মাঝে মাঝেই যাদের সাথে কাজে কিম্বা অকাজে যোগাযোগ করতে হতো তাদের নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর একটা মোটা ডায়রিতে লিখে রাখতাম। ব্যক্তিগত ও বিবিসির কাজে যোগাযোগ তো অনেকের সাথেই করতে হতো। তাই বেশ মোটা হয়ে উঠেছিল ডায়রিটা। বিবিসির চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি একুশ-বাইশ বছর। এখন টেলিফোন করা অনেক কমে গেছে। চিঠি লেখার ফ্যাশন তো চলেই গেছে বলা চলে। ডায়রিটা অতো ঘন ঘন খোলা হয় না। তবু খুললেই মন খারাপ হয়ে যায়। যাদের সাথে আগে নিয়মিত যোগাযোগ হতো, কাজের কথা কিংবা নিছক হাস্য-পরিহাস হতো, তাদের অনেকেই পরপারে চলে গেছেন এখন। প্রায়ই কারো চলে যাওয়ার খবর শুনি। স্বভাবতই ডায়রির পাতায় তার নামটা কেটে দিতে হয়। কি জানি কোন দিন ভুলে টেলিফোন করে মৃত কারো পরিবারকে ব্যথা দেই। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে ডায়রিটা খুললে কাটাকুটিগুলোই দেখতে হয় বেশি। হঠাৎ হয়তো কাউকে টেলিফোন করে দুদণ্ড গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এমন কারো নাম সহজে মনে পড়ে না, যিনি আজো বেঁচে আছেন। ডায়রির পাতা বন্ধ করে নানা চিন্তায় ডুবে যায় মন।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর কর্মক্ষেত্রের বন্ধুদের অনেকেই চলে গেছেন। বাংলাদেশের পত্রিকায় পড়ি ৫৬ বছর বয়েসে ‘বার্ধক্যজনিত রোগে’ মৃত্যু হয়েছে কারো। বার্ধক্য কোন বয়সে আসে সংজ্ঞা অনির্দিষ্ট, তবে বয়স আমারো হয়েছে, কবে বার্ধক্য ও ডাক আসবে কে জানে? জীবনের এ সময়টায় ফেলে আসা বছর ও যুগগুলোর খতিয়ান করার তাগিদ মনে আসে। বিগত কিছু দিন শুধুই মনে হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে মানুষ করার যে দায়িত্ব আমাদের প্রজন্মগুলোর ছিল, সে দায়িত্ব সম্ভবত আমরা সঠিকভাবে পালন করিনি। তা না হলে কেন এমনটা হলো সমাজের অবস্থা?
বিশ্বব্যাপী বিরাট বিরাট ঘটনা ঘটছে- অমানবিক সেসব ঘটনা। গত ক’দিনের হিসাবই দেখুন। জার্মানউইং বিমানের পাইলট দেড় শ’জন যাত্রী নিয়ে আত্মহত্যা করল, যে যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তার হাতে। কেনিয়ায় আশ শাবাবরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হানা দিয়ে ১৪৮ জন ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করেছে। জখম করেছে ৭৯ জনকে। সিরিয়ার তথাকথিত ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসীরা গলা কেটে জিম্মিদের হত্যা করছে, ইরাকের সুন্নিপ্রধান কয়েকটি শহর এরা দখল করে নিয়েছিল বহু সুন্নি রক্তের বিনিময়ে। অথচ তাদের দলে যোগ দেয়ার জন্য কোলের শিশুকে নিয়ে ব্রিটিশ মুসলিম নারীও ইসলামিক স্টেটদের দলে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছে। ইরাকে শিয়া ও সুন্নিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের দখলি শহরগুলো থেকে ইসলামিক স্টেট লড়াকুদের হঠানোর জন্য যুদ্ধ করছে। ইরানের শিয়া মিলিশিয়ারাও লড়ছে তাদের সাথে।
মুসলিম বিশ্বের উন্মাদ তোলপাড়
ওদিকে ইয়েমেনে হানাদার হুথি শিয়া সন্ত্রাসীদের বিনাশ করার লক্ষ্যে সুন্নি সৌদি বিমান বাহিনী বেপরোয়া বোমা ফেলছে। ইরান হুথিদের সব রকমের সাহায্য দিচ্ছে; পাকিস্তান, তুরস্ক আর কয়েকটা উপসাগরীয় দেশ মিলে দশ-বারোটা শক্তি সৌদি আরবের সাথে কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে। এসব খবর থেকে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের ধ্বংস করার জন্য মুসলমানেরাই যথেষ্ট মনে হয় না কি? প্রায় এক যুগ পর পারমাণবিক গবেষণাকে কেন্দ্র করে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বিরোধ চলছিল। এরা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল ইরানের বিরুদ্ধে। এখন আবার হঠাৎ করেই ইসরাইলকে চটিয়ে ইরানের সাথে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের চুক্তি হতে চলেছে বলেই মনে হয়। প্রায়-অবিশ্বাস্য এসব ঘটনার কার্যকারণ বুঝতে রীতিমতো গবেষণা প্রয়োজন। পশ্চিমা মিডিয়া স্বভাবতই এসব খবর নিয়ে ব্যস্ত। তা সত্ত্বেও এসব মিডিয়া বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগ জানাচ্ছে মাঝে মাঝে। সর্বশেষ এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ব্লগার হত্যা নিয়ে।
মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী বইমেলা থেকে ফিরছিলেন টিএসসি হয়ে। সময়টা সন্ধ্যার কিছু পর। ওই স্থানে তখন পুলিশ গিজ গিজ করছিল বলা চলে। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না, ঘাতকেরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা করে। এরা চিৎকার করে সাহায্য চাইছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, কাছাকাছি কিছু পুলিশও ছিল। কিন্তু এরা অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর রক্ষায় ছুটে আসেনি। ঘাতকদের এখনো গ্রেফতার করাও সম্ভব হয়নি, বিচার দূরের কথা। তার পরেই ওয়াশিকুর রহমান নামে আরেকজন ব্লগার খুন হয়েছেন। পুলিশ জনদুয়েক তরুণকে গ্রেফতার করেছে; কিন্তু সবাই জানে বাংলাদেশে পুলিশের সততা ও নিরপেক্ষতা বঙ্গোপসাগরের অতলে তলিয়ে গেছে। সর্বশেষ অনন্য আজাদ নামে এক ব্লগারও নাকি বিপন্ন বোধ করছেন এবং বিদেশে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং হত্যা হলে প্রকৃত আসামির শাস্তি দিতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছে পশ্চিমা মিডিয়া। সরকারের ও পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে অবশ্যই আমরা আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে বাংলাদেশের ব্লগারদের নিয়ে কিছু কথা।
ব্লগারদের প্রশিক্ষণ পর্ব
মিডিয়া ও বন্ধু-গুণগ্রাহীরা এদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ‘ বলে মাথায় তোলেন। আমার জানতে ইচ্ছে করে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা আদৌ বোঝার বুদ্ধি এদের হয়েছে কি না। অন্যভাবে বলতে গেলে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা দেখলে এরা চিনতে পারবেন কি না। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবু আল্লাহর নাম বিসমিল্লাহ দিয়ে সে সংবিধান শুরু করা হয়েছিল। কেউ তখন সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের কিছুটা সংশোধন করে এবং দেশের ৯২ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক ইসলামি পরিচয় দেয়া হয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আদি সংবিধান চর্চায় বিন্দুমাত্রও ব্যতিক্রম হয়নি। গোড়ার দিকের নির্বাচনগুলোর আগে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা মক্কা শরিফে যেতেন ওমরাহ পালন করতে এবং হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেশে ফিরে আসতেন। এখন আবার নির্বাচনের গোটা বিষয়টা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। প্রধানমন্ত্রী যে ধর্মভীরু দেশের মানুষকে বিশ্বাস করানোর লক্ষ্যে বশংবদ মিডিয়ায় কুরআন তেলাওয়াতরত শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে তার ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না এবং ওঠাও উচিত নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকু কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী অপপ্রভাব গেড়ে দিয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে, সেটাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা যাবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, জামায়াত আওয়ামী লীগের পুরনো রাজনৈতিক মিত্র। ১৯৮৬ সালে এরশাদের ভুয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেত্রী জামায়াতকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হাসিনার আন্দোলনে জামায়াতই ছিল প্রধান পেশিশক্তি। সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আওয়ামী লীগ পায়নি। জামায়াত দলীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে শেখ হাসিনাকে সরকার গঠন করতে হয়। সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পাওয়ার পরই শুধু সে সরকার টেকসই হতে পেরেছিল। যত দূর জানা যায়, এক-এগারোর পর থেকে জামায়াতের সমর্থন পাওয়ার বহু চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ; কিন্তু জামায়াত নেতারা আওয়ামী লীগের তদবিরে সাড়া দেননি। শুধুই কি তাই? জামায়াত হাত মিলিয়েছে বিএনপির সাথে।
সে জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা অনেকেই স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে অন্যান্য দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন। দলত্যাগীদের গরিষ্ঠ অংশই মুজিব কোট পরে আওয়ামী লীগার হয়ে গিয়েছিলেন। যারা দলত্যাগ না করে জামায়াতেই রয়ে গিয়েছিলেন এবং যে দু-চারজন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন ‘একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচার’-এর নামে তাদের ধরপাকড় ও সন্দেহজনক প্রকৃতির বিচার শুরু হলো। সরকারের উসকানিতে একদল বিরিয়ানিখেকো রক্তচোষা হায়েনা ‘ফাঁসি ফাঁসি‘ হুঙ্কার তুলে শাহবাগ মাতিয়ে তুলল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই ভারতের কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের কাছে সে যা যা চায় সেসব ভারতকে বিনা প্রশ্নে দিয়ে দিতে হবে। বিনিময়ে কংগ্রেসি সরকার শেখ হাসিনার বাকশালী স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে তাকে ক্রীড়নক হিসেবে বরাবরের জন্য বাংলাদেশের গদিতে বসিয়ে রাখবে।
জামায়াতের গায়ের গন্ধ আবিষ্কার করে লাভ হয়নি
একই সাথে মার্কিন সমর্থনও ধরে রাখার আশায় জামায়াতে ইসলামীর গায়ে দুর্গন্ধ আবিষ্কার করা হলো। নাইন-ইলেভেনের পরে ইসলাম নামটা উচ্চারিত হলেই বহু মার্কিনির আতঙ্ক হতো। তাদের সেই জুজুর আতঙ্কের অপসুযোগ নেয়ার জন্য শেখ হাসিনার সরকার এবং বিদেশে র-এর চরেরা জামায়াতকে ইসলামি সন্ত্রাসের সাথে সমার্থক করে দেখানোর সব চেষ্টা করেছে। টুপি-দাড়ি পরিহিত বহু, বহু হাজার মুসলমানকে গ্রেফতার ও অযথা নির্যাতন করা হয়েছে। মাদরাসাশিক্ষা অবৈধ করার বহু ফিকির খোঁজা হয়েছে। শেখ হাসিনার পুত্র ও উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ মিয়া জয় সদম্ভে ঘোষণাও করেছিলেন যে, যারা মসজিদে যান তাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য তিনি মসজিদে আওয়ামী লীগের ক্যাডার পাঠাচ্ছেন। আর স্বয়ং শেখ হাসিনা ফসল ভালো হওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন ‘তার মা-দুর্গাকে’।
‘ইসলামি সন্ত্রাসের‘ চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসীদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এখন কারো নেই। সবাই এখন ‘বোকো হারাম’, ‘ইসলামিক স্টেট’,‘পাকিস্তানি তালেবান’ নামের হরেক রকম সন্ত্রাসি গোষ্ঠী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বেঁধে দেয়া তুলার ব্যান্ডেজ মার্কিন সরকারের চোখ থেকে খুলে গেছে। তারা আর জামায়াতকে ‘ইসলামি সন্ত্রাসি’ মনে করে না। মাঝখান দিয়ে বেকায়দায় পড়েছে পঞ্চাশের দশকের ম্যাকার্থিপন্থীদের মতো কিছু স্থূলমতি তরুণ। ব্লগে ইসলাম ধর্ম আর আল্লাহ-রাসূলকে গালাগাল দিয়ে তারা প্রগতিশীল হতে চেয়েছিল। ধর্মের ওপর আঘাত এখনো যে মানুষকে ক্রুদ্ধ করে সে খবর রাখে এই ব্লগারেরা? সালমান রুশদির বই, ডেনমার্কের সাময়িকীর কার্টুন আর অতি সম্প্রতি প্যারিসের সাপ্তাহিক চার্লি হেবডোতে রাসূলুল্লাহর কার্টুন ছাপা নিয়ে কত লোক প্রাণ দিয়েছে, সে খবর রাখে এরা? আর হিন্দু, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মের বিরুদ্ধে সমানেই আক্রমণ করছে এরা?
বাংলাদেশের পুলিশকে সারা দুনিয়ার লোক এখন অথর্ব, অপদার্থ বলেই জানে। গদি পাওয়ার পর থেকে সরকার কত দফায় কত পুলিশ নিয়োগ করেছে, কত র্যাব আর কত বিজিবি আছে তাদের তালিকায়, তার হিসাবও বোধ হয় সরকারের জানা নেই। কিন্তু তথাকথিত এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষীরা নিজেরাই হচ্ছে সমস্যা, সমাধান তারা করবে কী করে? বিশ্বাসের জন্য, আদর্শের জন্য যারা খুন করে তাদের অন্তত সাহস আছে বলতে হবে। কিন্তু যারা অন্যকে দিয়ে খুন করায় তাদের কাপুরুষ না বলে উপায় নেই। এই পুলিশ, র্যাব আর বিজিবি দিয়ে এই সরকার পাইকারিভাবে রাজনৈতিক বৈরীদের গুম করাচ্ছে, খুন করাচ্ছে- এমনটিই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। ক্রসফায়ার আর বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন হচ্ছে সরকারের বিরোধীরা, খুন করছে সরকারের ভাড়াটে বাহিনীগুলো।
রোল মডেল মন্ত্রী ও সরকার
প্রতিটি শিশুও জানে এসব সত্য। সরকার চায় তাদের সমালোচনা, তাদের বিরোধিতা বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্মূল হবে। মন্ত্রী-উপদেষ্টারা নানাভাবে বলেনও সেসব কথা। যারা সমালোচনা করেছে তারা তো বটেই, যারা সমালোচনা করতে পারে তাদেরও গ্রেফতার করার নির্দেশ আছে পুলিশের ওপর। কোনো ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ আর তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন নেই। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে ‘ফ্রিল্যান্স‘ গ্রেফতার, ডাকাতি, এমনকি খুন করতেও এই বাহিনীগুলোর বাধা কোথায়? শিশু ছিনতাই করে মুক্তিপণের টাকার ভাগও পুলিশ নিচ্ছে বলে শুনেছি। র্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নারায়ণগঞ্জে ভাড়াটিয়া হিসেবে ৭+৪ জনকে হত্যার দায় স্বীকারোক্তি করে আদালতে বয়ান দিয়েছে। কিন্তু তাদের বিচার থমকে আছে। বিগত কয়েকটি বছরে বাংলাদেশে যারা বড় হয়েছে তারা এসব দেখছে সকালে-সন্ধ্যায়-রাতে টেলিভিশনে, শুনছে মন্ত্রীদের মুখের ‘অমৃত বাণী’। তারা আরো বুঝে গেছে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রদর্শিত পথেই চলতে হবে। তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে।
আমি বড়ো হতে শুরু করেছি বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষের দিকে। অনেক কিছুই ছিল না আমাদের। কিন্তু সুদৃষ্টান্ত ও আদর্শের কমতি ছিল না। আমাদের সংসারে ধর্ম নিয়ে আলোচনা হতো, অন্যেরাও আসতেন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাবের আশায়। শিশু আমি একদিন দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গোনাহ কাকে বলে। দাদা সহজ করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘যে কাজ করলে তোমারই মনে হবে যে কাজটা ভালো হয়নি, সেটাই গোনাহ।’ কলকাতার সংসারেও একই রকম পরিবেশ ছিল। আব্বা কলকাতার আলিয়া মাদরাসায় হাদিস আর ফেকাহ্্র (ইসলামি আইন) অধ্যাপক ছিলেন। একদিন এক ব্যক্তির মন্তব্য শুনে আব্বা চুপ থেকেছিলেন, যে মন্তব্য তার স্বমতের সম্পূর্ণ বিরোধী বলে আমি তখনো জানতাম। প্রশ্ন করতে আব্বা দিল্লির সম্রাট নাসিরুদ্দিনের গল্প শুনিয়েছিলেন। বস্তুত গল্পটা আমি সেই প্রথম শুনি। সম্রাট নাসিরুদ্দিন নিজের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য কুরআন শরিফ নকল করতেন। একদিন একজন অভ্যাগত সম্রাটকে বলেছিলেন যে তার একটা বানান ভুল হয়েছে। সম্রাট নিজের বানান কেটে লোকটির বানান বসিয়ে দিলেন। লোকটি চলে যেতেই তিনি আবারো তার নিজের বানানই লিখে দেন। সভাসদরা প্রশ্ন করলে সম্রাট বলেন, লোকটি দৃঢ় বিশ্বাস থেকেই ভেবেছিল যে তার বানান নির্ভুল ছিল; আমি তার মনে ব্যথা দিতে চাইনি।
ভাবছি, বাংলাদেশের অতি-চালাক ব্লগাররা যখন বড় হচ্ছিলেন তখন তাদের বাবা-দাদারা কোথায় ছিলেন।
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন