এই কলাম যখন লিখতে বসেছি, গাজায় ইসরাইলি হামলা তখন ৩৫ দিনে পড়ল। মাঝে ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। ইসরাইলিরা মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু গাজার প্রধান রাজনৈতিক দল হামাস তাতে রাজি হয়নি। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে যুদ্ধবিরতির অর্থ হতো তাদের মৃত্যুদণ্ড এবং ইসরাইলের গণহত্যা কিছু দিন স্থগিত করা মাত্র। গাজাবাসী সঠিক অর্থেই খাঁচার মধ্যে বাস করছে। উত্তর আর পূর্ব দিকের ফটকগুলো ইসরাইলিরা তালা-কুলুপ দিয়ে বন্ধ রাখে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরে সর্বক্ষণের ইসরাইলি নৌপাহারা। এখানেই সৈকতে খেলতে গিয়ে গাজার চারটি শিশু ইসরাইলি জাহাজের শেলের ঘায়ে মারা গিয়েছিল। দক্ষিণে রাফায় যে ফটক আছে, মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির স্বল্পকালীন আমলে সে ফটক খুলে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইসরাইল-বান্ধব সাবেক সেনাপ্রধান আবুল ফাত্তাহ আল সিসি গদি দখল করে সে ফটকটি আবার বন্ধ করে দিয়েছেন। গাজাবাসী জানে, স্বল্পকালীন যুদ্ধবিরতি করে ইসরাইল তার প্রায় শূন্য হয়ে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডার নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।
হামাস এবং গাজাবাসীর এ অভিজ্ঞতা নতুন নয়। বিগত ছয় বছরে এটা তাদের বিরুদ্ধে জায়নিস্ট রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বাত্মক আক্রমণ। দুই বছর আগের যুদ্ধে প্রায় এক হাজার ২০০ গাজাবাসী প্রাণ হারিয়েছেন। ২০০৮-০৯ যুদ্ধেও গাজার কাছাকাছি-সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরাইল; কিন্তু তখন তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি। খুশিতে তারা (এবং বিদেশে তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা) বগল বাজাচ্ছিল। এবারে কিন্তু ওয়াক-ওভার পায়নি তারা। সত্যি বটে, তারা ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, প্রায় ৬৫ হাজার ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং গাজার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশকে বাস্তুহারা করেছে। এও সত্যি যে, ১০ থেকে ১২ হাজার গাজাবাসীকে তারা জখম করেছে; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গাজার মানুষ এখন মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে। এ দফার যুদ্ধে দেখা যাচ্ছে, গাজাবাসী শুধু মরতেই নয়, মারতেও শিখেছে। তারা ৬৫ জন ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যা করেছে, আহত করেছে প্রায় এক হাজার ৬০০ জনকে। গোটা ইসরাইলজুড়ে হাহাকার আর আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইলিরা অন্যের প্রাণ নিতে এবং ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরাতে ভালোবাসে; কিন্তু নিজেদের প্রাণ এবং রক্ত দিতে তাদের বড়ই ভয়, বড়ই আপত্তি। হামাসের এতকালের বৈশিষ্ট্য ছিল রকেট তৈরি করতে পারার দক্ষতা। দেখা যাচ্ছে, এখন তারা ইসরাইলি সৈন্য হত্যার কৌশলও আয়ত্ত করেছে।
৬৫ জন সৈন্য হারানো এবারের যুদ্ধে ইসরাইলির প্রধান ক্ষতি নয়। জায়নিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এবারে যেমন প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়েছে, আগে আর কখনো ঘটেনি। বিগত শতকের চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে নানা রকম অত্যাচার করেছে, লাখে লাখে ইহুদি পালিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছে, আর হিটলারের বন্দিশিবিরগুলোতে হাজার হাজার শিশুসহ কয়েক লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ইতিহাস নিয়ে ইহুদিরা বিশ্ববাসীকে ব্ল্যাকমেইল করে এতকাল বলতে গেলে সব কিছুই আদায় করে নিয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ব্যালফোরের কাছ থেকে তারা প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল যে, যুদ্ধ শেষে আরবদের দেশ ফিলিস্তিনে পূর্ব ইউরোপের ইহুদিদের জন্য একটা ‘স্বদেশ’ তৈরি করে দেবে। যুদ্ধ শেষে মূলত পোলিশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং অবৈধভাবে ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আমদানি করতে থাকে। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনের বিশেষ অংশে প্রস্তাবিত ইসরাইল রাষ্ট্রের একটা চৌহদ্দি বেঁধে দেয়; কিন্তু সে চৌহদ্দি মেনে নেয়া কখনোই ইসরাইলের উদ্দেশ্য ছিল না।
উড়ে এসে জুড়ে বসা ও উটের নাক বাঁচানো
গল্পে আছে, শীতের রাতে উট তাঁবুতে নাক গোঁজার অনুমতি ভিক্ষা করেছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল ঠেলাঠেলি করে উট গোটা তাঁবুই দখল করে নিয়েছে, আর বেচারা মালিক চাদর মুড়ি দিয়ে বাইরের শীতের বাতাসে ঠকঠক করে কাঁপছে। ফিলিস্তিনেও ঘটেছে সে রকম ব্যাপার। ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং ’৪৮ সালেই তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা দিয়ে আট লাখ ফিলিস্তিনিকে উৎখাত করে তাদের ভিটেবাড়ি ও জোতজমি দখল করে নিয়েছিল। তারপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রায় সবটাই দখল করে নিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ কয়েকটি প্রস্তাবে দখলীকৃত আরব ভূমি থেকে সরে যেতে ইসরাইলকে নির্দেশ দেয়; কিন্তু সরে যাওয়ার পরিবর্তে ইসরাইল দখলীকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু করে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিবাদে বাধ্যতামূলক প্রস্তাব পাস করতে চেয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ফল হয়েছে এই যে, পশ্চিম তীরের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি টুকরো এবং গাজা ছাড়া গোটা ফিলিস্তিনেই এখন ইসরাইলিরা বসবাস করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা এখন মোটামুটি ৩০০ মিলিয়ন। তার ভেতর ইহুদি নাগরিকেরা ১০ মিলিয়নেরও কম; কিন্তু মার্কিন অর্থনীতি বলতে গেলে সম্পূর্ণরূপে তাদের হাতের মুঠোয়। সেই সাথে মিডিয়া ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও। তাদের প্রভাব এখন এতই ব্যাপক যে, ইসরাইলি লবিগুলোর আপত্তি ডিঙিয়ে কোনো আইন পাস করার, এমনকি গদিতে টিকে থাকাও কোনো প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রিটেনের মোট ৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা তিন লাখেরও কম; কিন্তু অর্থনীতি ও মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণের কারণে ৬৫০ সদস্যের পার্লামেন্টে ইহুদি এমপির সংখ্যা আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০। বিচিত্র নয় যে, এ দেশে রাজনীতি কিংবা ব্যবসায় করতে হলে ইসরাইলবিরোধী কথাবার্তা না বলাই ভালো। সে জন্যই কিস্তিতে কিস্তিতে ফিলিস্তিনি গণহত্যা এবং ফিলিস্তিনিদের স্বদেশ কেড়ে নিয়েও ইসরাইল পার পেয়ে যাচ্ছিল।
গত ৮ জুলাই ইসরাইল গাজার বিরুদ্ধে যে অমানুষিক হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে ইহুদি রাষ্ট্রের তাতে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হবে বলেই মনে হচ্ছে। ৩৫ দিনের এ আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি যেকোনো মানুষকেই স্তম্ভিত ও শোকাহত করে তুলেছে। দুই হাজার নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল নরনারী ও শিশু। শিশুর সংখ্যাই ছিল ৪৫০। বর্বর ইসরাইলি বাহিনী হাজার হাজার শরণার্থীর আশ্রয়শিবির বলে জাতিসঙ্ঘের চিহ্নিত স্কুল এবং কয়েকটি হাসপাতালের ওপরও বোমা ফেলেছে। বেশ কয়েকজন ডাক্তার ও নার্সসহ শত শত লোক এসব আক্রমণে নিহত হয়েছেন। এমনকি জাতিসঙ্ঘের ৯ জন কর্মকর্তা এবং দু’জন সাংবাদিককেও তারা হত্যা করেছে।
ইউরোপের প্রতিবাদ ও আদর্শের জাগরণ
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মানুষ ইসরাইলিদের এই বর্বরতা ও অমানুষিকতায় আতঙ্কিত হয়েছে। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে ইউরোপের রাজধানীগুলোতে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ গাজায় আক্রমণের প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ করেছে। গত শনিবার প্রায় এক লাখ মানুষ মার্কিন দূতাবাসের সামনে দিয়ে মিছিল করে লন্ডনের হাইডপার্কে গিয়ে সমাবেশ করেছে। ইসরাইলবিরোধী বহু রকম স্লোগান দিচ্ছিল আর ব্যানার বহন করছিল তারা। অনেকে স্লোগান দিচ্ছিল ‘আমরা সবাই এখন ফিলিস্তিনি’।
প্রতিবাদী কণ্ঠ এবারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও উচ্চারিত হচ্ছে। পররাষ্ট্র দফতরের সিনিয়র প্রতিমন্ত্রী ব্যারনেস সাঈদা ওয়ার্সি ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেছেন। কয়েকটি টেলিভিশন ও রেডিও অনুষ্ঠানে তিনি ইসরাইলের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষপাতিত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এসবের জের ধরে এখন জানা যাচ্ছে যে, পার্লামেন্ট সদস্য, এমনকি মন্ত্রীদের মধ্যেও সরকারের ফিলিস্তিন নীতির বেশ কিছুসংখ্যক সমালোচক আছেন। জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্যারনেস ওয়ার্সির পদত্যাগের জের ধরে সরকারের জনপ্রিয়তায় বড় রকম ধস নেমেছে।
বহু অপ্রত্যাশিত মহল থেকে এবারে ইসরাইলের সমালোচনা উঠছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইতস্তত করে হলেও বলেছেন, গাজায় ইসরাইলি আক্রমণ অনানুপাতিক রকম হিংস্র হয়েছে এবং নিরীহ লোকদের, বিশেষ করে এত বেশিসংখ্যক শিশুর হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। বহু বছরের মধ্যে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ইসরাইলের এমন কঠোর সমালোচনা শোনা যায়নি। হোয়াইট হাউজ ও জাতিসঙ্ঘের সামনে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে। সম্ভবত এই প্রথমবার কয়েক শ’ মার্কিন ইহুদি গাজা আক্রমণের প্রতিবাদ করে যুক্তরাষ্ট্রে মিছিল করেছেন। খোদ ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণের প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনা এতকাল কল্পনাও করা যেত না। এবারে কিন্তু গাজা আক্রমণের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল করেছে বামপন্থীরা। ডানপন্থী ইসরাইলিরা মিছিলগুলোর ওপর হামলা চালিয়েছে। ‘হারেৎস’ পত্রিকার বিখ্যাত কলাম লেখক গিডিয়ন লেভি গাজা আক্রমণের সমালোচনা করে ডানপন্থীদের আক্রোশে পড়েছেন। পত্রিকাটি এখন দু’জন দেহরক্ষী দিয়েছে তাকে। মিসরের মধ্যস্থতায় মীমাংসা আলোচনার সুযোগ করার জন্য ফিলিস্তিনি আর ইসরাইলিদের মধ্যে আরেকটি ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি হয়েছে। সারা বিশ্বের সমালোচনায় ইহুদি রাষ্ট্রের বোধোদয় হয়েছে কি না, শিগগিরই বোঝা যাবে।
লক্ষণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলে যেসব ইহুদি গাজায় ইসরাইলি আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন; তাদের প্রায় সবাই নি¤œ-পঁচিশ বয়সী আদর্শবাদী তরুণ। পিতামাতা ও পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন কারণে অন্ধভাবে ইসরাইলের সব অন্যায় সমর্থন করার দাসখত লিখে দিয়েছিলেন, তেমন কোনো অঙ্গীকার এরা দেননি। হিটলারের হলোকাস্টের জন্য ব্ল্যাকমেইল সহ্য করতেও এরা রাজি নন। ইসরাইলের এই দৃষ্টান্ত থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী হওয়া যাবে কি?
প্রতিবেশীর স্বরূপ ফাঁস
এখন প্রমাণ হয়ে গেছে, বাংলাদেশ সরকারের ১৪ দল গাজায় প্রতিনিধিদল পাঠানোর যে ঘোষণা দিয়েছিল, সেটা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ সপ্তাহ পরে গাজার ব্যাপারে বিশ্বসমাজের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছেন। হয়তো রমজান আর ঈদসংক্রান্ত রাজনীতি নিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি লক্ষ করেননি যে তার এতকালের পৃষ্ঠপোষক পাশের দেশও গাজার গণহত্যার কোনো প্রকাশ্য সমালোচনা করেনি। উল্টোটাই বরং সত্যি বলতে হবে। গাজা আক্রমণের গোড়ায় দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ইসরাইলের সাথে ভারতের আন্তরিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। শাসক বিজেপি দলের একজন শীর্ষ নেতা ড. সুব্রাহ্মনিয়াম সোয়ামি জনসভা করে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। আর গাজায় যখন ইসরাইলের গণহত্যা চলছিল তখন ভারত ইসরাইল থেকে বহু হাজার কোটি রুপির যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে।
বাংলাদেশে পবিত্র রমজান এলো আর গেল। ঈদুল ফিতরের দীর্ঘ ছুটিও শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগে। আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি? অথচ আজীবন শুনে এসেছি, রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে লোভ-লিপ্সা, ক্রোধ-ঘৃণা আর প্রতিহিংসাকে জয় করাই হচ্ছে মূল শিক্ষা।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে রমজান মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ১৫টি। এই খুন করেছে তারা, যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে আর ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রেখে নাগরিকের জানমাল রক্ষার জন্যই নিয়োজিত। অধিকারের বিবৃতিতে দেখেছি এবং ইন্টারনেটে পড়েছি, আরো বহু খুনখারাবি, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি ঘটেছে রমজান মাসেও। ঈদে ভারতের পাখি শাড়ি না পাওয়ার দরুন গৃহবিবাদের, এমনকি অভিমানী স্ত্রীর আত্মহত্যার খবরও পড়েছি। ভারতীয় টেলিভিশনের ‘সোপ অপেরার’ একটি পর্ব দেখতে না পেয়ে এক তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। প্রেমিকার নগ্ন দেহের ভিডিও ধারণ করে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে বিক্রি করা হয়েছে। বিদেশী টেলিভিশন আর অপসংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনকে কতখানি বিষিয়ে দিয়েছে, এসব হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত।
সাংস্কৃতিক শূন্যতা ও অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্য
পদার্থ বিজ্ঞানে আছে, প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে। প্রচণ্ড গরম বাতাস ঊর্ধ্বমুখী চলতে থাকলে আশপাশ থেকে শীতল বাতাস হু হু করে ছুটে আসে সে শূন্যতা পূরণ করতে। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের এটা হচ্ছে কারণ। এককালে আমাদের সংস্কৃতি ছিল, সে সংস্কৃতি বহু জাতির ঈর্ষার কারণ ঘটাত। প্রায়ই ভাবি, সে সংস্কৃতি এখন গেল কোথায়? কী করে এমন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হলো যে গা ঘিন ঘিন করা অপসংস্কৃতি ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে এসে আমাদের জাতীয় জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে?
যারা নেতা হন, যারা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেন, সংস্কৃতির সুস্বাস্থ্য, ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব তাদের ওপর। দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের যাত্রা আশানুরূপ হয়নি। দৃষ্টান্ত সৃষ্টির পরিবর্তে আমাদের নেতারা বিত্ত-সম্পদের পাহাড় তৈরি করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। তার থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর ধারণা হয়েছে ভালো-মন্দ যেকোনো উপায়ে সম্পদ অর্জন করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কার্লমার্কস আবিষ্কার করেছিলেন মানুষকে ধর্ম ভোলানো না গেলে তাদের প্রকৃত কমিউনিস্ট বানানো যাবে না। তাই তিনি প্রচার করেছিলেন ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্য আফিমস্বরূপ। সে নেশা ছাড়ানো না গেলে কমিউনিজমের বীজ গণমনে গেড়ে বসবে না।
বাংলাদেশেও হয়েছে তাই। তরুণসমাজের মনে অর্থলিপ্সার বীজ গেড়ে দেয়া হয়েছে, এ আশায় যে অতঃপর নীতি ও আদর্শের কথা তারা আর ভাববে না। ভোগলিপ্সা তাদের মনে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে চুরি-ডাকাতি, খুনখারাবি কোনো কিছুই তাদের বিবেককে পীড়িত করে না। সে জন্যই দেখতে পাই, ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে যারা পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়েছে তাদের জন্মদিবস-মৃত্যুদিবস এমন ঘটা করে পালন করা হয় যেন তারা দেবতার পর্যায়ে উঠে গেছে। তরুণসমাজের এই মগজ ধোলাই করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। ভোগলিপ্সা, খুনখারাবি আর যৌনবিকৃতি নিয়ে ডুবে থাকলে নীতি আর আদর্শের কথা, ন্যায়বিচারের কথা, গণতন্ত্রের কথা সেই পঙ্কিল মস্তিষ্কে স্থান পাবে না। ক্ষমতাসীনদের নিদ্রায় তাতে ব্যাঘাত হবে না।
বহুকাল পরে পশ্চিমের নতুন প্রজন্মের মনে আশাবাদের জাগরণ ঘটেছে। মানবিক আদর্শ তাদের উজ্জীবিত করেছে। গাজার গণহত্যায় তাদের বোধোদয় ঘটেছে যে, ইসরাইল একটি পরদেশগ্রাসকারী নির্যাতক রাষ্ট্র, এ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কর্তব্য। ভবিষ্যতের জন্য এটা আশার কথা। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশেও এসেছে, আরো আসবে। এ দেশেও একটা গদিগ্রাসী নির্যাতক শক্তি আছে, রাষ্ট্রের সর্বনাশ করা যাদের মূল লক্ষ্য। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের রুখে দাঁড়ানোর সময় কি এখনো আসেনি?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন