মনে মনে ক্ষীর খাচ্ছেন আওয়ামী নেতারা। তবে বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, খুবই ত্রস্তে আছেন তারা। তারা জানেন, হাতে তাদের সময় বেশি নেই।
বুধবার ১০ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ চাইলে তিনি হরতাল বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতেও কারোই অসুবিধা হবে না আশা করি। শেখ হাসিনা জরুরিভাবে হরতাল-আন্দোলন বন্ধ করতে চান; কিন্তু বিপুল গরিষ্ঠ দেশবাসী তাতে সাড়া দেবে না। ও দিকে তার নিজের দল থেকেও সোচ্চার দাবি উঠছে না। দাবি যাতে ওঠে তার ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। শাসক দল, এ-দল ও-দলের নামে তিন শ’ সমর্থককে এ সংসদের সদস্য করে দেয়া হয়েছে। তার কাছে অনেক ঋণ তাদের। তাই ইচ্ছা পূরণের জন্য অবশ্যই অভীপ্সিত দাবিটি তুলতে হবে তাদের।
প্রশ্ন উঠবে, ‘জনগণ’ বলতে কী বুঝব আমরা? দেশের মানুষ জানে, নির্বাচনের ৫ জানুয়ারি তারিখের কয়েক দিন আগেই প্রশাসনিক ঘোষণার জোরে সংসদীয় গরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। অন্যেরাও নির্ধারিত তারিখে ভোটারবিহীন তামাশায় নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছেন। সুতরাং সুদৃশ্য সংসদ ভবনের ভেতরে বসে যারা এখন নর্তন-কুর্দন করছেন, সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের গালাগাল করছেন আর হুঙ্কার দিচ্ছেন, তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কারো প্রতিনিধিত্ব করেন না। জনগণের হয়ে কথা বলার অধিকার তাদের নেই; কিন্তু বিদেশীরা অতশত জানবে কী করে? আর অত গরজই বা তাদের কী? প্রধনামন্ত্রীও এখন বুঝে গেছেন, বর্তমান সময়ে দেশে একমাত্র রাজনীতি বিদেশীদের হাতে। তাদের যদি ধারণা দেয়া যায়, যারা এখন সংসদে বসেছেন, তারা অবশ্যই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনÑ যেমন ব্রিটেনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ সদস্যদের জনপ্রতিনিধি মনে করা হয়Ñ তাহলে সরকারের অভীপ্সার ৮০-৯০ শতাংশ পূরণ হয়ে যাবে।
তর্ক-বিতর্কের ঝড় তুলে আর ধানাইপানাই করে ৫ জানুয়ারির পরেও নয়টি মাস আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। এ দিকে লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, অবৈধ সংসদে আইন পাস করার হিড়িক পড়ে গেছে; কিন্তু তার প্রকৃত কারণ সবাই বুঝতে পেরেছেন কি? কারণ হচ্ছে সরকার নিজেই বুঝে গেছে, বিশ্বের কোথাও কেউ (শুধু ভারত ছাড়া) সংসদ ভবনের বর্তমান তামাশগিরদের (তামাশা সৃষ্টিকারী) বৈধভাবে নির্বাচিত সংসদ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী তাই মনে মনে হয়তো সাব্যস্ত করে ফেলেছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে কোনো প্রকারের একটা নির্বাচন তাকে দিতেই হবে। সেই সাথে এটাও হয়তো স্থির করা হয়েছে যে, ক্ষমতা তার দল ছাড়বে না। সুতরাং নির্বাচনের প্রকার ও প্রকৃতিকে সরকার নতুন করে ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত।
প্রস্তুতিপর্বে গোড়াতেই সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণের আইন করা হচ্ছে। তারপর আসছে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য সংসদীয় অভিশংসন আইন। বাকশাল করার সময় রাষ্ট্রীয় ফরমানবলে সব বেসরকারি পত্রপত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী তার কী তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে, শেখ মুজিব কল্পনা করতে পারেননি। তখন, এমনকি লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরের ভিআইপি স্যুইটে হলভর্তি ব্রিটিশ ও অন্যদেশীয় সাংবাদিকদের সামনে আমার সাথে তার প্রকাশ্য বিতর্ক উপস্থিত সাংবাদিক মহলে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে তখন মুক্ত মিডিয়া বলতে কিছু ছিল না; কিন্তু দেশের মানুষ কেমন ুব্ধ হয়েছিল, পরবর্তীকালে প্রতিক্রিয়া থেকে সেটা বেশ বোঝা গেছে।
নদীর ভাঙন এবং কিস্তিবন্দী মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ
অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এই একটি ব্যাপারে আওয়ামী লীগ শিক্ষা নিয়েছে মনে হয়। মিডিয়ার বিরুদ্ধে থোক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে তারা কিস্তিতে কিস্তিতে মিডিয়ার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছেন, যেমন করে নদী কূল ভেঙে ভেঙে গোটা জনবসতিকেই গিলে খায়। প্রথমেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্যাডারদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করাই ছিল উদ্দেশ্য। বহু সাংবাদিক দৈহিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। মাঝে মাঝে কলাম লেখেন বলে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্্র ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মাত্র। ক্রমে ক্রমে সাংবাদিকদের হত্যাও শুরু হয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও তার স্বামী সাগরের হত্যাকাণ্ডের খবর সারা বিশ্বের মানুষ জেনে গেছে। এরপর শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়াকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার। আইনের নামে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিনাবিচারে জেলে আটক রাখা হয়েছে দুই বছর হতে চলল। শুনেছি মাঝে মাঝেই তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তার পত্রিকা আমার দেশের প্রকাশ বন্ধ তখন থেকে। সাজানো অভিযোগে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িক বন্ধ করা অথবা বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে।
ইলেকট্রনিক মিডিয়াও সরকারের কোপ এড়াতে পারছে না। টকশোগুলোতে কাকে আমন্ত্রণ করা যাবে, কাকে যাবে না, সে সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশ আসে বলে শুনেছি। তারা বিভিন্ন টকশোর হোস্ট বা অতিথির বিরুদ্ধে অযাচিত ও অমূলক সমালোচনা করেছেন। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টেলিভিশন তো এখনো বন্ধ। এ নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য হয়নি। অনেকেই জানেন একের পর এক অনলাইন সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কিছুকাল আগে সোনারবাংলাদেশডটকম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা বরাবরই ছিল উদ্দেশ্য। এখন ছুরির আগার খোঁচার পরিবর্তে কুড়ালের ঘা আসছে। সম্প্রচারের ওপর টেনে ধরা রাস আরো শক্ত করার জন্য সম্প্রচার আইন হচ্ছে। লক্ষ্য হচ্ছে, পরিকল্পিত ‘নির্বাচনী তামাশা‘ সম্বন্ধে দেশের কিংবা বিদেশের মানুষ যেন বিশেষ কিছু জানতে না পারে। এ আইন পাস হলে বাংলাদেশে সংবাদের স্বাধীনতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। এমনি করে মতামত প্রকাশের অধিকারকে পদদলিত করেছিল বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারীরা।
সরকারের পুতুল খেলা
সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বে¡ও আদালতের সম্পূর্ণ দলীয়করণ তারা এখনো করতে পারেননি। এ সরকারের আগের কিছু বিচারপতি এখনো বহাল আছেন। বিশেষ করে পরিকল্পিত নির্বাচন প্রসঙ্গে আদালতের দিক থেকে কোনো সমালোচনা সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এমন নয় যে, আদালত ও আইনি পদ্ধতি সম্বন্ধে তাদের শ্রদ্ধাবোধ আছে। সম্প্রচার আইন করে দেশের ভেতরের জনমতকে অবশ্যই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখানোর আয়োজন করা হয়েছে। সরকার কী করছে, তা জানতে না পারলে দেশবাসী কী করে সরকার সম্বন্ধে মতামত গঠন করবে? সে ক্ষেত্রে সমালোচনা কিংবা বিরোধিতার প্রশ্নই উঠবে না; কিন্তু কোনো বিচারপতি বিরূপ রায় দিলে বিদেশীরা সেটা নিয়ে হইচই করতে পারে। বিদেশীদের চোখ ঠারার জন্যই সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে বলে মনে হয়। তাদের স্বীকৃতি পাওয়া না গেলে গদি আঁকড়ে থাকা কঠিন হবে। এসব সম্ভাবনার পথ বন্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংবিধানের আরো একটি সংশোধন এবং অভিশংসন আইন দিয়ে ঘাড়ের ওপর ডেমোকিসের তরবারি ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিজের লোক দিয়ে গঠিত সংসদকে বিচারপতিদের ‘বিচার’ ও বরখাস্ত করার অধিকার দেয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশ ও অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হলে বিনা ঝামেলায় পদক্ষেপ নেয়া যাবে।
ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম খুকুমণিরা গভীর মনোনিবেশসহকারে কাদা কিংবা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পুতুল তৈরি করছে; কিন্তু সে ধৈর্য বেশিক্ষণ টিঁকে থাকছে না। কোথাও কিছু মনমতো না হলে, কিংবা খেলার সাথীদের কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে সেই পুতুল ভেঙে কিংবা ছিঁড়ে খুকুমণি ছুড়ে ফেলে দিলো। হয়তো খেলার আসর থেকেও উঠে গেল। বাংলাদেশে কেউ কেউ ‘খুকুমণি মনস্তত্ত্বে’ ভুগছেন বলেই মনে হয়। সংবিধানকে খেলার ছলে রদবদল করা হচ্ছে। স্বাধীন নির্বাচন হলে হেরে যাবে। অতএব, বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি এবং দেশকে অচল করে দেয়ার কৌশল নেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে দেশের সর্বনাশ এড়ানোর লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান রাখার দাবি মেনে নিলেন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্ব¡াবধায়ক পদ্ধতি চালু করা হলো।
বিজয়ের গ্যারান্টি চেয়েছিলেন
কিছুকালের মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রমাণ পেল যে, তত্ত্ব¡াবধায়ক পদ্ধতিও তাদের নির্বাচনী বিজয়ের যথেষ্ট গ্যারান্টি নয়। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের নির্বাচনে শোচনীয় রকম হেরে গিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী দেশবাসী তা এখনো ভুলে যায়নি, আশা করি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী ইত্যাদি যা-তা বলে গালি দেয়া হয়েছিল। তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের তত্ত্ব¡াবধায়ক পদ্ধতিপ্রীতির অকালমৃত্যু হয়েছে।
পরবর্তী পাঁচ বছর সে পদ্ধতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্ষোভ দিনে দিনে তীব্র হয়েছে। একটানা সংসদ বর্জন, ১৭৩ দিন হরতালসহ প্রতিবাদের কোনো পন্থাই বাদ যায়নি। লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলনের কথা ভুলে গেছেন কেউ? মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের প্রধানের কাছে খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সেই দিনই বিকেলে আওয়ামী লীগের ডাকে দেশের সব অঞ্চল থেকে লগি-লাঠিধারী যুবকদের শত শত বাসে রাজধানীতে আনা হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে তারা পল্টনে জামায়াত সমর্থক দাবি করে কয়েকজনকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারে। পরবর্তী কয়েক দিনে রেললাইন উপড়ানো হয়েছে, সড়ক, সেতু ও বন্দর অবরোধ করে দেশের অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়া হয়েছে, আরো অনেক লোককে লাঠিপেটা করে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি বঙ্গভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে সপরিবারে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে অসহায় অবস্থায় গৃহবন্দী করার হুমকি দেয়া হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন কয়েকটি অশুভ নক্ষত্রের শ্মশাননৃত্য চলছিল। একখানি ইংরেজি ও একখানি বাংলা দৈনিক ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের আশায় ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের সাথে হাত মেলায়। পেছন থেকে এ চক্রকে ইন্ধন দিচ্ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন। অধুনা জানা গেছে, ফাঁকতালে নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হওয়ার সখ ছিল তার। এ চক্রের চাপে রাষ্ট্রপতি তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে বাধ্য হন। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদকে এনে ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের ‘প্রধান উপদেষ্টা’ করা হয়। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে শেখ হাসিনার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তিনি বরাবরই এ বলয়ে ছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, এই বর্ণচোরা সামরিক সরকার ‘তারই আন্দোলনের ফসল’। আরো বলেছিলেন যে, ক্ষমতা পেলে সে সরকারের সব কাজকর্ম তিনি বৈধ করে দেবেন।
থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে
অশুভ নক্ষত্রদের নানা কূটকৌশলে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ‘জয়ী‘ হয় এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। তখন থেকেই শুরু হয় গণতন্ত্র বিদায় করে পেছনের দরজা দিয়ে বাকশালকে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা। খুবই বিতর্কিত একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ততোধিক বিতর্কিত রায়ের একাংশের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলবিবর্জিত সংসদে সংবিধান নিয়ে আরো একবার পুতুল খেলা চলে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা হয় পঞ্চদশ সংশোধনীতে। বিরোধী দলগুলো তখন প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন একপর্যায়ে এতই বেগবান হয় যে, সরকারের পতন আসন্ন মনে হচ্ছিল। এক দিকে বিদেশীদের চাপ, অন্য দিকে নিজ দলের ভেতরের ছলনায় খালেদা জিয়া আন্দোলনে ঢিলে দিয়েছিলেন। জানতে ইচ্ছে করে, জিরিয়ে জিরিয়ে আন্দোলন করা সম্বন্ধে এখন তিনি কী ভাবেন?
গদি দখলের পরপরই অর্ধশিক্ষিত (কথাবার্তায় তাই মনে হয়) একজন প্রতিমন্ত্রীর অধীনে কমিটি করে প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি থেকে হত্যা পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে দায়েরকৃত, সোয়া সাত হাজার মামলা তুলে নেয়া হয়েছিল। এখন আবার পাইকারি হারে (পদ্মা সেতু দুর্নীতি ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক দ্বারা অভিযুক্তরাসহ) মন্ত্রীদের ধুয়েমুছে তুলসীপাতা করে দিয়েছে অথর্ব দুদক। অন্য দিকে খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো অভিযোগের মামলাগুলোতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্য সরকার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সে উদ্দেশ্যে সংবিধান নিয়ে আরেক দফা পুতুলখেলা চলছে।
দ্রুত এই ষোড়শ সংশোধনীটি পাস করার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী যেন তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ও দিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘এবডো’ (নির্বাচিত পদের জন্য অযোগ্যতা অধ্যাদেশ) প্রয়োগসংক্রান্ত কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে। থলের বিড়াল পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে, ডেমোকিসের খাঁড়ার ভয়ে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে। তারপর এবডো ব্যবহার করে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে এবং নতজানু নির্বাচন কমিশন তাদের প্রার্থী হতে দেবে না। এমতাবস্থায় ‘দুই নৌকার’ নেতারা তো লাফ দিয়ে শেখ হাসিনার কাতারে আশ্রয় নেয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়।
খালেদা জিয়া এখন কী করবেন?
কী করবে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল? আন্দোলন করবেন তারা? হরতাল-আন্দোলন নিষিদ্ধ করার কথা যে সরকার ভাবতে শুরু করেছে, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি থেকেই সেটা স্পষ্ট। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে সরকার তো প্রস্তুত হয়েই আছে। পৌনে ছয় বছরে পুলিশ বাহিনীর কলেবর আড়াই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা কোনো গোপন কথা নয় যে, নবনিযুক্ত এবং পদোন্নতি প্রাপ্তরা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে এ রকম : আরো একবার গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে হয়তো একদলীয় ব্যবস্থা চালু হবে এবং আজীবন রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বিধানও থাকতে পারে। বিরোধীদলীয় নেতাদের বেশির ভাগকে জেলে পুরে রাখা হতে পারে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হবে না তাদের। আওয়ামী শিবিরে গিয়ে সুবিধাবাদীরা দুর্নীতি করার সুযোগ পাবেন। নেতৃত্ববিহীন দেশের মানুষকে আন্দোলন করতে দেয়া হবে না। যেন প্রতিবাদও করতে না পারে, সে জন্য তো সম্প্রচার আইনই করা হচ্ছে। নির্বাচনী বিজয়ের এই সুনিশ্চিত টেকনিকটা ক্ষমতাসীনেরা প্যাটেন্ট করে বাজারে ছাড়তে পারেন। ( নয়া দিগন্ত )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন