এয়ার মার্শাল এ কে খোন্দকার সৎ সঙ্গে আছেন। একটি অবৈধ সংসদে তার নতুন প্রকাশিত বই নিয়ে যারা গালিগালাজের তা ব করেছেন, কিচিরমিচির করে তার বই নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন এবং যে মন্ত্রী তার বই পুড়িয়েছেন তাদের দৃষ্টান্ত মধ্যপ্রাচ্যেও কোনো কোনো দেশে মেলে। নিকটজন কেউ মারা গেলে নিজেদের, এমনকি পারিবারিক শোকও তাদের যথেষ্ট মনে হয় না। ঋণ করে হলেও তারা শোক দেখানোর জন্য লোক ভাড়া করে আনেন। নইলে পাড়া-পড়শির কাছে মান বাঁচে না।
আমি হলফ করে বলতে পারি দু’একজনের বেশি মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য আদৌ বইখানি পড়েননি। পড়লেও বোঝার ক্ষমতা বড়জোর অল্প কয়েকজনেরই থাকতে পারে। এ কে খোন্দকার যে সময়ের ইতিহাস লিখেছেন, এ বইতে সে সময় এসব মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে প্রাইমারি স্কুলেও ভর্তি হননি। তখন যা সত্য ছিল কিংবা ছিল না, তারা তা জানবেন কী করে? বইয়ের কিছু কথা প্রভুর পছন্দ হয়নি, সে রকম শোনা কথাই তাদের জন্য যথেষ্ট। পুতুলের স্প্রিংয়ে দম দেয়া হয়ে গেছে, সুতরাং সে পুতুল নর্তন-কুর্দন করবেই।
‘বাপে যারে ভরম (সম্ভ্রম) করে, পূতে তারে নরোম করে’, অতি পরিচিত বাংলা প্রবাদ। বর্তমান বাংলাদেশে এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. কামাল হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, শেখ মুজিবুর রহমানের আইন উপদেষ্টা ও বন্ধু ছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মুজিবের সাথে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি নেতার সাথেই লন্ডনে ফিরেছেন, মুজিব সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকলে তার অবশ্যই জানার কথা ছিল। তা ছাড়া শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশাতেই যে মুজিব সমূহ বিপদের মুখে দেশবাসী, নিজের দলের নেতা ও কর্মীদের ফেলে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন, সেটাও ড. কামাল হোসেন জানতেন। সে জন্যই তিনি মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে রাজি হতে পারেননি। সে কারণে শেখ হাসিনা অত্যন্ত দুঃখজনক ভাষায় বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন দফায় ড. কামাল হোসেনকে গালাগালি করেছেন।
সেই ৭ জানুয়ারি ভোরে ড. কামাল হোসেন লন্ডন বিমানবন্দর থেকে সরাসরি এবং সপরিবারে ভগ্নিপতি আমান উল্লাহ খানের সাথে তার বাড়িতে চলে যান, আর ভারতের হাইকমিশনার আপা ভাই পন্থ বিমানবন্দর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর থেকে খবর পেয়ে আমি সোজাসুজি ক্যারিজেসে চলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশী হিসেবে আমাকে মুজিব ভাই প্রথম দেখেছিলেন। পাকিস্তানে তাকে এ ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশকে তার দাবি অনুযায়ী পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। সুতরাং দেশে ফিরে উগ্রপন্থী কর্মীদের শায়েস্তা করা তার কর্তব্য হবে। দেশ যে স্বাধীন হয়েছে সে খবর সর্বপ্রথম আমি তাকে দিয়েছিলাম। শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন তিনি। আমিও কেঁদেছি তার সাথে। ততক্ষণে আরো কয়েকজন বাংলাদেশী এসে পড়েছিলেন। তারা সবাই সাক্ষী ছিলেন সে ঘটনার। সেদিন বিবিসি থেকে তার মুক্তির খবর প্রথম প্রচার করেছিলাম আমি। তার আগে মুক্তিযুদ্ধের আনুপূর্বিক বিবরণ তাকে দিয়ে যাই। আমি তাকে এও বলেছিলাম যে, শহীদানের সঠিক হিসাব কেউ রাখেনি, তবে বিভিন্ন মহলের প্রচারিত খবর খুবই সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে বিবিসিতে আমরা অনুমান করেছি যে, তিন লাখ লোক শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান ভ্রমণকান্ত, নিদ্রাকাতর এবং আকস্মিক অপ্রত্যাশিত খবরে উদভ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত ছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসব কারণেই মুহূর্তের স্খলনে ডেভিড ফ্রস্টকে তিনি তিন লাখের পরিবর্তে তিন মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন। ২০১১ সালের ২৩ মে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে উপরিউক্ত তথ্যগুলো আমি প্রকাশ করি।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিশ্বাসের তিন খুঁটি
তার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিবালয় থেকে প্রকাশিত প্রেস নোটে কার্যত আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আমার বক্তব্য উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। শুধু তাই নয়, লন্ডনে নিযুক্ত বর্তমান ও সাবেক প্রেস মিনিস্টারদ্বয়কে দিয়ে গার্ডিয়ানে এবং ডেইলি স্টার পত্রিকায় লেখানো বিস্তারিত প্রবন্ধে বলা হয় যে, আপা ভাই পন্থ শেখ মুজিবকে অভ্যর্থনা করতে বিমানবন্দরে যাননি। আরো দাবি করা হয় যে, আমি মোটেই ক্যারিজেস হোটেলে যাইনি, সেবার মুজিবের সাথে আমার দেখাও হয়নি। ক্যারিজেস হোটেলে প্রায় ২০০ সাংবাদিকের আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলনে মাইক্রোফোন হাতে শেখ মুজিবের গা ঘেঁষে যে আমি বসেছিলাম ডকুমেন্টারি ফিল্ম এবং ভিডিওতে সেটা পরিষ্কার। কিন্তু মিথ্যাকে সত্যি এবং সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার ব্রত নিয়ে যেন তারা ক্ষমতায় গেছেন।
বর্তমান সরকার তিনটি অসত্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ শাসনের রাজকীয় অধিকার দাবি করে। অন্তত শেখ হাসিনার বিবেচনায় এগুলো আওয়ামী ধর্মবিশ্বাসের ঈমানের অঙ্গ। এ তিনটি অসত্য হচ্ছে : শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের যেসব নেতা পালিয়ে গিয়ে ভারত সরকারের আতিথেয়তা ভোগ করছিলেন কিংবা ভারতের মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তারাই হচ্ছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের ভেতরে থেকে যেসব সেনা অফিসার বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, যে ছাত্র-জনতা তাদের অধীনে সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছেন, যেসব নারী নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছেন এবং যেসব সাধারণ মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ও প্রাণ দিয়েছেন তাদের কেউ মুক্তিযোদ্ধা নন। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, লে. জে. মীর শওকত আলী, কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, মেজর এম এ জলিল, এমনকি জেনারেল সফিউল্লাহকে পর্যন্ত রাজাকার বলে অভিহিত করেছে। দেশে ও বিদেশে যারা প্রচারণা, আন্দোলন ও অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় সম্ভব ও সহজ করেছেন তাদের কারো স্বীকৃতি নেই এ দল ও এ সরকারের কাছে।
সর্বশেষ তাদের কাতারে শামিল হয়েছেন এয়ার মার্শাল এ কে খোন্দকার। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন উপপ্রধান সেনাধ্যক্ষ। পরে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া আর নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি। এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের যত দিন বৈধতা ছিল (৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত) তত দিন তিনি সে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগের ঈমানের তিনটি খুঁটির কোনো কোনোটির সমালোচনা করেছিলেন তার বইতে। সুতরাং আওয়ামী লীগের বিচারে তিনি ধর্মত্যাগীÑ ক্ষমার অযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের আরো অনেক নায়কের মতো তাকেও সরকার ও শাসক দল রাজাকার অপবাদ দিয়ে দিয়েছে। বাইবেলে ‘চোখের বদলে চোখ’ প্রতিশোধের কথা বলা হয়েছে। নামটা মনে নেই, কিন্তু একজন মনীষী বলেছেন, সবাই যদি পরস্পরের চোখ উপড়ে ফেলে, তাহলে দেশটা শিগগিরই অন্ধের দেশে পরিণত হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং যারা সে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, একে একে তাদের সবাইকে যদি রাজাকারের দলে ঠেলে দেয়া হয় তাহলে জাতির গৌরব করার জন্য অবশিষ্ট থাকবেন কারা? একে একে সব প্রদীপ যদি নিভিয়ে দেয়া হয়, তাহলে মরণপুরীর অন্ধকার সৃষ্টি হয় না কি?
এক বৃক্ষের অরণ্য
কয়েক বছর আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত কলামে লিখেছিলাম যে, শেখ হাসিনা এক বৃক্ষের অরণ্য সৃষ্টি করতে চান, যে অরণ্যে একটি মাত্র বিশাল বৃক্ষ থাকবে। সমস্যা হচ্ছে ঝড় যদি ওঠে তাহলে সে বৃক্ষটি ‘পপাৎ ধরণীতলে’ হতে বিলম্ব হবে না। অরণ্যে শত বৃক্ষ থাকে বলেই প্রচণ্ডতম ঝড়েও বহু বৃক্ষ অক্ষত থাকে। শেখ হাসিনা চান যে বাংলাদেশে তার পিতাই একমাত্র নায়ক, একমাত্র সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে অবশিষ্ট থাকবেন। তার পরিণতিও এখন সবার চোখের সামনে। শেখ মুজিবুর রহমানের বহু ভুলত্রুটি বাংলাদেশের মানুষ ভুলতে চলেছিল। স্বাধীনতার আন্দোলনে তার নেতৃত্বের কথা স্মরণ করে ধীরে ধীরে তিনি জাতির পিতার মর্যাদা ফিরে পেতে চলেছিলেন। বিগত প্রায় ছয় বছর ধরে পিতাকে এক বৃক্ষের অরণ্যের আসনে বসাতে গিয়ে শেখ হাসিনা বরং তার স্মৃতিকে সব সমালোচনার ঝড়ের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। বহু তথ্য জানা সত্ত্বেও যারা এতকাল ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের সমালোচনা করেননি, তারাও এখন এয়ার মার্শাল খোন্দকারের মতো এতকালের চাপা দিয়ে রাখা তথ্যগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। তাদের এখন অনেক বয়স হয়েছে, মৃত্যুর আগে তারা অন্তত কিছু সত্য প্রকাশ করে যেতে চান।
এয়ার মার্শাল এ কে খোন্দকারের বইখানি এখনো পড়ার সুযোগ পাইনি। এই সুদূরে বাংলাদেশের বই সংগ্রহ করা প্রায়ই সময়সাপেক্ষ। সুতরাং সে বইয়ের ওপর প্রেক্ষিত দৃষ্টিপাত আমি করতে যাব না। শুনেছি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে সে বই, লোকে ভিড় করে কিনছে, আত্মীয়-বন্ধুদের উপহার দিচ্ছে। কিন্তু বইখানি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে ওঁছা বইও হতো তাহলেও যে মন্ত্রী সে বই পুড়িয়েছেন, যেসব মন্ত্রী ও অবৈধ এমপি সে বই বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানাচ্ছেন, তাদের আমি নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষের কাতারে ফেলব। বই পুড়িয়ে মানুষের চিন্তা ও মননশীলতাকে হত্যা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন অ্যাডলফ হিটলার; কিন্তু কোথায় এখন সে হিটলার? কোথায় তার নাৎসিবাদ? মানবজাতি এখন একবাক্যে তাকে ‘স্টুপিড‘ বলে রায় দেয়। গুম, খুন আর হত্যা দিয়ে যারা মন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন, ইতিহাস থেকে অন্তত কিছু শিক্ষাও তাদের নেয়া উচিত ছিল।
বই বাজেয়াপ্ত করায় শেখ হাসিনার অরুচি আছে বলে আমি মনে করি না। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েই ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইখানি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন তিনি। সে বই লিখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টু। তিনি ও তার স্ত্রী বছরের পর বছর শেখ হাসিনার অন্দর মহলের সহকারী ছিলেন; কিন্তু রেন্টুর বইয়ের অজস্র ফটোকপি বাজারে বিক্রি হয়েছে এবং এখনো বিক্রি হয়। বইখানি নিষিদ্ধ না হলে তার এক-শতাংশ কপিও বিক্রি হতো কি না সন্দেহ। শেখ হাসিনা এখন মতামত স্তব্ধ করার, সত্যকে চাপা দেয়ার ভিন্ন পথ ধরেছেন। তিনি দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছেন, চ্যানেল ওয়ানকে নির্বাক করে দেয়া হয়েছে। তিনি সাজানো অভিযোগে এবং বিনা বিচারে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করে রেখেছেন দু’বছর হতে চলল, আমার দেশ পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করা হয়েছে, আরো পত্রিকা বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে, মিথ্যা মামলায় জড়ানো আর দৈহিক নির্যাতন করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। তাতেও মন উঠছে না এই সরকারের। সত্য প্রকাশ অসম্ভব করে তোলার জন্য নতুন আইন করা হচ্ছে; কিন্তু সত্য এমন এক বস্তু যা কখনো-না-কখনো সব অন্তরাল ডিঙিয়ে প্রকাশিত হবেই। সরকার সূর্যের আলোকে শিকলবন্দী করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে মাত্র।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন