সৌকর্যশীল মানুষ বর্তমানকে পরিপাটি করে গুছিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চায়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা করে, সে লক্ষ্যে ত্যাগ স্বীকার করে। বিজ্ঞ ব্যক্তি ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেন, ইতিহাসের আলোকে ত্রুটিমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ার প্রয়াস পান। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রয়াস হচ্ছে যেকোনো মূল্যে ইতিহাসকে ঘষেমেজে পরিপাটি করা। বিকলাঙ্গ সন্তানকে তারা মেকআপ দিয়ে সুদর্শন দেখাতে চায়। সে জন্য বর্তমানকে রক্তাক্ত করতে এবং ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা তাদের নেই।
ছোট্ট একটি উক্তি এই পুরনো বিশ্বাসটা মনে পড়িয়ে দিলো। সে উক্তি ইতিহাসের, বর্তমানের কিংবা ভবিষ্যতের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নয়। একটা অবৈধ সরকারের, তাও কোনো ফুলমন্ত্রী নন, ক্রীড়া দফতরের প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বলেছেন কথাটা। তবু সে উক্তি নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে এ কারণে যে, তার থেকে আওয়ামী শ্রেণীর চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া এখনকার আওয়ামী লীগ পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকের আওয়ামী লীগ নয়। দেশের মাটি কিংবা মানুষের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা এখন লুটেরা ও বাজিকরদের দল। তারা গদি কেড়ে নিয়েছে এবং সে গদি চিরস্থায়ীভাবে দখল করে রাখতে চায়। তা হলে দেশের সব অবশিষ্ট বিত্ত-সম্পদও লুট করে নেয়ার সুযোগ পাবে তারা। সে লক্ষ্যে তারা নতুন জাব্বা-জোব্বা ও লেবাস পরে নিজেদের নতুন ইমেজ সৃষ্টি করতে চায়। পুরাতন তাদের পায়ের নিগঢ়। পুরাতন তাদের বিব্রত করে। সে জন্য পুরাতনকে তারা নোংরা জামা-কাপড়ের মতোই পরিত্যাগ করতে চায়।
বীরেন শিকদার বলেছেন (২৯ অক্টোবর), ‘ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কোনো আশ্বাস আওয়ামী লীগ দেয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারেও চাকরি দেয়ার আশ্বাসের উল্লেখ নেই। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো আওয়ামী লীগ নেতা এমন কথা বলেননি।’ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতা এবং পরে দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতির কথা অস্বীকার করা আওয়ামী লীগের বরাবরের বৈশিষ্ট্য। নিজেদের ওপর তাদের বিশ্বাস অফুরন্ত। তারা জানে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতি দুর্বল। তার ওপর তারা নাৎসি টেকনিকে এক দিকে মিডিয়াকে পুরোপুরি ক্রয় কিংবা দখল করে নিয়েছে, অন্য দিকে তাদের গোয়েবলসরা হঠাৎ ঢাকনা খোলা পোকা-মাকড়ের টিনের মতো। কিলবিল করে তারা সব দিকে ছোটাছুটি করছে আর আবোলতাবোল বকছে। তাদের ভরসা দেশের মানুষ এসব শতমুখী পরস্পরবিরোধী প্রচারণায় বিভ্রান্ত ও উ™£ান্ত হয়ে যাবে, শাসকেরা এবং তাদের প্রচারযন্ত্র যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে তারা বাধ্য হবে। উপায়ান্তরও বিশেষ কিছু নেই তাদের। বাংলাদেশে যারাই সত্য কথা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে দুই-দশটা মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে, যেসব মিডিয়ায় দুটো-একটাও সত্যি কথা বলা হতো তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। শীর্ষ নেতানেত্রীরা রাতদিন টকশোর অংশ গ্রহণকারীদের যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করছেন, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামী টেলিভিশন আজো বন্ধ আছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে বন্দী করে রেখে, পত্রিকাটির ছাপাখানায় তালা লাগিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি। পত্রিকাটির অফিসে আগুন লাগিয়ে ছাই করে ফেলা সে পত্রিকার বিরুদ্ধে আক্রোশের সর্বশেষ পর্ব।
স্মৃতির দুর্বলতা এবং মিথ্যার রাজনীতি
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক স্মৃতি দুর্বল। সবাই উচ্চশিক্ষা কিংবা বুদ্ধিমত্তার অধিকারীও নন এবং আমাদের দেশের রাজনীতি গড্ডলিকা প্রবাহের মতো। নেতানেত্রীরা বিরাট বিরাট জনসভার ভিড়-ভাড়াক্কার মধ্যে যা বলেন সেটাকেই তারা দেববাক্য বলে বিবেচনা করে, জিন্দাবাদ ধ্বনি তোলে এবং উদ্দীপিত হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। নেতাদের সব প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে লেখা হয়েছে কি না, অথবা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি না, যাচাই করে দেখার ধৈর্য কিংবা বিজ্ঞতা তাদের থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতারা সেসব দুর্বলতার অপসুযোগ নিচ্ছেন মাত্র। বহু প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রেখে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের সাহস বেড়ে গেছে। রাতদিন ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর মিথ্যা কথা বলে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করছেন। মাত্র সেদিনের ব্যাপারই দেখুন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষাজ্ঞান তিন-চারটি ইংরেজি গালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি বললেন, যারা বলে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি, তারা ‘স্টুপিড’। কিন্তু তার দু-তিন দিন পরে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, সেতুর প্রস্তাবিত নির্মাণ স্থানের মাটি পরীক্ষার কাজ শুরু হচ্ছে মাত্র। মাটি পরীক্ষা আর নির্মাণকাজের মধ্যে যে পার্থক্য আছে অর্থমন্ত্রী যেন সেটাও বুঝতে অক্ষম।
বীরেন শিকদাররা অতঃপর অবশ্যই বলবেন প্রতি পরিবারকে একটি করে চাকরি ও একটি করে গাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি শীর্ষ নেতানেত্রীরা দেননি। তারা আরো বলবেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার, খাদ্যমূল্য হ্রাস করার এবং দুর্নীতি দূর করার, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতিও আওয়ামী লীগ দেয়নি। কিন্তু সাত হাজার মাইল দূরে বসে ইন্টারনেটে এই প্রতিশ্রুতিগুলো আমি বহুবার শুনেছি ও পড়েছি, আমার স্পষ্ট মনে আছে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথাও আমার পরিষ্কার মনে আছে। সে প্রতিশ্রুতিও আওয়ামী লীগ গিলে খেয়েছে। তাদের স্মৃতিশক্তি সুবিধামতো কাজ করে। প্রয়োজনে মনে আসে, আবার প্রয়োজনে ভুলেও যায় তারা।
স্মৃতির এই ক্ষণস্থায়িত্ব আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক পুঁজি। ক’দিন পরে বললেই হলো যে, ‘ও কথাটা’ আমি কিংবা আমরা মোটেও বলিনি। তাদের উক্তির সাথে বাস্তবতাকে মিলিয়েই দেখুন। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি হলো। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন তিনি সমুদ্র জয় করে ফেলেছেন। আজ্ঞাবহরা ও চাটার দল সেইসাথে ঢোল বাজাল। যারা তথ্য জানেন তারা পুরাতন মানচিত্রের সাথে নতুন মানচিত্র মিলিয়ে দেখলেন। দেখা গেল, নতুন মানচিত্রে বিশাল দক্ষিণ তালপট্টি চরটা ভারতের ভাগে চলে গেছে। সে কথা তারা বলতেই গোয়েবলসরা তেড়ে এলো, দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানানোর খেলা শুরু হয়ে গেল। বলা হলো, দক্ষিণ তালপট্টি নামে কোনো চর নেই এবং ছিল না।
কিছু লোক দারুণ অস্বস্তি বোধ করছেন। তাদের মনে আছে এ দ্বীপটার ভেসে ওঠার খবর প্রথম প্রচারিত হয়েছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে। মালিকানা নিয়ে তখন ভারতের সাথে মতানৈক্য ও বাদানুবাদ দেখা দিয়েছিল এবং বাংলাদেশ বিশ্ব মিডিয়া ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছিল। তার পর থেকে বিশেষজ্ঞরা বহু তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তার ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, দক্ষিণ তালপট্টির নিচে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ আছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চয়ই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন; অন্যথায় এ দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ অমন শক্ত অবস্থান নিত না।
মেঘনা মোহনার ঢেউ
‘দুর্বৃত্তের ছলের অভাব ঘটে না’। মন্ত্রীপাড়া এবং ‘জো- হুজুরদের‘ দিক থেকে কোরাসে ধ্বনি উঠল, সমুদ্রের ওখানটায় কোনো দ্বীপ নেই, আছে শুধু ঢেউ আর পানি। পলির দেশ বাংলাদেশের বদ্বীপ অঞ্চলে হাতিয়া-সন্দ্বীপ এবং ভোলা-মনপুরাসহ বহু দ্বীপ আছে। সেসব দ্বীপের উদ্ভব ও বিকাশ স্মরণকালের মধ্যেই ঘটেছে। প্রথমে ভাটার সময় অল্প অল্প করে মাটি দেখা গেছে, জোয়ারে আবার ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে দ্বীপটা পুরোপুরি মাথা তুলেছে পানির ওপর। মূল ভূমি থেকে মানুষ গিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছে। ফসল কেটে নিয়ে তারা আবার মূল ভূমিতে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসত। ক্রমান্বয়ে গাছ-গাছালি গজাল। সৃষ্টি হলো অরণ্য। কে জানে কোথা থেকে হিং¯্র বন্য প্রাণীরাও ভেসে এলো। সেসব অরণ্যে বসতি গাড়ল তারাও। ফসল নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ঘূর্ণিঝড়ে নৌকা ডুবে অনেক মানুষ মারা গেছে। বুনো পশুর হাতে প্রাণ দিয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। ছোটবেলা বহু কাহিনী শুনেছি এসব রোমান্টিক দ্বীপ নিয়ে। সত্তর সালের ঘূর্ণিপ্রলয়ের সময় সেসব কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে বিবিসির জন্য নাটক লিখেছিলাম ‘মেঘনা মোহনার ঢেউ’ নামে। সে বেতার নাটকে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের একজন সম্ভবত এখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি। সার কথা হচ্ছে সমুদ্র থেকে চর ওঠার সময় এরকমই হয়ে থাকে। চরগুলো রাতারাতি গড়ে ওঠে না। চরকে বাসযোগ্য হতে বহু বছর সময় লাগতে পারে।
যত দূর মনে পড়ে, মিয়ানমারের সাথে জলসীমা চুক্তির পরেও সমুদ্র জয়ের দাবি উঠেছিল। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? মিয়ানমারের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ভেতরে আসছে, আমাদের মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে তারা। শুনেছি সেসব মাছ বাংলাদেশের মাছ এবং চাঁদপুরের ইলিস বলেই বিদেশে রফতানি করছে। ঠিক একই কাণ্ড করছে ভারতীয় জেলেরা। প্রায়ই ইন্টারনেটে পড়ছি ডজন ডজন ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশের এলাকায় ঢুকে, মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী জেলেদের ধরা মাছ কেড়ে নিয়ে যাওয়ার খবরও পড়েছি দু-একবার। আর ঢাকায় বসে সরকার সমুদ্র জয় বলে ঢাক পেটাচ্ছে। ও দিকে ভারত আর মিয়ানমার বাংলাদেশের জলসীমার লাগোয়া এলাকাগুলোতে জোরেশোরে গ্যাসের সন্ধানে মেতেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ভূগোলের আইন মেনে চলে না। পাশের এলাকা থেকে আমাদের এলাকার গ্যাস শুষে নেয়া মোটেই কঠিন নয়।
শেখ হাসিনার বাবার নামে নাকি কৃত্রিম উপগ্রহ ওড়ানো হবে এবং সেটাও নাকি হবে মহাকাশ বিজয়। কিন্তু কৃত্রিম উপগ্রহ উড়িয়েছে এবং উড়াচ্ছে বহু দেশ বহু বছর ধরে। মহাকাশের কক্ষপথে এখন হয়তো কয়েক হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। আর কতকাল মহাকাশ বাংলাদেশের জন্য ‘অবিজিত’ থাকবে?
বাংলাদেশের ‘অবৈধ’ সরকারকে গৌরব দেয়ার জন্য অন্যদের বিজয়, তাদের সাফল্যগুলো কি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে হবে?
কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সমিতি প্রায় মূল্যহীন একটি আলঙ্কারিক সংস্থা। মাঝে মাঝে এ সমিতির নির্বাচনও হয়। সদস্যরা আপসে চেয়ারম্যান প্রভৃতি পদগুলোতে কাউকে নির্বাচিত করেন, প্রায় সময়ই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এসব নির্বাচনে প্রচারণা ও লবিং দূরের কথা, বাইরের লোক সে নির্বাচনের খবর জানতেও পারে না। এবারে সমিতির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের ‘অনির্বাচিত’ এবং ‘অবৈধ সংসদের’ অবৈধ স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। কিন্তু এবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। শিরীন শারমিন চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র তিন ভোটের ব্যবধানে। কমনওয়েলথের বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেশ বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা সম্বন্ধে জানে না। কিন্তু যারা জানে তারা বিরোধিতা করেছে। অনির্বাচিত সরকারের এবং শাসক দলের গোয়েবলসরা তার মধ্যেও বাংলাদেশের কমনওয়েলথ বিজয় আবিষ্কার করেছেন। হ্যাংলা আর লজ্জাহীন কাকে বলে!
বিব্রত ব্রিটেন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
কিন্তু সব বিজয়কে ছাড়িয়ে গেছে শেখ হাসিনার ‘বিশ্ব বিজয়’। অনেকে বলেছেন, আমিও বহুবার বলেছি, বাংলাদেশ তার ভালো লাগে না। মনটা হাঁপিয়ে উঠলে বিদেশের মুক্ত বাতাসের জন্য তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। ২০০৭-০৮ সালে বিদেশী চক্রান্তের বর্ণচোরা সামরিক সরকার যখন খালেদা জিয়াকে কয়েদ করে রাখে, শেখ হাসিনা তখনো বিশ্ব ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছিলেন। যেকোনো ছলছুতোয় বিদেশে পাড়ি জমানোর ফিকির খোঁজেন তিনি। তাও আবার দেড় শ’-দুই শ’ আত্মীয়স্বজন আর চাটুকার সাথে না নিলে তার মন ওঠে না। ফিরে এসে প্রতিবারই তিনি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন, নতজানু সাংবাদিকেরা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ব জয়ের রূপকথা লেখেন। আসলে তিনি যে জঙ্গিপন্থায় বাংলাদেশ জয় করলেন বিশ্বের কোথাও কেউ সেটাকে বৈধ বলে মেনে নিচ্ছে না। এই চিত্তজ্বালায় অস্থির হয়েই তিনি বিশ্বময় ছোটাছুটি করছেন, যদি কোনোমতে কারো উক্তিকে কিংবা যৎসামান্য ঋণ দানকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পাঁচ জানুয়ারির তামাশাকে নির্বাচন বলে প্রচার চালানো যায়।
গত জুলাই মাসে আফ্রিকায় মেয়েদের খাৎনা বন্ধ করা সম্বন্ধে আলোচনায় যোগ দিতে লন্ডনে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার পক্ষ থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে ‘সৌজন্য সাক্ষাতের’ অনুরোধ জানানো হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সে সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার মর্যাদা রক্ষা করা হয়নি। দাবি করা হয়েছে যে, পরোক্ষে হলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর এ ধরনের কোনো একান্ত বৈঠক সম্বন্ধে কোনো সংবাদ প্রচার করে না। কিন্তু তার ব্যতিক্রম করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বরং সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করার তাগিদই দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে।
তার পর থেকে আরো কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্রিটিশ কর্মকর্তাও সে কথাই বলেছেন। কয়েক দিন আগে ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী লিন ফেদারস্টোন গিয়েছিলেন ঢাকায়। তিন দিন বাংলাদেশ সফরের পর ফিরে আসার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আবার বলেছেন একই কথা : দ্রুত সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে। গত ২৯ অক্টোবর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদ লর্ডস সভায় বাংলাদেশের দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক সেমিনার হয়। বক্তারা পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে নাকচ করে দিয়েছেন, অবিলম্বে সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রভাবশালী এমপি সায়মন ডানকান তার বক্তৃতায় জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সাথে শেখ হাসিনার বৈঠকের প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, সে বৈঠকের জন্য ব্রিটেন দেশ হিসেবে বিব্রত বোধ করে। তিনি বলেন, একজন রাজনীতিক হিসেবে ক্যামেরন-হাসিনা বৈঠক তার নিজের ও ব্রিটেনের মানুষের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সায়মন ডানকান আরো বলেন, শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে বসায় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজেও অনুতপ্ত।
সবাই দ্রুত নির্বাচন দেখতে চায়
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন বহুবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দিতে তাগিদ দিয়েছেন। একই রকম তাগিদ দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের অন্যান্য কর্মকর্তাও। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ নয়। আমেরিকা অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক চায় এবং চাইবে। সে কথাকে ঘুরিয়ে যদি এই সরকার এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের স্বীকৃতি বলে দেখানোর চেষ্টা হয়, তাহলে সেটাকে ‘প্যাথেটিক‘ নির্লজ্জতা না বলে উপায় নেই। মার্কিন কর্মকর্তারা বহুবার বলেছেন, তারা ৫ জানুয়ারির তামাশাকে বৈধ নির্বাচন বলে স্বীকার করতে রাজি নন এবং তারা দ্রুত সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান। বস্তুত তাড়াতাড়ি সেরকম একটি নির্বাচন করার তাগিদ নিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই আগামী ২৭ নভেম্বর ঢাকা আসছেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও কয়েকবার প্রস্তাব পাস করে এবং বিবৃতি দিয়ে অবিলম্বে সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছে। মোট কথা সম্ভবত ভারত ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বর্তমান বাংলাদেশ সংসদ এবং শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধ বিবেচনা করে না।
দেশে ইসলামবিরোধী নীতি এবং বিদেশে ইসলামি বিশ্বের বিরোধী নীতির দরুন আরো কয়েকটি দেশের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক আশা নিয়ে এবং অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আমিরাত সফরে গিয়েছিলেন। চূড়ান্ত ইশতেহার থেকে দেখা যাচ্ছে, আমিরাত ঢাকায় একজন লেবার অ্যাটাশে নিয়োগ করবে। এই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর আমিরাত বিজয়।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির দণ্ড নিয়েও বর্তমান সরকার সারা বিশ্বের প্রতিবাদ এবং নিন্দা-সমালোচনার মুখে আছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর সময় থেকেই বিভিন্ন দেশ, বহু বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনবেত্তা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলেছে, যেভাবে তথাকথিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং যে প্রক্রিয়ায় এই ট্রাইব্যুনালের বিচার চলেছে তাকে কিছুতেই স্বচ্ছ কিংবা আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না এবং সবাই জানে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতকে সাথে নিয়ে জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে বাঁচাতে নির্বাচনে গিয়েছিল, ১৯৯৫-’৯৬ সালে যখন জামায়াতের সাথে গলাগলি করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালুর জন্য আন্দোলন করছিল, জামায়াত নেতাদের ‘যুদ্ধাপরাধের‘ কথা তখন তাদের মনে হয়নি। ট্রাইব্যুনালে এখন রায় দেয়া চলছে এবং সেসব রায় প্রায়ই হচ্ছে প্রাণদণ্ড। গত সপ্তাহে পরপর পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে। তার আগের এক দণ্ডে আবদুল কাদের মোল্লাকে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে।
সারা বিশ্ব কি এই সরকারের উপনিবেশ?
বিশ্বব্যাপী এখন জনমত প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে। মানবজাতির মানবতাবোধ এখন মধ্যযুগ থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রাণদণ্ড রহিতের অঙ্গীকার দেয়নি বলেই আমেরিকা, ক্যানাডা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো অভিযুক্তকে প্রত্যর্পণ করতে রাজি হয়নি। একই কারণে ব্রিটেন তারেক রহমানকেও প্রত্যর্পণ করবে না। এখন সাধারণভাবেই প্রাণদণ্ডকে অমানবিক নিষ্ঠুরতা মনে করা হয়। বিশ্বজনীনভাবে প্রাণদণ্ড রহিতের জন্য অবশিষ্ট দেশগুলোর ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের পর এসব প্রাণদণ্ড কার্যকর না করতে জোর দাবি জানিয়েছে। ব্রিটেনসহ ২৮টি দেশের ঐক্যজোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ ও মার্কিন সরকারও জানিয়েছে অনুরূপ দাবি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত সপ্তাহে পরদিন তিন দিন এসব প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
দুনিয়াজোড়া যারা বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করে, তাদের উপদেশকে শিরোধার্য করাই সুবুদ্ধির কাজ হতো। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সুবুদ্ধিপ্রসূত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। যারা বন্ধু হতে চায় গালিগালাজ করে দোরগোড়া থেকে তাদের বিদায় দেয়াকেই বেছে নেয় এই দল। প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় শেখ সেলিম মানবাধিকারকে আটলান্টিকের ওপারে রাখার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ বিশ্বজনীনভাবে সম্মানিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে ঝাঁটাপেটা করতে চান তিনি। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিশ্বব্যাংককে কান ধরে ওঠবোস করতে বলেন। অথচ এই বিশ্বব্যাংকই স্বাধীনতার সময় থেকে বাংলাদেশে সাহায্য ও বিনিয়োগের প্রধান উৎস। আর প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দাতা সংস্থা ও বন্ধু দেশ এবং বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যের বাজারকে এ দেশের ব্যাপারে নাক গলাতে নিষেধ করেন। হীত কথায় বলে ‘যে হাত খেতে দেয় সে হাত কামড়াতে নেই’। কিন্তু আওয়ামী লীগ শাসিত বাংলাদেশে হীত কথা কে শোনে?
মন্ত্রীদের দিক থেকে যেসব গোঁয়ার্তুমির কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয় সারা বিশ্বের দাবি ও প্রতিবাদ গ্রাহ্য করার ‘মুড’ সরকারের নেই। তার কারণও তাদের কথায় ও কাজে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্ব জাহান্নামে যায় যাক কিন্তু তাদের গদি দখলে রাখতে হবে। বিচারের নামে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিয়ে আর হাজার হাজার ভুয়া মামলায় জড়িয়ে বিএনপির নেতাদের জেলে পুরে রেখে তারা গদি বাঁচাতে পারবেন বলে আশা করছেন। ট্র্যাজেডি হচ্ছে দেশের যারা আসল মালিক সেই সাধারণ মানুষকে তারা ভুলে যাচ্ছেন। তারা যে তাদের চায় না মন্ত্রীরা সেটা মনে রাখলে ভালো করতেন।
প্রতিনিধিত্বমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে, বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের নামে তড়িঘড়ি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসিতে লটকানোর ইস্যুতে এই সরকার সারা বিশ্বের সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়েছে। তারপরেও বিশ্ব জয়ের দাবি হাস্যকর মনে হয় না কি? নাকি প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে তিনি গোটাবিশ্বকে তার উপনিবেশে পরিণত করেছেন?
( নয়া দিগন্ত )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন