মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খানের ৩৮তম মৃত্যুদিবস পালিত হলো গত ১৭ নভেম্বর। সে তারিখে বিএনপি ও ২০ দলীয় ঐক্যজোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া প্রথম কাতারের আর কোনো নেতানেত্রী তার প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেছেন বলে আমার নজরে পড়েনি। অতীতের মুখ চেয়ে অবশ্যই বটে। ভবিষ্যতের খাতিরেও এজাতীয় শ্রদ্ধানিবেদনের মূল্য আছে। এখন যাদের জন্ম হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো যারা জন্মাবে, তাদের সবাই বর্তমানের বিতর্কিত সরকারের সদস্যদের মতো অপ্রিয় ইতিহাস পুড়িয়ে ফেলতে নাও চাইতে পারে। আগে যারা এসেছিলেন, এই জাতিকে ভালোবেসেছিলেন এবং কণ্ঠ ও পেশিসর্বস্ব নেতাদের অবহেলায় অভিমান করে চলে গেছেন, তাদের সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানার সুযোগ তাদেরও দিতে হবে। তারাও বর্তমানের কোনো কোনো নেতারনেত্রীর মতো গাঢ়োল হবে বলে ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে খুব ভালো করেই চিনতাম। বহুবার আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, এমনিতেও দেখা করতে গেছি এবং বিদেশীদের সাথে তার সাক্ষাৎকারের সময় দোভাষীর কাজ করেছি। আমি যখন বিলেত চলে এসেছি আর কেউ আসবে শুনলে মওলানা ভাসানী তার মারফত আমার জন্য দোয়া পাঠাতেন। কিন্তু আজ শুধু বলছি একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের কথা। তাও ভিন্ন কারণে।
তখনকার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও ভয়ানক টানাপড়েন চলছিল। বিবিসি আমাকে ১৯৬৯ সালে পরিস্থিতির সবিস্তার মূলায়ন ও বিশ্লেষণমূলক এক সিরিজ অনুষ্ঠান প্রচার করতে বলল। পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকজন নেতার সাক্ষাৎকার নিয়ে ঢাকা এসেছি। ভাগ্য ভালো। শেখ মুজিবুর রহমান পরদিন ভোরে তার বাড়িতে যেতে বললেন। তার কিছুকাল আগেই তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অভূতপূর্ব গণবিপ্লব হয়ে গেছে। দেশে খুবই জনপ্রিয় শেখ মুজিব। তার ও ভাবীর সাথে নাশতা খেয়েছিলাম সেদিন। খুবই ভালো একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং খামোখা গল্প করছিলাম বহুক্ষণ ধরে।
পরের দিন যাবো মওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার নিতে। খবর নিয়ে জানলাম মওলানা তখন সন্তোষে এবং রাস্তায় তখনো অজস্র খানাখন্দক আর প্রচুর কাদা। বন্ধুদের পরামর্শে একটি মিলিটারি জিপ ভাড়া করলাম। পাকিস্তান অবজারভারের ফটোসাংবাদিক ফিরোজ সাথে যাবেন। তাকে ভোর ৫টার মধ্যেই ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে চলে আসতে বললাম। সন্তোষ পর্যন্ত পৌঁছাতেই গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমি আধমরা। মনে হতে শুরু করেছে, একটি সাক্ষাৎকার পেলাম কি না পেলাম বিবিসির কিছু এসে যায় না। কিন্তু মওলানাকে দেখলে আমার ভালো লাগবে। কপালে আরো দুঃখ ছিল। সন্তোষে এসে শুনলাম মওলানা সেদিনই সকালে নৌকোয় করে তার বিন্নাফৌরের বাড়িতে চলে গেছেন। কোথায় বিন্নাফৌর? খুব বেশি দূরে নয়। জিপে করে পোড়াবাড়ী পর্যন্ত যেতে হবে। সেখানে জিপ রেখে মাইল তিনেক হেঁটে তারপর বিন্নাফৌর।
পোড়াবাড়ীতে জনতার মিছিল
পোড়াবাড়ীতে জিপ আর দু’জন অচেনা লোক দেখে মানুষের কৌতূহল হয়েছিল। ড্রাইভারের কাছ থেকে তারা জেনে নিয়েছিল যে, লন্ডনের বিবিসি থেকে সিরাজুর রহমান নামে একজন লোক এসেছে মওলানা ভাসানীর ইন্টারভিউ নিতে। আর যায় কাথায়? দোকানে যারা চা আর বিশ্ব বিখ্যাত চমচম কিংবা অন্য কিছু খাচ্ছিল, আর যারা নিছক আলস্যে সময় কাটাচ্ছিল একে-দুয়ে উঠে আমাদের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল তারা। অনেক মানুষ মাঠে কাজ করছিল। হাল চষছিল আর ক্ষেতের আগাছা নিড়াচ্ছিল। কাজ ফেলে তারাও যোগ দিল মিছিলে। মওলানার বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন অন্তত শ’ খানেক লোক তো ছিলই সেখানে।
মওলানা আমাদের না খাইয়ে ছাড়বেন না। আমরা খেতে বসলাম বারান্দায় পাটি-বিছানো খাটের ওপর। উঠানে, এখানে-ওখানে বসে জনতা আমাদের খাওয়া দেখছিল। মওলানা খাওয়ালেন লাল মোটা চালের ভাত, ছোট ছোট অনেক মোরগ-শিশুর ঠ্যাং আর মসুর ডাল। শেষে এক বাটি দুধ। দুধ আমি খাই না, দুধে আমার অ্যালার্জি। ফিরোজ খেলেন। আমি টেপ রেকর্ডার খুললাম, ঢাকাতে আরো কাজ আছে। অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন মওলানা ভাসানী। কী কী কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে একত্রে থাকা যায় না, তাদের বিশ্বাস করা যায় না। সার কথা তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, এখন এগারো দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল এক হয়ে (ইয়াহিয়া খানের) সামরিক সরকারকে জানিয়ে দেয়া উচিত যে, তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতা জনসাধারণের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। জনসাধারণ ক্ষমতা পেলে তখন তাদের ইচ্ছা-আকাক্সা অনুযায়ী সংবিধান রচনা করবে এবং নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।’
আমি তাকে তার এগারো দফা কর্মসূচি বুঝিয়ে বলতে বলি। মওলানা সাহেব বলেন, ‘এগারো দফা কৃষক শ্রমিকের বাঁচার দাবি। সংবিধানে বিধান থাকবে যে কৃষক-শ্রমিক, যারা সংখ্যায় শতকরা ৯৫ জন, সরকার তাদের শিক্ষার দায়িত্ব নেবে, তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে, তাদের ধর্মীয় অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকার পুরোপুরি সুনিশ্চিত করবে।’
জিন্দাবাদ মানে ভোট নয়
মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার পোড়াবাড়ীর দিকে ফেরত যাত্রা শুরু করলাম। জনতা তখনো আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি। বরঞ্চ আরো কিছু যোগ হচ্ছে পথে পথে। মওলানার কথায় তারা উদ্দীপিত হয়েছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ’। আমি ভাবছিলাম। এই লোকগুলো কেন এত ভালোবাসে এই লোকটাকে। এমনকি মাঠের কাজকর্মে গাফিলতি করেও। মাঝপথে একটি সেতুর গোড়ায় এসে আমি থামলাম। স্লোগানও থামল। আবার টেপরেকর্ডার চালু করে একে একে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম ভাসানীকে তাদের কেমন লাগে। প্রায় একবাক্যে জবাব এলো, ‘খুব ভালো, খুব ভালো, উনি পীর মানুষ।’ আমার তার পরের প্রশ্ন : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি নির্বাচন দেন তাহলে মওলানাকে ভোট দেবেন আপনারা? প্রধানমন্ত্রী করবেন তাকে? কিন্তু এবারে সব নিশ্চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কেন আপনারা আমার সাথে তার বাড়িতে গেলেন, কেন তার জনসভায় যান, কেন স্লোগান দেন। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর একজন এগিয়ে এসে বললেনÑ স্যার আমরা গরিব মানুষ, লেখাপড়া জানি না। আমাদের অনেক দুঃখ। কিন্তু সেসব দুঃখের কথাও আমরা ঠিকমতো বলতে পারি না। হুজুর (ভাসানী) আমাদের মনের কথাগুলো সুন্দর করে বলে দেন। সেই জন্যই ওনার কথা শুনতে আমাদের এত ভালো লাগে।
তারপরেও বেশ কয়েকবার মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করেছি, বিরাট বিরাট জনসভায় তার সম্মোহনী ভাষণের বিবরণ পড়েছি এবং প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে পোড়াবাড়ীর সেই মানুষগুলোর কথাÑ যারা কাজকর্ম বাদ দিয়ে দূর-দূরান্তে গিয়ে তার বক্তৃতা শোনে, কিন্তু যারা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করবে না। ভাসানী কখনো প্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু যাদের তিনি রাজনীতিতে দীক্ষা দিয়েছিলেন, রাজনীতি শিখিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ হয়েছিলেন। অনেক ভেবে আমি একটিই কারণ খুঁজে পেয়েছি। ভাসানী যে আদর্শ প্রচার করতেন সে আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে যে সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থার প্রয়োজন ছিল, তার নির্দেশ তিনি অনুসারীদের দেননি। ফলে অনুসারীরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। মওলানাকে পাশ কাটিয়ে তারা নেতা হয়ে গেছেন, নতুন নতুন দল গড়েছেন তারা। সস্তা রাজনীতির গরজে কেউ কেউ উল্টে তার সমালোচনা করেছেন, তাকে গালিগালাজ করেছেন।
খালেদা জিয়াÑ অতীত ও বর্তমান
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৬৯ সালের সে দিনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সঙ্কটাপন্ন, অনেক বেশি বিপদশঙ্কুল। বস্তুত এখন আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে আমরা আসছি কী যাচ্ছি বুঝে ওঠা কঠিন। শেখ হাসিনা ‘অখুশি হননি’ বলে এবং তার সক্রিয় সহযোগিতায় আর বাংলার বাণী পত্রিকার মুনাজাতের বলেই হয়তো, জিয়াউর রহমানের বর্বরোচিত হত্যার নায়ক লে. জে. এরশাদের ভীতিকর স্বৈরশাসন ৯ বছর স্থায়ী হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া তখন একজন সাধারণ গৃহিণী। রাজনীতির কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্রের চোরদের তিনি একদণ্ডও শান্তিতে থাকতে দেননি। দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল, সেই সাথে শক্তিধর জামায়াতে ইসলামীর কখনো এ দিক কখনো ও দিকের রাজনীতি এবং ডিপ ফ্রিজার ও ওয়ারড্রোব ভর্তি টাকার কারণে এরশাদের দুর্নীতিবাজ ও অত্যাচারী সরকার ৯ বছর গদি আঁকড়ে থাকতে পেরেছিল। কিন্তু ’৯০ সালের শেষে খালেদা জিয়া যখন বক্তৃতা ছেড়ে আন্দোলনের ডাক দিলেন, এরশাদের তখন আর গদি আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই খালেদা জিয়াকে ভালোবাসে। একটা কারণ নব্বইয়ে তার দ্বিধাহীন ইস্পাত-কঠিন নেতৃত্ব। দেশজ মীর জাফর ও বিদেশী শক্তিদ্বয়ের ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হন। তার মূল পরিকল্পনা যে ছিল বাকশালী স্বৈরতন্ত্র চালু করে গণতন্ত্রকে কবর দেয়া সেটা বুঝতে কারো দেরি হয়নি। খালেদা জিয়া আবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন এবং সে ডাকে সাড়া দিতে বাংলাদেশের মানুষ ইতস্তত করেনি। তিনি দেশজুড়ে সভাসমিতি করেছেন, লাখে লাখে লোক গোগ্রাসে তার বক্তৃতা যেন গিলে খেয়েছে। সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে কত লাখ, কত কোটি মানুষ তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে সে হিসাব কে করবে? কিন্তু এরপর যে কি হয়ে গেল অবাক বিস্ময়ে সেটাই এখন ভাবছে বাংলাদেশের মানুষ।
বাংলাদেশ গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও ধর্ষণের দেশে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করতেও যেন মানুষ ভয় পাচ্ছে। শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন, গদি তিনি ছাড়বেন না। সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই তিনি করে ফেলেছেন সময় নষ্ট না করে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে অ-হিন্দু ও অ-আওয়ামী লীগ কর্মকর্তাদের কালবিলম্ব না করেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী ছড়িয়ে পড়েছেন সচিবস্তর পর্যন্ত। বহু দফায় কত লাখ ভুয়া সনদধারী ‘গোপালী পুলিশ’ যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার হিসাব কষলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হবে। কোনো কোনো বিদেশীকেও বলতে শুনেছি ‘বাংলাদেশে আইন আছে, পুলিশ আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই; আইন আছে, আদালত আছে, কিন্তু ন্যায়বিচার নেই’। বস্তুত সব অর্থেই বাংলাদেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্র। ন্যায়বিচারের সাহস বিচারপতিদের নেই। তাদের কেউ চলেন দলীয় ও সরকারী নির্দেশে, অন্যরা নতজানু দলীয় সংসদের অভিশংসনের ভয়ে আতঙ্কিত। বহু বিধি ও নিষেধাজ্ঞার কারণে মিডিয়া আতঙ্কিত, বাকহীন।
গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল
এ দেশে এখন গায়ের জোরে গণতন্ত্র চলে, নির্বাচনের তারিখ আসার আগেই সংখ্যাগুরু দল স্থির হয়ে যায়। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বলতেন ২০২১ সাল অবধি ক্ষমতায় থাকার কথা। এখন তিনি বলছেন ২০৪১ সালের কথা। কত দিন তিনি গদিতে থাকবেন নিজেই স্থির করেন। বিদেশীরাও এখন স্বীকার করেন বাংলাদেশের এখন অগ্নিগর্ভ অবস্থা। বারুদের পাহাড় শুকনো, খটখটে। কিন্তু কোথায় খালেদা জিয়া? কোথায় নব্বই সালের স্ফুলিঙ্গ?
কোনো গণতান্ত্রিক দেশ আজ অবধি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী তামাশাকে স্বীকৃতি দেয়নি। সবার গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন করার তাগিদ দিচ্ছে সবাই। চাপ হিসেবে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুবিধা দিতে অস্বীকার করছে। তবু কেন একটা অবৈধ সরকার আজো গদিতে আছে? এ প্রশ্নের জবাব অবশ্যই এই হবে যে, দেশে যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা মনস্থির করে অবৈধ সরকারকে ঠেলে ফেলে দিতে এগিয়ে আসছেন না। ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে দেশে গণতন্ত্রের আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিল। ২০১৩ সালে কয়েক দফায় এই সরকারকে উৎখাত করার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া মওলানা ভাসানীর মতো জনসভা করছেন, আবেগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন মানুষের মনে। কিন্তু অবৈধ গদি দখলকারী আর গণতন্ত্রের ঘাতকদের উপড়ে ফেলতে শেষ ধাক্কাটা তিনি দিচ্ছেন না।
রাজনীতি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বহু মতের অবকাশ আছে। কিন্তু সেসব মতদ্বৈধ অতিক্রম করে চূড়ান্ত কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন নেতা। বিএনপিতে নেতৃত্বের দুর্বলতা আছে, ক্ষমতা ও স্বার্থলিপ্সাসর্বস্ব নেতারা আছেন এবং যত দূর মনে হয় আওয়ামী লীগের চরও আছেন কিছু। শুনেছি খালেদা জিয়াকে বোঝানো হয় যে, হরতাল ডাকলে মানুষের অসুবিধা হয়, অসাংবিধানিক আন্দোলন করলে বিদেশীরা অসন্তুষ্ট হয়। সুতরাং প্রকৃষ্ট উপায় হচ্ছে সভাসমাবেশ করা, জনমত গঠন করা। আরো বহু পরামর্শ : ইসলামের কথা বললে রামরাজ্য-ওয়ালারা অখুশি হবে, বিদেশীরা ইসলামি সন্ত্রাসের অপবাদ দেবে। জামায়াতকে জোটে রাখলে গায়ে গন্ধ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার মতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে যে যুদ্ধজয় সম্ভব নয়, সে কথাটা বোধহয় কেউ বিএনপি ও ২০ দলের জোটের নেতাদের বলে দেয়নি। এ কথাটাও বোধহয় কেউ তাদের বলেনি যে, সব মতের ঊর্ধ্বে উঠে যিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন সার্থক নেতা।
খালেদা জিয়া জনমত গঠন করছেন প্রায় ছয় বছর ধরে। জনমতের আমটা অনেক আগেই পেকে পচে গেছে। মানুষ জানে, যে হরতাল থেমে থেমে চলে, মাঝ পথে শেষ হয় সে হরতালে কাজ হয় না। যে হরতাল শেষ ঠ্যালা নয়, সে হরতালে সময় নষ্ট করতে তারা আর রাজি নয়। ‘অবৈধ’ সরকার মানুষের এই দ্বিধার অপসুযোগ নিচ্ছে। তারা বলছে, হরতালে মানুষের অসুবিধা হয়, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়। মানুষের কষ্টের কথা ভেবে তাদের মরাকান্নার যেন অবধি নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা কত শত দিন হরতাল করেছেন, কত সেতু ও রেলপথ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কত মানুষ খুন হয়েছে; সাধারণ মানুষ ভুলে গেলেও খালেদা জিয়ার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। অবৈধ সরকারের ‘অবৈধ’ নেতারা বিদ্রƒপ করছেন, জামায়াতের গায়ের গন্ধের কথা বলছেন বারবার। কিন্তু ১৯৮৬ সালে জাতির প্রতি বেঈমানি করে শেখ হাসিনা জামায়াতকে দলে টেনে স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন দিয়েছেন, এরশাদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সাথে গলাগলি করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছেন এবং জামায়াতের সংসদ সদস্যদের ভোটের জোরে সরকার গঠন করেছেন, তখন কিন্তু জামায়াতের গায়ে গন্ধ ছিল না। আসলে তাদের খেলা হচ্ছে জামায়াতকে ভয় দেখিয়ে নিজেদের দলে টানা, নিদেন বিএনপির কাছ থেকে সরিয়ে আনা।
কর্মসূচির আর কত দেরি?
আসল কথা হচ্ছে খালেদা জিয়া এক সময়ে সংকল্পের দৃঢ়তা দেখাতে পারতেন, এখন আর পারছেন না। এখন যেন সর্বক্ষণ তার চিন্তা ‘পাছে লোকে কিছু বলে‘। অন্য দিকে শেখ হাসিনা পিছু টানের কথা ভাবতেই রাজি নন। তিনি যা করতে চান করে ফেলেন, পরিণতিকে তিনি ভবিতব্যের হাতেই ছেড়ে দেন এবং ইদানীং খালেদা জিয়ার চেয়ে তার চিন্তা বেশি অগ্রগামী। খালেদা জিয়া এ-ঈদ সে-ঈদের পর কর্মসূচি দেবেন, শেখ হাসিনা সে ভয়ে থর থর করে কাঁপছেন না। তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগের লাখ লাখ ক্যাডারকে পুলিশে নিযুক্তি দিচ্ছেন, দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছেন। একে-দুয়ে মিডিয়াকে তিনি পকেটে পুরে ফেলেছেন। অবশিষ্ট মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। খালেদা জিয়া আর বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত ভুয়া মামলা সাজানো হয়েছে। শোনা যাচ্ছে যেকোনো সময় সেসব মামলা দ্রুত বিচার আদালতে পাঠানো হতে পারে। নতজানু আদালতের রায়ের পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘এবডো‘
(জনপ্রতিনিধিত্বমূলক পদের অযোগ্য) করার কথাও শোনা যাচ্ছে। দেশে আজ সত্যি কথা বলার মতো মিডিয়া নেই বললেই চলে। নেই ন্যায়বিচারের জন্য কোনো নিরপেক্ষ বিচারক। মোট কথা ডাবল-ট্রিপল কংক্রিট দিয়ে গদিকে মজবুত, আরো মজবুত করার সব চেষ্টা তারা করছে। ২০১২ সালে, এমনকি গত বছরও এই সরকারকে হঠানো যত সহজ ছিল, এখন অবশ্যই তারচেয়ে অনেক কঠিন হবে।
এই দুই বছরে অনেক মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন বাংলাদেশে। তাদের অনেকে হয়তো আবারো গণতন্ত্রের মুখ দেখার আশায় খালেদা জিয়ার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন তারা দেখে যেতে পারেননি। তাদের বিদেহী আত্মাকে কী কৈফিয়ত আর কী সান্ত্বনা দেবেন বিএনপি নেতারা?
এ বছরও দু’টি ঈদের পরে খালেদা জিয়ার ‘কর্মসূচির‘ প্রতিশ্রুতি ছিল। জমিদার বাড়ির সে মণ্ডামিঠাই আসেনি। এখন আবার বিজয় দিবস (বিজয়ের মাস নয়) আসন্ন। সে জন্যও বিলম্ব করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, বিদেশীদের চাপে সরকার মার্চ মাস নাগাদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির পর থেকে অনেক নিষ্ক্রিয়তা, অনেক গড়িমসি দেখেছে বিদেশীরা। তারা আর কত দিন ধৈর্য ধরে বিএনপির ‘কর্মসূচির’ জন্য অপেক্ষা করবে? অধৈর্য হয়ে হয়তো তারা শেখ হাসিনার সৃষ্ট বাস্তবতাকেই মন্দের ভালো বলে মেনে নেবে। তা ছাড়া খালেদা জিয়া ও তার দলের শীর্ষ নেতারা নির্বাচন করার জন্য তত দিন জেলখানার বাইরে থাকবেন তো? মধ্যবর্তী সামান্য সময়টুকুও কি তারা কাজে লাগাতে পারেন না? মার্চ মাস পর্যন্ত দেরি না করে বিজয় দিবসের পরের দিনই কর্মসূচি কেন ঘোষণা করা যায় না?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন