সময়টা ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাস। হঠাৎ করে বাজেট পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ায় বিবিসি আমাকে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দৃষ্টিপাতমূলক এক প্রস্থ অনুষ্ঠান নির্মাণের অনুমতি দেয়। তখন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না। ভারতের ভিসা পাওয়া যায়নি বলে প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানে জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের কয়েকটি সাক্ষাৎকার নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাই। তত দিনে আগস্ট গড়িয়ে সেপ্টেম্বর হয়ে গেছে।
অন্তত কারো কারো জন্য পটভূমিকার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এর আগেই ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারে চড়িয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদ আন্দোলন যে ১৯৬৯-এ পাকিস্তানব্যাপী গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হবে, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। বলদর্পী আইয়ুব খান তার ‘ডিকেড অব ডেভেলপমেন্টের’ ভণিতা ছেড়ে ক্ষমতা প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে তুলে দেন। দেশজুড়ে বলাবলি হচ্ছিল যে, ইয়াহিয়া খান অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন দিতে বাধ্য হবেন।
মুজিব ভাই আমাকে ভোরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ভাবী আমাকে নাশতা খেতে দেবেন। সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার পর মাংসের ঝুরিভাজা আর পরোটার নাশতা খেতে খেতে আমরা গল্প করছিলাম। অনিবার্যভাবেই আলোচনার বিষয়বস্তু নির্বাচনের প্রসঙ্গে এসে পড়ে। আমি বললাম, তার জনপ্রিয়তা যেমন সর্বজনীন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানে কে বিজয়ী হবেন, বলার অপেক্ষা রাখে না। মুজিব ভাই বললেন, জানিরে, পূর্ব পাকিস্তানে লোকে আমাকে ভোট দেবে, কিন্তু দেশের বাইরে কে আমাকে চেনে? বললাম, সেটা বড় সমস্যা নয়। লন্ডন সারা বিশ্বের মিডিয়া ক্যাপিটাল। আপনি লন্ডনে আসুন, বিশ্বমিডিয়ার সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।
কয়েক দিন পরই মুজিব ভাই ফোন করলেন। বললেন, নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে আসবেন স্থির করেছেন। আমি এবং কয়েকজন পূর্ব পাকিস্তানি উচ্চশিক্ষার্থী মিলে বিশ্বমিডিয়ার সাথে তার ৪১টি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। প্রায়ই তাকে বলতাম, মিডিয়ার সাথে তিনি মন খুলে কথা বললে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতে বিশ্বমিডিয়াকে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় দিতে আমাদের খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি।
স্বপ্ন ও স্বাধীনতা
স্বাধীনতা সম্বন্ধে আমাদের স্বপ্ন দুর্ভাগ্যবশত সঠিক হয়নি। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। গণতন্ত্রের হত্যা এবং বাকশাল নামে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জের ধরে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট একটা নিবিড় আঁধারে ডুবে গেল বাংলাদেশ। মুজিবের দুই মেয়ে হাসিনা ও রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুই বোনকে দিল্লিতে এনে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। তাদের তত্ত্বাবধানের ভার দেয়া হয় ভারতের বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা র-কে। দিল্লির সুশীলসমাজের সাথে তাদের যোগাযোগের সুযোগ বড় বেশি ছিল না।
এ দিকে, পরপর কয়েকটি রক্তঝরা সামরিক অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের কার্যকর ক্ষমতা হাতে পান। বহু প্রমাণ আছে যে, গোড়ার মুহূর্ত থেকেই তিনি হারানো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন। হাসিনা ও রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক উদ্যোগ তিনি কিছু দিনের মধ্যেই নিয়েছিলেন। শেষে তিনি পঞ্চম সংশোধনী মোতাবেক সংবিধানে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত করার পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে দুই বোনকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার দিল্লি সফরের কথা শেখ হাসিনা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তার স্বামী, পরলোকগত পরমাণুবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় সে সময় দিল্লিতে ড. হোসেন ও আবদুর রাজ্জাকের শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছেন। সমস্যা এখানেই। নেতানেত্রীদের কেউ কেউ বাংলাদেশের ইতিহাসের অর্ধেক অস্বীকার করেন। অন্য অর্ধেককে বাঁকা চোখে দেখেন। দেশে ফেরার পর সদ্য বৈধঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনাকে দলনেত্রী নির্বাচিত করতে বিলম্ব করেননি। পরের বছর আওয়ামী লীগ থেকেই বিবিসিতে আমাকে জানানো হয় যে, নেত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরে আসবেন। স্থির করে ফেললাম, শেখ হাসিনাকে তার পিতার মতো বিশ্বমিডিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। প্রথমেই আমি তার সম্মানে বিবিসির বুশ হাউজের কেন্দ্রীয় বার্তাকক্ষে এক চা-চক্রের আয়োজন করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, আওয়ামী লীগ নেত্রী বিবিসির সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মনখোলা মতামত বিনিময় করবেন।
বুশ হাউজে হাসিনার সম্মানে চা-চক্র
শেখ হাসিনা প্রায় দুই ডজন সহচর নিয়ে বুশ হাউজে হাজির হলে আমরা হতাশ হয়েছিলাম। সহকর্মী জন রেনার ও আমি স্থির করলাম যে, আমরা দু’জন নেত্রীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্টুডিওতে নিয়ে যাবো এবং সেখানে সব বিষয়ে তার মতামত জানার চেষ্টা করব। প্রথমেই শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেবেন জন রেনার। আলোচনার সূত্রপাত তিনি করেছিলেন ইংরেজিতে এভাবে : শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। দলনেত্রী হয়ে আপনার ভালো লাগছে?
শেখ হাসিনা : (ইংরেজিতে) না, মোটেও ভালো লাগছে না। আমি রাজনীতি ভালোবাসি না, রাজনীতিকে ঘৃণা করি।
জন রেনার : (বিস্মিত হয়ে) তাহলে আপনি কেন রাজনীতিতে এলেন? কেন দলনেত্রী হতে গেলেন আপনি?
শেখ হাসিনা : (ক্রুদ্ধ, ইংরেজিতে) ওরা আমার বাবাকে খুন করেছে, আমার মাকে খুন করেছে, আমার ভাইদের খুন করেছে, তাদের জন্য কেউ এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেনি। আমি তার প্রতিশোধ নেবো। প্রতিশোধ নেবো বলেই রাজনীতিতে এসেছি।
চোখে চোখে জনের অনুমতি নিয়ে স্টুডিও ম্যানেজারকে রেকর্ডিং বন্ধ করতে বলি। তারপর বাংলায় নেত্রীকে বললাম, আপনি দলনেত্রী হয়েছেন, আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রী হবেন আপনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেশের প্রত্যাশা অনেক। শুধু প্রতিশোধ নিতেই মানুষ কেন ভোট দিয়ে আপনাকে প্রধানমন্ত্রী করবে? তাদের সবার বাবা-মা তো খুন হয়নি! শেখ হাসিনা জবাব দেননি। কিন্তু আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, এরপর আমার কোনো কথায় তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
প্রতিটি কাজের পেছনে প্রতিশোধস্পৃহা
সে মুহূর্ত থেকে আওয়ামী লীগের সব কথা ও কাজে প্রতিশোধস্পৃহার লক্ষণ খুবই প্রকট। দুই বোন দিল্লি থেকে ঢাকা এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। তার ১৩ দিনের মাথায় অত্যন্ত জটিল একটা সামরিক ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। চট্টগ্রাম জেলার এক মাঠের মধ্যে যেভাবে তার লাশ লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল ধারণা করা স্বাভাবিক যে, তার পরিচয় বরাবরের জন্য গুম করে ফেলাটাই ছিল উদ্দেশ্য।
সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বোন-ভগ্নিপতি শামসুন্নাহার ও আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠ কন্যা শিরীনের সাথে আমার পুত্র সাইফুর রহমানের বিয়ে। বিবিসি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেবে না জানতাম। অগত্যা আমাকে বাদ দিয়েই বরযাত্রীরা ঢাকায় চলে গেলেন। কিন্তু অপূর্ব সুযোগ এসে গেল হঠাৎ। সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাথে বিরোধ বাধিয়ে তুললেন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের দাবি তুলে। আমাকে অবিলম্বে ঢাকা যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। স্থির হলো, আমার সহকর্মী রিচার্ড অপেনহাইমারও কয়েক দিনের মধ্যেই আমার সাথে যোগ দেবেন।
রিচার্ড আর আমি রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সাক্ষাৎকার নেই। বঙ্গভবনের প্রেস রুমে ১৯৮২ সালের ১৫ জানুয়ারি। সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিস আর তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরী। শেরাটন হোটেলে নিজের কামরায় গিয়ে সবে বসেছি। টেলিফোন বাজল। একটা অপরিচিত ভারী গলা জানতে চাইল ভিআইপি (রাষ্ট্রপতি) তার সাক্ষাৎকারে আমাকে কী বলেছেন।
রাষ্ট্রপতির সাথে আমাদের কথাবার্তা এতই স্পষ্ট ছিল যে, কোনো কিছু গোপন করার প্রয়োজন বোধ করিনি। বললাম, রাষ্ট্রপতি বলেছেন মাত্র অল্প দিন আগে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে, সংবিধানের প্রয়োজন মিটেছে। লোকটি জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট তো আপনাকে আরো বলেছেন যে, সেনাপ্রধানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের দাবি তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমি বললাম, হ্যাঁ, সে কথা তিনি আমাকে বলেছেন, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? হেসে বললাম, বঙ্গভবনের কার্পেটের কান আছে বলে তো শুনিনি। কলার টেলিফোনে বললেন, আপনি এই টেলিফোনের কাছেই থাকুন। আপনাকে আরেকটা ভিআইপি ইন্টারভিউ নিতে হবে। সারা দিন অপেক্ষা করার পর সন্ধ্যায় নতুন বেয়াই-বেয়ানের বাড়িতে খেতে গেছি। হোটেলে টেলিফোন নম্বর রেখে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর পরিচিত এক ব্যক্তি এলেন সেখানে। প্রস্তাবিত ভিআইপির প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন বলে দাবি করলেন। আমার স্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, লন্ডনে আমাদের বাড়িতে বেড়াতেও এসেছিলেন। আরো পরিচয় দিলেন তিনি। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের ভগ্নিপতি। সেনাপ্রধান স্থির করেছেন, তার প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়ার সময় হয়নি। ভগ্নিপতিকে পূর্ণ ব্রিফিং দিয়ে তিনি তার বক্তব্য আমাকে বুঝিয়ে বলতে পাঠিয়েছেন।
ভগ্নিপতি যা বললেন, তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সেনাপ্রধান বলে পাঠিয়েছেন একটা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে তিনি আপসবিমুখ; রাষ্ট্রপতি ও ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তের ওপর এ কাউন্সিলের ভেটো ক্ষমতা থাকতে হবে। তার দাবি মেনে নেয়া না হলে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা স্বহস্তে তুলে নিতে বাধ্য হবেন। আমার জন্য বিশেষ সমস্যা ছিল, তার বক্তব্য অবশ্যই বিবিসি থেকে প্রচারের অনুরোধ জানিয়েছেন ভিআইপি। অনেক ভেবেচিন্তে পরের দিন ভোরের ফ্লাইটে কলকাতা চলে যাই। ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা থেকে এই স্পর্শকাতর প্রতিবেদন পাঠানো বেশি নিরাপদ বোধ করেছিলাম।
ঢাকপেটানো সামরিক অভ্যুত্থান
পরের ইতিহাস সবারই জানা। দুই মাস পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিএনপির নতুন অনভিজ্ঞ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবিলম্বে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেও দেশের প্রাচীনতম ও অধিকতর শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত জ্ঞাপন করেছিল। আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি অখুশি হননি। আওয়ামী লীগের পত্রিকা দৈনিক বাংলার বাণী প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধে সামরিক সরকারের সাফল্য কামনা করে।
এ কথা কমবেশি সবারই স্বীকার করে যে, সামরিক স্বৈরতন্ত্র গেড়ে বসতে পারে গণতন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলে। স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্র কখনোই একসাথে টিকে থাকতে পারে না। আর স্বৈরতন্ত্র যত বেশি দিন বজায় থাকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ততই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এরশাদের অভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হবে, রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা যে অনেক পিছিয়ে যাবে, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। তা সত্ত্বেও সভানেত্রীসহ আওয়ামী লীগ এরশাদের স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত করেছিল। ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, মূলত আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনেই এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রায় নয় বছর স্থায়ী হতে পেরেছিল। এর একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব। রাষ্ট্রের এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে জেনেও প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আওয়ামী লীগ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
ছাত্রজনতার ঐক্যবদ্ধ দাবিতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সাথে একযোগে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য হয়। এরশাদের পতন ঘটে। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আরো একটা অপূর্ব সুযোগ এসেছিল। এমনকি সে নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকেই বাস্তব মনে করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন আগে ১৯৯১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে টেলিভিশনে তার ৪৫ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় অর্থহীন বিষোদগার প্রচারের পর সারা বিশ্বের পর্যবেক্ষকেরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
সম্ভাবনার অঙ্কুরেই বিনাশ
আসলে কী বলেছিলেন শেখ হাসিনার সে রাতের টেলিভাষণে? বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সে সম্ভাবনাই সেদিন নস্যাৎ হয়ে যায়। এর পুনরাবৃত্তি আরো অনেকবার ঘটেছে। এখন আমরা জানি, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনটা ছিল একটা দেশী-বিদেশী-সামরিক-মিডিয়া আঁতাতের ফসল। যা-ই হোক, সে নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিরাট জয় পেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তার নিজের কিংবা দেশের কী লাভ হলো? সংসদের ফোরে দাঁড়িয়ে বেগম জিয়া ও জিয়াপরিবারের বিরুদ্ধে গালিগালাজের কোনো প্রয়োজন ছিল কি? তাতে ব্যক্তি, রাজনীতিক, এমনকি মুজিবকন্যা হিসেবেও তার সামান্যতম মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটেছে কি? এর বদলে তখন থেকেই যদি তিনি সুশাসন ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিতেন তাহলে এত দিনে জাতীয় পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যেতে পারত, জাতি সম্ভবত ভোট দিয়েই তাকে প্রধানমন্ত্রী করে রাখতে চাইত। কিন্তু সেটা কি তাদের কাম্য ছিল? আমার সন্দেহ হয়। প্রায়ই মনে হয়- ক্ষমতা, দেশ শাসন, এমনকি রাজনীতিক হিসেবে দেশের ও বিশ্বের সম্মান ও মর্যাদা আওয়ামী লীগের কাম্য নয়।
এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়ে সেই যে শুরু করেছিলেন, সেই যে ভূতটাকে তিনি বোতল থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তার হাত থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আজো তিনি খুঁজে পাননি। তার দল ও সরকারের কাজের মধ্যেই কোথায় যেন জাতিকে শাস্তি দেয়ার, প্রতিশোধ নেয়ার একটা বাসনা প্রচ্ছন্ন থাকে।
যে হাত খেতে দেয় সে হাত কামড়ানো
ভাগ্যহত বাংলাদেশও মাঝে মাঝে সৌভাগ্যের মুখোমুখি হয়েছিল। একটা বঞ্চিত ও নির্যাতিত জাতি সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে, শত প্রতিকূলতা জয় করেও জাতি-সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে সে প্রয়াস দেখেছে। সাহায্য, বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে তারা এগিয়ে এসেছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশ বাংলাদেশের মতো এত ঋণ, অনুদান, বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু তাতে চূড়ান্ত লাভ আমাদের কী হয়েছে? পদ্মায় সেতু তৈরির মূলধন সংগ্রহ করতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থা খুবই সহজ শর্তে আমাদের ঋণ দানের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ দেশে শুল্কমুক্ত তৈরী পোশাক রফতানির বাজার পেয়েছিলাম। সে সুযোগ নষ্ট না করলে পোশাক রফতানির ব্যাপারে আমরা এত দিনে বিশ্বের সেরা দেশে পরিণত হতে পারতাম। কিন্তু সেসব সুযোগ আমরা হেলায় নষ্ট করেছি। পোশাক রফতানির জিএসপি সুবিধা আমরা হারিয়েছি ক্রেতাদেশগুলোর সাথে অহেতুক বিবাদ ও বিতর্ক করে। আমদানিকারক দেশগুলো এ শিল্পের উন্নতির যেসব প্রস্তাব করেছিল, তাতে কার ক্ষতি হতো? সরকারের? কারখানা মালিকদের? পোশাক শ্রমিকদের? কিংবা বাংলাদেশের? এখন যে এ শিল্প ধ্বংস হতে বসেছে, এ বাজার যে আমাদের হাতছাড়া হতে চলেছে, তাতে লাভবান হচ্ছে কে? আমাদের সাফল্যে যারা ঈর্ষাতুর ছিল তারা। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ন্যায্য কিছু অভিযোগ ছিল। সেগুলো সম্বন্ধে তদন্তে সরকারের অমন প্রবল আপত্তির কারণ কী? অথচ সে জন্য আমরা যা হারিয়েছি তার তুলনা হয় না। সেই কবে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে যেতে পারত। এখন সরকার বলছে বটে যে, নিজেদের সম্পদ থেকে তারা সেতু তৈরি করবে। কিন্তু তাতে মোট ব্যয় যে কত গুণ বেড়ে যাবে, হিসাব করে দেখেছেন কেউ? প্রায়ই শুনছি সেতুর কাজ শুরু ‘হচ্ছে, হলো’ বলে। সর্বশেষ, পত্রিকায় পড়লাম সেতুর জন্য দুই ষাঁড়, দুই পাঁঠা আর দুই মোরগ ‘উৎসর্গ‘ (বলি) দেয়া হয়েছে, ‘কোরবানি’ দেয়ার কথা কেউ বলছেন না। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য আর ধর্মীয় সংস্কৃতিও এখন আমরা ভুলতে বসেছি।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, চীন-জাপানসহ বহু দেশের সরকার-প্রধান কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বাংলাদেশে এসেছেন এক হাতে সাহায্যের ডালি আর অন্য হাতে বাংলাদেশে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে। তাদের কথা আমরা শুনিনি। প্রত্যেককে আমরা অপমান করেছি। অবশিষ্ট ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু দিল্লিও এখন গণভবনের ওপর নাখোশ মনে হচ্ছে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরটিও নিশ্চয়তামূলক নয়।
স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে প্রতিশোধ?
কিছু দিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলাম। বাংলাদেশের দৈনন্দিন ঘটনাবলির সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিল না। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে শুনি- মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে, দুই বাংলা এক হয়নি কেন? কী অদ্ভুত আর বিস্ময়কর প্রশ্ন? সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে কেন? চাঁদকে কেন আমরা রাতের আকাশেই ভালো দেখি? কারণ কী? কারণ এই যে সুদূর অতীতে কিছু প্রাকৃতিক কার্যকারণ ঘটেছিল। দুই বাংলা এক হয়নি কেন? এসব প্রশ্নও উঠেছিল অতীতে; ১৯৪৬-৪৭ সালে। মীমাংসা তখনই হয়ে গেছে। দুই বাংলা এবং ভারতবর্ষ অভিন্ন থাকার সুযোগ উপমহাদেশের মানুষকে দেয়া হয়েছিল। সে সুযোগের তারা সদ্ব্যবহার করেনি বলেই দেশ ভাগ হয়েছে এবং সে সঙ্গে বহু আনুষঙ্গিক ঘটনা। সে প্রশ্ন এখন কেন? যে যার দেশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেই তো সমাধান হয়ে যায়? পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতেই আছে, কিন্তু অবশিষ্ট ভারত কি পশ্চিমবঙ্গকে অথবা পশ্চিমবঙ্গ কি অবশিষ্ট ভারতকে নিয়ে সন্তুষ্ট? উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতবোন নামে পরিচিত রাজ্যগুলোও পশ্চিমবঙ্গ অথবা অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে সদ্ভাবে আছে কি? তাহলে অর্ধশতাব্দী ধরে কেন তারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে? দুই বাংলা এক থাকলে যে মমতা ব্যানার্জি আর শেখ হাসিনা পরম সৌহার্দ্যরে সঙ্গে সে রাজ্য শাসন করতেন, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬-১৭ জন কূটনীতিকের উদ্যোগের খবর পেলাম হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে। কিছুটা আশাবাদীও হয়েছিলাম হয়তো। তাদের প্রস্তাবে গ্রহণযোগ্য কিছু দিক ছিল। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো গত বছর যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতেও গ্রহণযোগ্য দিক ছিল। অনুসন্ধান করা হলে এসব প্রস্তাবের মধ্য থেকে সমাধান অবশ্যই পাওয়া যেত। ঢাকা থেকে এক বন্ধু ফোনে বলছিলেন, দেশের মানুষ কিছুটা আশাবাদী কূটনীতিকদের প্রস্তাব নিয়ে। এর পরেই কিন্তু মুখ খুললেন শেখ হাসিনা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশের মাটিতে খালেদা জিয়ার স্থান হবে না। কেন হবে না? বাংলাদেশ কি এতই ছোট দেশ? নাকি বিশেষ কোনো নেতা-নেত্রী বা দল বাংলাদেশের মালিক?
প্রধানমন্ত্রী কি ভয় করছিলেন যে কূটনীতিকদের চেষ্টা সফল হলে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না? সে জন্যই কি আরেক প্যাঁচ মোচড় দেয়া হলো? ৩৫ বছর ধরে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কী লাভ হয়েছে তাতে? দেশের অগ্রগতি হচ্ছে না। হাজারে হাজারে মানুষ খুন হয়েছে। খুন কে করেছে, জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সরকার ও আওয়ামী লীগ এক কথায় বলবে, খালেদা জিয়া ও বিএনপি। সকাল-সন্ধ্যা খালেদা জিয়াকে খুনি না বললে পেটের ভাত হজম হয় না।
দেশ-বিদেশের মানুষ জানে অন্য কথা। ‘ক্রসফায়ার’ আর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কথাগুলো এখন কদর্য ও নিষ্ঠুর রসিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম-খুনগুলো কারা ঘটাচ্ছে, সবাই জানে। ব্রিটিশ সরকার এখনো ইলিয়াস আলীর মুক্তির জন্য এ সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতালাভের গোড়ার দিকে জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকার বিদেশীদের ‘ইমপ্রেস’ করার চেষ্টা করেছিল; দাবি করেছিল যে, তারা বাংলাদেশ থেকে আলকায়েদা ও ইসলামি সন্ত্রাস দূর করার চেষ্টা করছে সুতরাং সবার উচিত তাদের সমর্থন দেয়া। অভিজিৎ হত্যা নিয়ে নতুন চাল চেলেছেন তারা। বিদেশীদের তারা বলতে চাইছেন, বাংলাদেশে নতুন করে ইসলামি সন্ত্রাস দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ গদিতে না থাকলে সে সন্ত্রাস দূর হবে না।
ইরাকের আইএস বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কোনো দেশের কোনো সরকার এ প্রচারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। পুলিশ যেখানে হাজির ছিল সেখানে কী করে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারল, সে ব্যাখ্যাই সবাই চায়। অভিজিতের বাবা বলেছেন, ফারাবীকে গ্রেফতার করে কী লাভ হলো, সে তো সে চারুকলাতেই ছিল না।
আমরা জানি ১৯৮১ সালে যে প্রতিশোধস্পৃহাকে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, দেশের লোকসান এবং বিভিন্ন খুনের জন্য সেটাই দায়ী। কিন্তু সেই স্পৃহার কি সীমা-পরিসীমা থাকতে নেই?
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন