা। বিস্ময় লাগে যে, এত কিছুর পরও যে আমাদের দায়িত্বশীলদের সম্বিত ফিরতে চায় না সহজে! ছয় কোটি টাকায় যেখানকার সাত সাতটি প্রাণভোমরা তিলে তিলে নিঃশেষ হয় তা একদিন তাদের ত্যাগের তীর্থস্থানে পরিণত হবে। এভাবে মনুষ্যদেহ কারো পৈশাচিকতায়-নৃশংসতায়-বর্বরতায় নিথর হয়ে যেতে পারে না। এভাবে মানুষ অমানুষদের ছোবলে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে পারে না। এভাবে এক একটি ঘটনা ঘটবে আর কিছু দিন হৈচৈ হবে, তারপর সব থেমে যেতে পারে না। এভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটবে আর তার পরও গণতন্ত্র ও উন্নয়ন-উন্নতির ফিরিস্তি দিয়ে সাফাই গেয়ে সাফল্যের ঢাক-ঢোলে পেটানো হবে তা হতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জের বীভৎস-পৈশাচিক-নৃশংস ঘটনাটি আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কতিপয় মানুষ নামধারী বন্যজন্তুসমরা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কাদের আশীর্বাদে-সাহায্য-সহযোগিতা-অনুপ্রেরণায় কিংবা লাভালাভের হিসাবে ওরা এত অদম্য হয়ে উঠল, সমাজ-দেহে ক্ষতের পর ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে তা নির্ণয়ে সর্বাগ্রে উৎসমূলে হাত দেয়া খুবই দরকার। অথচ এই জরুরি কাজটিই এখানে হয় না। কখনো হবে কি-না তা একেবারেই ভবিতব্য। সাত খুনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। জানা গেছে কীভাবে খুন করেছে ঘাতকরা। লাশ ডোবাতে ব্যবহার করা হয় নাকি রেশনের বস্তা। পত্র-পত্রিকায় নিত্য ফুটে উঠছে ঘটনাত্তোর একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিচিত্র। এই প্রতিচিত্রগুলো একের পর এক দাঁড় করাচ্ছে প্রশ্নও। আমরা জানি না উত্থাপিত এসব প্রশ্নের কোনো কূল-কিনারা হবে কি-না কিংবা যদি হয়ও তাহলে তা হবে কবে?
বিদ্যমান পরিস্থিতি এ প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে, রাষ্ট্রের শাসনের সমান্তরালে কি ভয়ের শাসন দাঁড়িয়ে গেল? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভয়ের শাসনের চলতি কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ। অন্যান্য জনপদেও যে সরকার ও প্রশাসনের নানামুখী ব্যর্থতার কারণে আতঙ্ক জেঁকে বসবে না এর নিশ্চয়তা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত এক সপ্তাহে গুম-অপহরণ-খুনের আরো ঘটনা ঘটেছে। এসবের শেষ কোথায় কে জানে। দস্যুদের প্রায় লাগাতার অপকাণ্ডে এই রক্তøাত স্বপ্নের সোনার বাংলা ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে অন্ধকারের দিকে। আমরা এমনো দেখেছি যে, এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর প্রতিকার চিত্র হওয়ার কথা ছিল দৃষ্টান্তযোগ্য। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তা হয়নি। যেসব ঘটনার প্রতিকারে বিলম্ব ব্যতিরেকে দৃষ্টান্তযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠ হওয়ার কথা থাকলেও এর ব্যত্যয় ঘটেছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণে এ রকম অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া দুরূহ। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কারণেই কি দস্যুতন্ত্র আজ বাংলাদেশের সমাজ-দেহে থর থর কাঁপন ধরিয়েছে? শুধু সন্ত্রাসই নয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসার চিত্রও শান্তিপ্রিয় মানুষদের অধিকতর সন্ত্রস্ত করে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জ যেন খণ্ডিত ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রস্ত জনপদ। নারায়ণগঞ্জের ঘরে ঘরে কি সৃষ্টি হচ্ছে গডফাদার? যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন আরো খণ্ডিত সন্ত্রস্ত জনপদের সৃষ্টি হবে এবং এসব খণ্ড খণ্ড সন্ত্রস্ত জনপদ অখণ্ড বাংলাদেশকে চূড়ান্তভাবে ফেলে দেবে এক কঠিন ভয়াবহতার মধ্যে, যা থেকে উত্তরণ এক সময় খুব দুরূহ হয়ে পড়বে। এমনটি তো কোনোভাবেই কাম্য কিংবা প্রত্যাশিত হতে পারে না। এমনটি যাতে কোনোভাবেই না হতে পারে কিংবা এর কোনোই অবকাশ সৃষ্টি হতে না পারে তা নিশ্চিতকল্পে সরকারকে বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে এখনো সময় আছে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে এক মন্ত্রীপুত্রের দিকেও। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সবাই নাকি রয়েছেন কঠিন নজরদারিতে। কিন্তু বিষয়টি যেন শেষ পর্যন্ত ‘বজ আঁটুনি ফস্কা গেড়ো’র মতো হয়ে না দাঁড়ায় তাও নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রশক্তিরই। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তো বহু ক্ষেত্রেই নয় প্রীতিকর। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থায় অনেক ভালো মানুষের মাঝখানে দু’চারজন খারাপ লোক থাকতে পারে। এই দু’চারজনের দায় কেন গোটা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের অন্য সদস্যরা নেবেন? এই কীটদের বয়কট করাই তো উপযুক্ত কাজ। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে তা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই জরুরি কাজটিই অনেক সময় থেকে গেছে বড় বেশি অবহেলিত কিংবা উপেক্ষার চাদরমোড়া। এক একটি ঘটনা ঘটেছে আর ঘটনার হোতারা প্রভাব ও ক্ষমতার জোরে অতীতে পার পেয়ে গেছে বলেই বিষবৃক্ষের ডালপালা এত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সব কিছুরই তো একটা শেষ আছে। এই শেষটা দেখব কবে?
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন