ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার অথবা ১১৫ বর্গমাইল আয়তনের এ রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ (২০১৭), যার একটা বড় অংশ আবার বিদেশি। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, যা আরও ৩০ দিন বাড়ানো হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১ ফেব্রুয়ারি আদালত-সরকার দ্বন্দ্বে দেশটির রাজনীতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভারত ও চীন এই ছোট্ট দেশটিতে একধরনের প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের মুখে চীন ২১ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমায় ১১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, চীনা যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি দিল্লির উদ্দেশে শক্তি প্রদর্শনের নামান্তর মাত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারত তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ নামের ওই সামরিক অভিযান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে রক্ষা করেছিল। এর আগে শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীদের একটি অংশ, যারা ‘পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তালিম এলাম’ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা গাইয়ুম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়।
বিদ্রোহীরা গাইয়ুমকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ফলে গাইয়ুম পালিয়ে গিয়ে ভারতের সামরিক সাহায্য চান। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গাইয়ুমের ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে ১৬০০ সৈন্য পাঠান। বিদ্রোহের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ একটি চীনপন্থী নীতি অনুসরণ করছে। চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে মালদ্বীপ। মালদ্বীপ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) কর্মসূচিকে সমর্থন করেছে এবং তাতে যোগ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মালদ্বীপ তার সংবিধান সংশোধন করে বিদেশিদের জমি কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে সুযোগটি নিয়েছে চীনারা। বলা হচ্ছে, এখানে বিনিয়োগের পাশাপাশি চীন একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যা ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ।
১৯৮৮ সালে ভারত মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। মালদ্বীপ কিছুটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গত চার বছরে একবারও মালদ্বীপ সফর করেননি।
ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ। এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারত এসব অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। ফলে স্পষ্টতই একধরনের চীন-ভারত দ্বন্দ্বে এ অঞ্চলের দেশগুলো জড়িয়ে পড়ছে। মালদ্বীপের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা কী হবে তা বলা না গেলেও দেশটির ব্যাপারে যে তার আগ্রহ রয়েছে তা বলা যায়। আগামীতে মালদ্বীপে ভারতের ‘ভূমিকা’ চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটিই তারা দিয়েছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নতুন দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও দেশ দুটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে দিল্লি তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালের তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পণ্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ-বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল।
ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ-বাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মাল্লাকা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা ও সুতা এই সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। কাজেই দেখা যাচ্ছে, একদিকে চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুটের’ ধারণা নিয়ে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, অন্যদিকে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুটের’ ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রেরও বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থবিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
এই রুটের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্র“নাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এমন কথাও বলা হয়, ব্র“নাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি।
২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এই সিল্ক রুটের প্রতি আগ্রহের কথা জানতে পারি। এই সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সেই পথ ধরেও বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও বলেন। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠক জানেন।
এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন তা হচ্ছে, ‘চীনের এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের’ নীতি ভারতের স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক? কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের’ কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। আর আটলান্টিক ও প্যাসিফিকের ওপার থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ‘ফায়দা’ ওঠাতে চাইবে। আগামী দিনগুলো তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
এখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ অঞ্চলের দেশগুলোও এতে করে ‘প্রভাবিত’ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ঝুঁকির মুখে পড়বে ব্রিকস ব্যাংক। ভারত অন্যতম উঠতি শক্তি। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পাশাপাশি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে ভারতের। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সবসময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এরই মধ্যে ভারতের একধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে তা নয়, বিশ্বের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এ মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করা হয় ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানি পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিবাহিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। এ সমুদ্রপথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
মালদ্বীপে ভারত ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। মালেতে একটি বিশাল বন্দর নির্মাণের জন্য ভারতের একটি কোম্পানি কনট্রাক্ট পেয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সেই চুক্তি বাতিল করে একটি চীনা কোম্পানিকে কাজ দেন। চীন সেখানে বিশাল বিনিয়োগ করছে। গেল ডিসেম্বরে (২০১৭) চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। চীন যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায়। এতে করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ ক’টি সমুদ্রবন্দর ‘কানেকটেড’ থাকবে এবং চীন তা তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, পাকিস্তানের গাওদারে (বেলুচিস্তান) ও শ্রীলংকার হামবানতোতায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা চীনের হাতে। ভারত এ বিষয়টিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলেই মনে করে।
হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতির জের ধরে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনাঘেঁষা’ নেতা রাজাপাকসে পরাজিত হয়েছিলেন (২০১৬)। কিন্তু সম্প্রতি রাজাপাকসে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। তিনি আগাম সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে ভারতঘেঁষা বলে মনে করা হয়।
মালদ্বীপের পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাবে, বলা মুশকিল। দেশটির চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। মালদ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প-মোদি ফোনালাপ হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ আল হুসেন বলেছেন, ‘মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সব ধরনের সাংবিধানিক অবমাননার ফলে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামোই ভেঙে পড়েছে।’ সুতরাং বোঝাই যায়, মালদ্বীপের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ উদ্বিগ্ন।
এখন দেখার পালা এ পরিস্থিতি মালদ্বীপকে কোথায় নিয়ে যায়। তবে একটা কথা বোধহয় বলাই যায়- মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি, চীনের ১১টি যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ ইত্যাদি ঘটনাকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এরই মধ্যে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব সংকুচিত করতে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার একটি উদ্যোগের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘ফিন্যান্সিয়াল রিভিউ’ এ ধরনের একটি সংবাদ দিয়েছে। এ উদ্যোগের নাম কী হবে, তা এখন অবধি প্রকাশ করা হয়নি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের একটি পরিকল্পনার কথা, যা চতুর্ভুজ উদ্যোগ বা Quadrilateral Initiative নামে পরিচিত।
এই চতুর্ভুজ উদ্যোগের সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। প্রতিবছরই এ চার দেশ ভারত মহাসাগরভুক্ত মালাবার প্রণালিতে নিয়মিত নৌ-মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে। এটাই সম্ভবত চীনের ওবিওআরের ‘বিকল্প’ রূপ। জাপানের একটা স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, তার ‘অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্সের’ (ওডিএ) আওতায় বৃহত্তর ‘স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ বাস্তবায়ন করা। পরিবহন ও যোগাযোগ তথা বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলার রূপরেখা রয়েছে এ কৌশলে। ২০১৭ সালে জাপান যে ওডিএ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র তৈরি করেছে, তাতে এ রূপরেখা আছে। ভারত মহাসাগর এবং এশিয়া-প্যাসিফিকে মিত্র দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির এই জাপানি উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন রয়েছে বলেও জানা গেছে। ফলে স্পষ্টতই ভারত মহাসাগরে উত্তেজনা বাড়ছে। মালদ্বীপের পরিস্থিতি এবং দ্রুত চীনের ১১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত এ উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন