এত আতঙ্ক নিয়ে মানুষের দিন গুজরানের তো কথা নয়
07 May 2014, Wednesday
জননিরাপত্তা কীভাবে এবং কতটা ভেঙে পড়েছে বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে এটি এখন একমাত্র মুখ্য প্রশ্ন। দেশে এখন প্রধান আতঙ্ক অপহরণ-খুন-গুমের। আরো বলা যায় যে, অনেক নির্বাচনী সহিংসতার পর এ দেশের আতঙ্ক এখন অপহরণ-গুম এবং এসব ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা জনআতঙ্ক চরম পর্যায়ে নিয়ে ঠেকিয়েছে। শুধু মাঝে-মধ্যে এমন সব অপহৃতকে নিয়ে বাড়তি উৎকণ্ঠা; বিশেষ অবস্থানে বা বিসদৃশ স্থানে যখন এমন অপহৃতদের লাশ পাওয়া গেল, তখন শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন দাঁড়ায়। অপহরণ-খুন-গুমের যে উন্মাদনা শুরু হয়েছে তা থামার যেন কোনোই লক্ষণ নেই। এর মধ্যে আইনি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা ও সরকারের উদাসীনতা পরিস্থিতি আরো প্রকট করে তুলেছে। উল্লেখ্য, ক’বছর আগে সিলেটের রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী এই ঢাকায় তার গাড়ি চালকসহ গুম হয়েছিলেন। বিষয়টি এমনকি গণভবন পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আশ্বাস প্রদান সত্ত্বেও কোনো কূল কিনারা হয়নি। আজো কেউ জানাল না ইলিয়াস আলী এত কিছুর পর আদৌ বেঁচে আছেন কি-না। বেঁচে আছেন কি-না খ্যাত বা অখ্যাত আরো অনেক অপহৃত। আজ তারা কোথায় কীভাবে আছেন এ সবই যেন অন্তহীন প্রশ্ন।
এই দেশটাকে আজো আমরা বাসযোগ্য ভাবতে পারলাম না। যতই সুন্দর-সুরভিত মনে হোক না কেন এরই মধ্যে রয়েছে মারাত্মক অপরাধী, ঘাতক ও পিশাচ। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে ক্ষুদ্র আয়তনের পরিচিত এই দেশটিকে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও অশরীরী কোনো অপশক্তি আমাদের ধাওয়া করে ফিরছে। এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে সেখানেই আমাদের অস্বস্তি। সর্বত্র যেন কোনো প্রেতাত্মারা আমাদের ঘিরে রেখেছে। এই ব্যূহকে ভেদ করে আমরা বেরুতে পারিনি। কি দুর্ভাগ্য! গণমাধ্যমে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর অভিযুক্ত একজনের বাড়িতে সাত দিন পর পুলিশ অভিযান চালিয়েছে এবং সেখান থেকে রক্তমাখা মাইক্রোবাস উদ্ধারসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের বাড়িতে অবশেষে ৩ মে ২০১৪ তারিখে অভিযান চালাল পুলিশ। অভিযোগ দায়েরের এত পর কেন অভিযুক্তের বাড়িতে অভিযান চালানো হলো এটি তো সময় এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন। যে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, যাকে একটি হত্যা মামলায় অন্যতম আসামি করে অভিযোগ দায়ের হলো তার বাড়িতে এত বিলম্বে কেন পুলিশ হানা দিল এই একটি প্রশ্ন আরো অনেক প্রশ্নই দাঁড় করিয়েছে। এই নূর হোসেন সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্যচিত্র ইতোমধ্যে ফুটে উঠেছে তাতে প্রতীয়মান হয় সে যেন আরেক সেই এরশাদ শিকদার। সারা দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে যে জনআতঙ্ক দেখা দিয়েছে এবং অব্যাহতভাবে একের পর এক খুন-গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে এর পরও যে সরকার ও প্রশাসনের সম্বিত ফেরেনি কিংবা ফিরছে না তা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম কথা বলছেন যেসব কথা আমলে না নেয়ার মতো নয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর নির্দেশ দানের পর পরও অনেক ক্ষেত্রেই জিইয়ে আছে বিবর্ণ, প্রশ্নবোধ, উদ্বেগজনক চিহ্ন! কেন? তাহলে সাধারণ মানুষের গত্যন্তরটা কি? বিগত সাত দিনে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপহরণ ও খুনের আরো ঘটনা ঘটেছে। কোথায় যাচ্ছে দেশ?
জননিরাপত্তার বিষয়টি যে কোনো বিবেচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ নিয়ে এক ধরনের উদাসীনতা কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কর্তব্য কাজে যথেষ্ট গাফিলতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমন অভিযোগও আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি সংস্থার কোনো কোনো সদস্য বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে জোড়ালোভাবে। এসব বিষয়ই চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। সাধারণ মানুষ প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুললেও কোনো প্রশ্নেরই সদুত্তর মিলছে না। এত কিছুর পরও রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা সেই যে পুরনো পরস্পরকে দোষারোপের ধারা তা-ই অব্যাহত আছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে সমাজবিরোধী অপশক্তি। কিন্তু যত কথাই বলা হোক না কেন সরকার কোনো কিছুরই দায় এড়াতে পারে না। এই দেশটাতে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে মানুষের দিন গুজরানের কথা নয়। কারণ, সব অশুভর বিরুদ্ধে মানুষ বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে এবং এরপর রাষ্ট্রশক্তির তরফে যথাযথ প্রতিকার ও সুস্থ সমাজব্যবস্থার, নিরাপদ জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারবার অঙ্গীকারও ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এতসব অঙ্গীকারের পর ব্যর্থতার চিত্র ক্রমেই প্রকট হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে গত্যন্তরহীন। এমন চিত্র তো কোনোভাবেই একটি সুস্থ সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে না। কার বা কাদের ব্যর্থতায় এমনটি হলো এর জবাব সর্বপ্রথম দিতে হবে সরকারকে। কোনোভাবেই সরকারের এই দায় এড়ানোর পথ নেই। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও এসব বিষয়ে দায়িত্ব এড়ানোর অবকাশ নেই।
দুর্বৃত্তদের দুঃসাহস কেন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে? একটা কথা রাষ্ট্র পরিচালকদের মনে রাখা উচিত, দুর্বৃত্তদের ক্রমাগত দুর্বৃত্তপনায় কিংবা উপর্যুপরি অপহরণ-খুন-গুমের কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ-উদ্বেগ-হতাশা শুধু ভুক্তভোগী ব্যক্তি কিংবা পরিবারের মধ্যে আজ আর সীমাবদ্ধ নেই। নিরাপত্তাজনিত এই আতঙ্ক জনমনে চরম বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং একই সঙ্গে দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা-উন্নয়ন-অগ্রগতি-অগ্রযাত্রার সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। একের পর এক মর্মন্তুদ-উদ্বেগজনক-আতঙ্কের ঘটনা ঘটছে কিন্তু অপরাধীদের খোঁজ নেই, নেই তদন্তের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি। কিন্তু থেমে নেই একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সেই পুরনো খেলা। এই সমাজে মানুষ নামধারী কতিপয় দানবের পশু মনোবৃত্তি উদ্বেগজনক হারে প্রকট হয়ে উঠছে এবং এর প্রতিকারে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাও বড় বেশি বিস্ময়কর। আইন যে তার নিজস্ব পথে চলতে পারছে না এর দৃষ্টান্ত অহরহ তৈরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এসব নির্দেশ বাস্তবায়নের দায় যাদের তাদের কর্মকাণ্ড এখনো অনুজ্জ্বল, তাদের অনেক কিছু ব্যর্থতার চাদরে মোড়া। এর কারণ হয়তো এটিই যে, প্রশাসনের ভেতরেও রাজনীতির নামে অপরাজনীতির ডালপালা বিস্তার লাভ করে চলেছে এবং অসাধুরা এরই সুযোগ নিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেই! একজন প্রতিমন্ত্রী দিয়ে কি এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয় চালাতে পারে? ক্ষমতাসীন মহলের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তিও কি নেই যে, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কঠোরতা, যোগ্যতার ভিত্তিতে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে জনমনে স্বস্তি এনে দিতে পারেন? বিগত বহু বছরে এমন একজন উপযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমরা পাইনি কেন? অথচ রাজনীতি আছে, রাজনীতিকরা আছেন নেই শুধু যোগ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!
এ দেশের পরিসর যতই ক্ষুদ্র হোক এখানে জীবনযাপন এত সহজ নয়। কত না সমস্যার ‘সাত পাকে’ আমরা বাঁধা পড়ে আছি। এমনই এক সমস্যা ইদানীং গুম-খুন-অপহরণ। এসব সংক্রান্ত তদন্ত কিংবা মামলার অগ্রগতি নেই। সবই দেখা হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন নয়। সরকারের দায়িত্বশীলরা বরাবরের মতোই গৎবাঁধা কথা বলে দায়িত্ব সম্পন্ন করতে চাইছেন। মানুষ এত বিরক্তিকর কথা তো আর শুনতে চায় না। মানুষ চায় নিরাপদ জীবনযাপন। সাধারণ মানুষ রাজনীতির এত মারপ্যাঁচ না বুঝলেও তারা এটি বুঝতে পারছে বিদ্যমান পরিস্থিতি তাদের চরম অস্বস্তিতে রেখেছে। নারায়ণগঞ্জ আতঙ্কের জনপদ হলো প্রশাসনিক ব্যর্থতার এবং কতিপয় রাজনীতিকের দেউলিয়াত্বের কারণে। দেশের প্রায় সর্বত্রই একই অবস্থা। তবুও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে সরকার যেন একটু সজাগ হয়েছে বিলম্বে। শুধু গুম-অপহরণই নয়, নানা রকম অপরাধ নতুন করে ডালাপালা মেলেছে। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের শাসনামলেও এমন একটি ‘সময়’ এসেছিল। ফলে নৈতিকতা স্খলনে তারা ক্লেদাক্ত হয়ে মসনদ ছেড়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার একটি আধুনিক বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তারই মধ্যে আওয়ামী লীগের পরিত্রাণ খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অধুনা এ দেশের ইংরেজ সাহিত্যের একজন এমিরিটাস অধ্যাপকের লেখা পড়েছিলাম এসব বিষয়ে। একে তো এ দেশে রাজনীতিতে মাত্র দুটি প্রধান দলের মধ্যে আদর্শের প্রতিযোগিতা নেই। এ কারণে আমরা ঘুরপাক খেতে খেতে কঠিন স্থানে পৌঁছব হয়তো অচিরেই। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। দু’দলের জন্য পথ দুটিই : আদর্শের ধারণ ও তার প্রতিযোগিতা। কিন্তু তা কি কখনো এই দেশে হবে না? মানুষ আর পারছে না। মানুষ কি করবে বলুন?
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
(মানবকণ্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন