ঐক্য প্রক্রিয়ায় অনৈক্যের সুর!
30 September 2018, Sunday
প্রবীন রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হলেও, এক সপ্তাহ পেরুনোর আগেই একটি অনৈক্যের সুর শোনা যাচ্ছে। বিকল্প ধারাকে নিয়েই ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এখন বিকল্প ধারার নেতারাই বলছেন উল্টো কথা। বিশেষ করে বিকল্প ধারার যুগ্ম-মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর নানা বক্তব্য ঐক্য প্রক্রিয়ার বড় ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তার দুটো বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এক. তিনি বলেছেন, বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে একাশ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে হবে। এটা মুখে বললে চলবে না। পত্রিকায় বিবৃতি ও লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে। দুই. বিকল্প ধারা তথা যুক্তফ্রন্টকে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে ১৫০টি আসন ছেড়ে দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যজোট যখন ‘কাজই’ শুরু করতে পারল না, এর আগেই বিকল্প ধারা শর্ত জুড়ে দিল! এর ফলে ঐক্য প্রক্রিয়া কী বাধাগ্রস্ত হবে না? যদিও ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য একটু ভিন্ন। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তিনি যে ঘোষণাপত্র দিয়েছেন, তাতে জামায়াত নিয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না। যুক্তফ্রন্টকে দেড়শ আসন দেওয়া কিংবা দুই বছরের জন্য তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া, এগুলো কোনো সমস্যা না। বিএনপি বড় দল সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করেই একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। রাজনীতির দুটি ধারাই এই দুটি দল প্রতিনিধিত্ব করে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একটি রাজনৈতিক ধারা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। ১৯৯৬ সালে পর থেকেই আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। গত প্রায় দশ বছর যাবৎ আওয়ামী লীগ সমতায়। তবে নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য একটি টেস্ট কেস। অন্যদিকে বিএনপিই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি শক্তি জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির ভুল রাজনীতি, দলের নেতাদের মাঝে একধরনের সুবিধাবাদীতা, সুনির্দিষ্ট রাজনীতি প্রণয়নে ব্যর্থতা জাতীয় পার্টিকে বিএনপির বিকল্প হিসাবে দাঁড় করাতে পারেনি। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে এরকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি এই সুযোগটি নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলে থাকা, দলীয় প্রধানের মন্ত্রীর পদ-মর্যাদায় সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সরকারের বিরোধীতা করা সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টির এই ‘ভূমিকা’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে ঘুরে ফিরে বিএনপিই আলোচনায় আছে এবং বিএনপিকে কেন্দ্র করেই এখন প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের বিএনপির অংশগ্রহণটা জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এই দায়িত্বটি পালন করতে পারবে কি?
বিএনপি গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের সাথে ঐক্য করেছে। কিন্তু এটি একটি নির্বাচনী ঐক্য হবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সংসদীয় নির্বাচনে বিকল্প ধারায় কোনো ভিত্তি নেই। মাহী বি. চৌধুরীর নিজস্ব কোনো সংসদীয় এলাকা নেই। বাবা বি. চৌধুরীর নির্বাচনী আসনই তার আসন। দেশের ৬৪টি জেলার সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে তিনি যখন বিএনপিকে একধরনের ‘মুচলেকা’ দিতে বলেন, তখন তার ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ও বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে জামায়াতকে সাথে নিতে চান না। কিন্তু তার নিজ দলের মহাসচিবকে নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে এবং যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, তখন এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চুপ। তিনি উচ্চাকাঙ্খী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার সেই ‘ইমেজ’ নেই। জাতীয় ঐক্য জোটের ব্যাপারে তিনি সুবিধা নিতে চাইছেন। এতে করে বিএনপিকে বাধ্য করতে পারে ঐক্য প্রক্রিয়ার বিরোধী অবস্থান নিতে । দ্বিতীয়ত, নাগরিক ঐক্যের কোনো নিবন্ধন নেই। মাহমুদুর রহমান মান্না একজন ব্যক্তি। তার হয়তো ‘ ইমেজ’ আছে, কিন্তু নেই সাংগঠনিক ভিত্তি। এমতাবস্থায় তিনি দাবি করে বসলেন, দু’বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তাদের দিতে হবে! কোথায় নির্বাচন? কোথায় নির্বাচন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা! দিল্লি তো অনেক দূর! এরই মাঝে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব? মাহী বি. চৌধুরী ও মান্নার বক্তব্য প্রকারন্তরে বিএনপিকে ঐক্য বিরোধী অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। এদের দু’জনেরই বোঝা উচিত, তাদের শক্তি কতটুকু? ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করেন কীভাবে?
এ ধরনের বক্তব্যের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি দলের নয়, জনগণের ঐক্য চান। তার এ ধরনের কথা শুনতে ভালোই শোনা যায়। কিন্তু বিকল্প ধারার ওপর তার কোনো ‘নিয়ন্ত্রণ’ নেই। এমনিতেই নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে ড. কামাল হোসেন নাকি বি. চৌধুরীর হাতে, এটা নিয়ে ঐক্যজোটে একধরনের আস্থাহীনতা আছে। ড. কামাল যৌথ নেতৃত্বের কথা বললেও। মাহী বি. চৌধুরী এটা মানছেন না! তিনি চান বি. চৌধুরীকে মূল নেতৃত্বে দেখতে। স্পিরিটটি হচ্ছে, সরকার বিরোধী সকল শক্তিকে একটি প্লাটফর্মে আনা। এ থেকে বিএনপি বড় দল হলেও ড. কামালের নেতৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। যদিও ২০ দলীয় জোটে এই ঐক্য নিয়ে একধরণের অস্বস্তি রয়েছে। এলডিপি, অন্যান্য পার্টি কিংবা ন্যাপের মতো সংগঠন জাতীয় ঐক্যজোটের ব্যাপারে খুব উৎসাহী তা বলা যাবে না। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে আছে। এখন বিএনপি যদি ‘নতুন মিত্র’ পেয়ে এদের ‘পরিত্যাগ’ করে, তাহলে বিএনপির গ্রহণযোগতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। বিএনপির উচিত হবে ২০ দলীয় জোটকে সাথে রেখেই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া।
জাতীয় ঐক্যজোট গঠিত হওয়ায় সরকারেরও এতে লাভ। কেননা শেষ পর্যন্ত ঐক্যজোটের ব্যানারে বিএনপি হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবে। আর বিএনপির একটি প্লাসপয়েন্ট, নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্তটি তুলেছিল কামাল হোসেনর কাছে। কিন্তু দু‘টো পক্ষ এখনো অমীমাংসিত। এক. নির্বাচনকালীন সরকার, দুই. সংসদ ভেঙে দেওয়া। ড. কামালও এ দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের মনোভাব এখনো অনমনীয়। সরকার বারবার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। সরকারের দাবি মেনেই কি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাচ্ছে? এবং বিএনপি বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করেই কী নির্বাচনে যাচ্ছে! এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে।
মানুষ একটি ভালো নির্বাচন চায়। চায় তার ভোট সে নিজে তার মনোনীত প্রর্থীকে দেবে। ভোট কেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতিক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাঁধা দান এই ‘সংস্কৃতি’ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। এটা আওয়ামী লীগের জন্য যেমনি ভালো, তেমনি ভালো বিএনপিসহ অন্যান্য দলের জন্যও। একটা সুযোগ এসেছে। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি ভূমিকা রাখছে। এখন যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ঐক্যকে ধরে রাখা। ঐক্য প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হলে বিএনপি আবারও নির্বাচন বয়কটের ডাক দিতে পারে, যা কারও জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।আস
লেখক : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন