গত ৩১ অক্টোবর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে যে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। এ সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে উজবেকিস্তান থেকে আসা অভিবাসী সায়ফুল্লো হাবিবুলেভিক সাইপভকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই হামলায় আটজন নিহত হন এবং ১০ জনের বেশি আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একটি ভাড়া করা ট্রাক নিয়ে তিনি ব্যস্ত ম্যানহাটনের পশ্চিম দিকে থাকা বাইক লেনে ঢুকে পড়েন এবং ট্রাকচাপায় হত্যা করেন আটজনকে। টিভি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সায়ফুল্লো ট্রাকটি যখন একটি স্কুলবাসকে ধাক্কা দেন, তখন তিনি ‘পিস্তল’ হাতে বেরিয়ে আসেন। পরে পুলিশ তাকে গুলি করে এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ট্রাকে একটি চিরকুট পাওয়া যায়, তাতে লেখা আছে আইএসের পক্ষ থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে। একজন অভিবাসী কর্মী হিসেবে সায়ফুল্লো এ দেশে এসেছিলেন ২০১০ সালে। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রে ‘নাইন-ইলেভেন’র ঘটনার পর যত সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার সবই হয়েছে অন্যান্য শহরে। নিউইয়র্কে কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। এবার ঘটল। আর ঘটল এমনি এক জায়গায়, যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে এখন ফ্রিডম টাওয়ার হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ ফ্রিডম টাওয়ারে যায়। ‘ই’-ট্রেনের একদম শেষ মাথায় নামতে হয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্টেশনের ওপর উঠলেই ফ্রিডম টাওয়ার। নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় বিধ্বস্ত ‘টুইন টাওয়ার’-এর জায়গায় তৈরি করা হয়েছে এই ‘ফ্রিডম টাওয়ার’টি। গত সপ্তাহেও আমি সেখানে গেছি। এখন এই সন্ত্রাসী কর্মকা- অনেক ‘সম্ভাবনার’ জন্ম দিল। এক. যুক্তরাষ্ট্রে এখন ডিভি ভিসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ম্যানহাটনের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসন আইনে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেছেন। ডাইভারসিটি ভিসায় এতদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন এ দেশে আসত এবং স্থায়ীভাবে থাকা ও কাজ করার সুযোগ পেত। এক সময় তারা মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করত। এখন ট্রাম্প এটি বন্ধ করতে চাচ্ছেন। যদিও এ ব্যাপারে কংগ্রেসের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি এ ধরনের আইন করাতে পারবেন এবং ডিভি ভিসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দুই. ট্রাম্প প্রথমে সাতটি, পরে ছয়টি মুসলিম দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু আদালতের পূর্ণ সমর্থন তিনি পাননি। এখন নতুন করে আরও কয়েকটি মুসলিম দেশের ওপর তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। উজবেকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ এর আওতায় আসতে পারে। তিন. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক লাখ অবৈধ অভিবাসীকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এতদিন এ ব্যাপারে তিনি স্টেটগুলোর সমর্থন পাননি। এখন তিনি তা পাবেন। ফলে বেশ কিছু বাংলাদেশিও এখন দেশে ফিরে যেতে পারেন। চার. আগে ‘গ্রিনকার্ড’ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ ছিল। এখন এতে আরও কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ হতে পারে। পাঁচ. যারা ডিভি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, তাদের ব্যাপারে নিজ নিজ দেশে আরও খোঁজখবর নেওয়া হবে। তাদের আদৌ কোনো জঙ্গি কানেকশন আছে কিনা কিংবা তারা দেশে থাকাকালীন কোনো ইসলামিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা তা খুঁজে দেখা হবে। এতে করে বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন!
নিঃসন্দেহে ম্যানহাটনের ঘটনা মুসলমান সমাজের জন্য একটি খারাপ সংবাদ। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় মুসলমানবিরোধী যেসব প্রোপাগান্ডা চলে আসছিল, তার সঙ্গে এখন ম্যানহাটনের ঘটনা যোগ হবে; যা মুসলমানদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। ট্রাম্পের অবস্থান এতে করে আরও শক্তিশালী হবে। ওই ঘটনার পর তিনি বলেছেন, ‘আইএসকে শুধু রাকা (সিরিয়া) নয়. বরং বিশ্ব থেকেই উৎখাত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আইএসের কোনো জায়গা নেই।’ তবে সায়ফুল্লো সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা বেশ ইন্টারেস্ট্রিং। বলা হচ্ছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই আইএস দ্বারা রিক্রুট হন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে এসেই তিনি আইএস মতাদর্শ দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং আইএস তাকে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই আইএসের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে! এটা যদি শক্তিশালী হয় তা হলে অবাক করার একটি ঘটনা যে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় আমি লক্ষ করেছি, এখানে মুসলমান সমাজে ধর্মচর্চার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। জ্যামাইকা এলাকায় অনেক বাংলাদেশির পরিবারকে আমি দেখেছি, যারা অতিরিক্ত ধর্মচর্চা করেন। সাবওয়েতে দেখা যায়, সাত-আট বছর বয়সী বাংলাদেশি মেয়েরা এ বয়সেই ‘পর্দা’ করছে। হিজাব পরছে। ছোট শিশুরা মাথায় টুপি দিয়ে ট্রেনে চলাচল করছে। এ দৃশ্য নিউইয়র্কে অত্যন্ত স্বাভাবিক। সাধারণত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূতরা এটি করেন। এখন বাংলাদেশিদের মাঝে এ প্রবণতা বাড়ছে। সাত-আট বছর আগে আমি নিউইয়র্কে এমনটি দেখিনি। এসব পরিবার ডিভি ভিসায় এখানে এসেছে। সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে ডিভিপ্রাপ্ত এক ভদ্রলোক বললেন, তিনি তার দুই নাবালক শিশুপুত্রকে মাদ্রাসায় দিতে চান। এই নিউইয়র্ক শহরে আদৌ মাদ্রাসা আছে কিনা আমি জানি না। তবে অনেক মসজিদ আছে। মসজিদগুলোয় শনি-রবিবার ছুটির দিনে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে সেই অর্থে কোনো মাদ্রাসা না থাকারই কথা। আমি অবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে, এই নিউইয়র্ক শহরে শিক্ষার জন্য যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ‘ফ্রি’ করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন স্থায়ী বাসিন্দা কিংবা তার সন্তান বিনা পয়সায় (আগে যা ছিল না) বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে। এই শিক্ষা তো তার পক্ষে বাংলাদেশেও সম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি কী করে চিন্তা করলেন ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াবেন? এরা ধর্মভীরু, সন্দেহ নেই তাতে। আর এদেরকেই রিক্রুট করে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। এখন ভয়টা হচ্ছে, একটি বাংলাদেশি পরিবারকে দিয়ে সারা বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়। এখানে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশি সন্তান উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। আমার পরিবারের দ্বিতীয় জেনারেশনের অনেকেই ফার্মাসিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আইনজীবী হওয়ার পথে। এদের নিয়ে আমার গর্ব হয়। কিন্তু এই সমাজে বাংলাদেশি পরিচয়ে বেড়ে ওঠা একজন বাংলাদেশি যখন তার নাবালক সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠাতে চান এবং স্থানীয় শিক্ষা উপেক্ষা করে, তখন একটা ভিন্ন মেসেজ দেয় বৈকি! আমি মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষাবিরোধী নই। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বাংলাদেশই ভালো। তারা সেখানেই থাকতে পারতেন। এ সমাজে যখন মুসলমানদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, তখন আমাদের ভাবা উচিত এখানে মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, বরং সন্তানদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করাই মঙ্গল। কয়েক হাজার বাংলাদেশি এই নিউইয়র্ক শহরে থাকেন। এদের অনেকেই ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ম্যানহাটনে গেলে শত শত ডাক্তার আপনি পাবেন, যারা ভারতীয়। তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় জেনারেশন। শিক্ষাটাকেই তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণেই তারা সফল হয়েছেন।
ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কঠিন হয়ে উঠছে অভিবাসীদের জন্য, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত তিন-চার বছরে যতগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটির সঙ্গে অভিবাসী মুসলমানরা জড়িত। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী টার্গেট হবে মধ্য এশিয়ার মুসলমানপ্রধান দেশগুলো। এটা ঠিক, মধ্য এশিয়া থেকে অনেক তরুণ আইএসে যোগ দিয়েছে। আইএসের অনেক সামরিক কমান্ডার এসেছেন মধ্য এশিয়া, বিশেষ করে উজবেকিস্তান থেকে। যারা জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন উজবেকিস্তানে জঙ্গিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘দি ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান’ (আইএসইউ) নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনটি ২০১৫ সালে আইএসের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা ঘোষণা করে। এই গ্রুপের একটি অংশ আল কায়েদা ও তালেবানদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছেন। আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় তালেবান ও আইএসের পক্ষে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকে আইএসইউর সদস্য। ১৯৯৮ সালে জন্ম নেওয়া আইএসইউর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাহির ইয়ুলডাসেভি ও জুমা নামানগানি। আইএসইউ উজবেকিস্তানকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। প্রধানত প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে এ সংগঠনটির জন্ম হলেও এদের সদস্যরা অনেক মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এমনকি সুইডেন (এপ্রিল ২০১৭), তুরস্কে (জানুয়ারি ২০১৭, জুন ২০১৬) যে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি হামলা হয়েছিল, তার সঙ্গে উজবেক সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। এখন সায়ফুল্লো সাইপভের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ায় এবং আইএসের কর্মকা-ের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করায় এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, ওই হামলার ব্যাপারে আইএস অনেক আগেই একটা পরিকল্পনা করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে সায়ফুল্লোর আইএসইউর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তা এখন অবধি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সিরিয়ায় আইএসের এক রকম পরাজয় ঘটেছে। আইএসের তথাকথিত রাজধানী রাকা থেকে আইএস যোদ্ধারা পালিয়ে গেছে। পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, আইএসের পরাজয় হলেও তাদের কর্মকা-ের অবসান হবে না। আইএস সদস্যরা পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়বে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের কর্মকা- সম্প্রসারিত হতে পারে। এমনকি আইএস সদস্যরা যারা পশ্চিম ইউরোপের নাগরিক, তারা এখন ইউরোপে জঙ্গি হামলা অব্যাহত রাখতে পারে। কয়েক হাজার মার্কিন নাগরিক যাদের সবাই মুসলমান ও মুসলমান পরিবারের সদস্য, তারা ফিরে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এরা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে পারে, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ফলে ম্যানহাটনে যে সন্ত্রাসী হামলা হলো, এটাই শেষ হামলা নয় বলে আমি আশঙ্কা করছি। সায়ফুল্লো সাইপভের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং যে ধরনের কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলছেন, তা মুসলমান দেশগুলোর জন্য খুব ভালো খবর নয়। এক কথায় যেটা বলা যায় তা হচ্ছে, এ হামলায় মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন বেশি।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন