মালয়েশিয়া ও কর্নাটক নির্বাচনের শিক্ষা
28 May 2018, Monday
সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ভারতের কর্নাটক রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি নির্বাচনই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এই নির্বাচন ১৯৫৭ সালের পর এই প্রথম একটি বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং ৯২ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন।
এখানে বড় প্রশ্ন একটিই- তিনি মালয়েশিয়াকে কী দিতে পারবেন? ভারতের কর্নাটক রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। এতে বিজেপি বিজয়ী হলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে সেখানে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেছেন।
নয়া মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র ৩৮ আসন পাওয়া (বিধানসভার মোট আসন ২২০) এইচডি কুমারাস্বামী, যিনি জনতা দলের (সেকুলার) রাজ্য শাখার প্রধান। এ নির্বাচন থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কি কিছু শিক্ষা নিতে পারেন?
এখানে বলা ভালো, মাহাথির মোহাম্মদ আর কুমারাস্বামীর মধ্যে একটা মিল আছে। মালয়েশিয়ার সংসদের নিুকক্ষ ‘দেওয়ান রাকিয়াতে’র নির্বাচনে ২২২ আসনের মধ্যে মাহাথির মোহাম্মদের দল পিপিবিএম মাত্র ১৩ আসন পেয়েছে। তবে তার নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান পেয়েছে ১১৩টি আসন।
সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১১২ আসন। সরকারি জোট বারিসান ন্যাসিওনাল পেয়েছে মাত্র ৭৯ আসন। মজার কথা, মাহাথির যে জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই জোটে বড় দল পিপলস জাস্টিস পার্টি পেয়েছে ৪৭ আসন।
আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্ব দেয়া দলটি প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করতে পারত। যদিও নতুন সরকারে আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ডা. ওয়ান আজিজা ওয়ান বিনতি ইসমাইলকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। সম্পর্কে তিনি মাহাথির মোহাম্মদের শ্যালিকা।
এমনকি জোটে দ্বিতীয় বড় দল ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি ৪২ আসন পেয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদটি দাবি করেনি। দলটির সিনিয়র নেতা লিম গুয়ান ইং, যিনি চীনা বংশোদ্ভূত, প্রথমাবরের মতো মালয়েশিয়ার ইতিহাসে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। আগে অর্থমন্ত্রীর পদটি বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল।
আমরা এবার একটু কর্নাটকের দিকে তাকাতে পারি। কর্নাটকের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ কারণে যে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির কর্নাটক বিজয় ভারতব্যাপী গেরুয়া বিপ্লবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত। কর্নাটকে বিধানসভার আসন ২২০। বিজেপি পেয়েছে ১০৪ আসন, কংগ্রেস ৭৮, আর জনতা দল (সেকুলার) ৩৮ আসন। কংগ্রেস আর জনতা দলের যৌথ আসন ১১৬। সরকার গঠনের জন্য দরকার ১১১।
বিজেপি নির্বাচনের পরপর বড় দল হিসেবে সরকার গঠনের আমন্ত্রণও পেয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ খেলাটা খেললেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। জনতা দলের সঙ্গে সমঝোতা হল। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন কুমারাস্বামী, যিনি কর্নাটকে একজন বিতর্কিত রাজনীতিক। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। কুমারাস্বামীর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের জন্য একটি ‘শিক্ষা’।
এ দুটি নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এক. বড় দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে ছোট দলগুলোও যে সরকার গঠন করতে পারে এটা তার বড় প্রমাণ। বড় দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থের বিবেচনায় ছোট দলগুলোর সঙ্গে ‘ঐক্য’ করতে পারে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদটিও ছেড়ে দিতে পারে। এটাই রাজনীতি, আর রাজনীতির ‘চাল’।
দুই. বড় দলগুলোর যে অহমিকা, তা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করে না।
তিন. রাজনীতিতে ‘বাস্তবতা’ বলে একটা কথা আছে। বড় দলগুলোকে শেষ পর্যন্ত এটা মানতে হয়।
চার. তরুণ প্রজন্ম একটা ফ্যাক্টর। বড় দলগুলোকে এটা উপলব্ধি করতে হয়েছে।
পাঁচ. অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি ও ব্যক্তির ভূমিকা একটা ফ্যাক্টর।
আমরা কি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারি? এটা ঠিক, বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। কোনোভাবেই এ দুটি বড় দলের সহাবস্থান হচ্ছে না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় একটা ‘ঐক্য’ হয়েছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদেও একটা ‘ঐক্য’ হয়েছিল।
পঞ্চম সংসদে বিজয়ী বিএনপি আর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবিধানে সংশোধনী আনার ফলে আমরা সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। এরপর ২৭ বছর পার হয়েছে। দুটি বড় দলের মাঝে বিভেদ, অনৈক্য, রেষারেষি দিন দিন বাড়ছেই।
সুস্থ গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি সহাবস্থানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং দেখা গেছে একটি দল অপর দলকে ‘উৎখাত’ করতেই বেশি তৎপর। রাজনীতি এখানে গৌণ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেই শক্তি গড়ে ওঠেনি। সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির ইফতার মাহফিলে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে একটি তৃতীয় শক্তির উত্থানের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার উদ্যোগে সম্প্রতি যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, সেই যুক্তফ্রন্ট কি তৃতীয় শক্তি?
মাহাথির মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে এটি পেরেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। মাহাথিরের যে ক্যারিশমা, কমিটমেন্ট, রাজনৈতিক সততা, যুক্তফ্রন্টের নেতাদের তা নেই। যুক্তফ্রন্টের নেতারা ঢাকাকেন্দ্রিক ও বিবৃতিসর্বস্ব কয়েকটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের একটি ‘ঐক্য’ হতে পারে। নির্বাচনী ঐক্য। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে বড় ছাড় দিতে হবে।
পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি এবং দলটির চিরশত্র“ নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ‘গণতন্ত্র উদ্ধার কমিটি’ গঠন করেছিল।
মালয়েশিয়ায় বিরোধী জোটের বড় দল পিপলস জাস্টিস পার্টি ছোট দল পিপিবিএম প্রধান মাহাথির মোহাম্মদকে নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এতে করে জাস্টিস পার্টির নেতৃত্ব, বিশেষ করে মাহাথিরের একসময়ের শত্র“ আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যেও কোনো অহংবোধ কাজ করেনি। এখানে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি ছিল মুখ্য।
কর্নাটকেও তা-ই হয়েছে। রাহুল গান্ধী সেখানে বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেছেন। তার দল সরকার গঠনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটা চাণক্য কৌশল। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ চাণক্যের এই কৌশল মালয়েশিয়া কিংবা কর্নাটকে আমরা দেখেছি।
আমরা মানি আর না মানি, রাজনীতিতে বিএনপি এখন কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। রাজপথে বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির নেতারাও অনেকটা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন।
বেগম জিয়ার অবর্তমানে ঢাকার বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগও বিএনপির পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি নিঃসন্দেহে বড় দল। এ মুহূর্তে তাদের কোনো অহমিকা থাকা উচিত নয়। আর এটা বোধহয় এখন বাস্তবতা যে, বেগম জিয়া ও তারেক রহমান জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না!
মামলা-মোকদ্দমা আর মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। প্রার্থী পদের প্রশ্নে তাদের উচ্চ আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ততদিনে প্রার্থী মনোনয়নের সময়সীমা পার হয়ে যেতে পারে। তাই বিএনপিকে একটি বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে ‘মাহাথির ফর্মুলা’কে সামনে রেখে বিএনপি সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে যদি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে, তাতে বিএনপির ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি। এ নির্বাচনটি বিএনপির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কটের পেছনে দলটির যত যুক্তিই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সেই বয়কট বিএনপিকে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছে। ২০১৮ সালেও বিএনপি যদি আবারও নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়(?), তা দলটির জন্য আত্মঘাতী হবে। কারণ এতে করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ করা যাবে না।
বিএনপির পক্ষে আন্দোলন করাও সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ আর আগের মতো হরতাল-অবরোধে সাড়া দেয় না। হরতাল-অবরোধে বাসে আগুন দেয়াসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয় এবং সঙ্গত কারণেই এর দায়ভার পড়ে বিএনপির ওপর।
বিএনপি এখন আন্দোলনের কথা বলছে। দলটি অনেকটা বিবৃতিসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। সরকারের দমননীতি এখনও বিদ্যমান। মামলা-মোকদ্দমা এখনও দলটির নেতারা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এ কারণেই তারা আন্দোলনের কথা বলে নির্লিপ্ত থাকছেন।
নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এখন অনিয়ম স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ বিদ্যমান (কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া), তার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। আগামী নির্বাচন নিয়ে তাই শঙ্কা আছে। তবুও নির্বাচনে যেতে হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
একটি জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু এর রূপরেখা কী? কার সঙ্গে কার ঐক্য? এসব বিষয় খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। এখন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের যদি সমঝোতা হয়, তাহলে লাভবান হবে বিএনপিই। নতুবা এ সুযোগটি আওয়ামী লীগও গ্রহণ করতে পারে।
আমরা একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই। সুস্থ ধারার রাজনীতিই বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দুর্নীতি রোধ করতে পারে। সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে। আর এই সুস্থ ধারার রাজনীতির অন্যতম শর্তই হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণ। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী দলেরও।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন