ইউরোপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এখানে উচ্চশিক্ষা নিয়েছি। অনেকগুলো শহরে ছিলাম। প্রতিবছরই যখন দেশ থেকে বের হই, তখন পারলে একবার ইউরোপ ঘুরে যাই। মূলত আমি আসি যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছর ছিলাম পাঁচ মাস। আটলান্টিকের ওপারে ইউরোপ। নিউইয়র্ক থেকে আটলান্টিক ক্রস করতে লাগে প্রায় ৮ ঘণ্টা। আর যদি ওখান থেকে ডালাসে আসি লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। গত বছরও ডালাস থেকে ইউরোপে এসেছিলাম, এবারও এসেছি নিউইয়র্ক হয়ে। কিন্তু এবারের ইউরোপে আসার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইউরোপ বদলে যাচ্ছেÑ আর এটা কাছ থেকে দেখা। অক্টোবরের এক সকালে যখন প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে নামলাম, তখন আমাকে অবাক হতে হলো নানা কারণে। প্যারিস অনেক বদলে গেছে। প্যারিসে ক’দিন থাকার পর লক্ষ করলাম, প্যারিসকে আমি দেখেছিলাম কয়েক দশক আগে, সেই প্যারিস এখন আর তেমন নেই। অনেক বদলে গেছে। বদলে গেছে এ দেশের রাজনীতিও। সনাতন রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। দুই বছর আগে মাত্র তিনি একটি দল গঠন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সবাইকে অবাক করেছিলেন। পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তার দল ভালো করেছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। যেখানেই ঘুরতে গেছি, সেখানেই সুযোগ পেলে ফরাসি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কেন ম্যাক্রোঁ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন? অনেকগুলো কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। এক. যদিও তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। কিন্তু অর্থনীতিতে তিনি গতি আনতে পারছেন না। এখন প্রচুর কর দিতে হয় ফরাসি নাগরিকদের, যা তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ। বিশাল করের বোঝা মাথায় নিয়ে একজন ফরাসি কর্মজীবী প্রতিদিন পার করেন। এখানে অসন্তোষ আছে। দুই. প্রচুর বিদেশি, বৈধ ও অবৈধ এখন প্যারিসের মতো শহরে বসবাস করে। তারা নানা সমস্যা ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাবও আমি লক্ষ করেছি। অবৈধ অভিবাসীরা একটা বড় সংকট তৈরি করছে। এরা নানাবিধ কুকাজে নিজেদের জড়িত করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এসব অভিবাসীর কারণে একটি সংকর জাতির জন্ম হচ্ছে ফ্রান্সে।
এটা আমি জার্মানিতেও দেখেছি। আদি ফরাসি কিংবা আদি জার্মান নাগরিক আগামী ১০ বছর পর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে থাকতাম ঠরষষবৎং-ষব-ইবষ নামে একটি এলাকায়। প্যারিস থেকে কিছুটা দূর, বলা যেতে পারে উপশহর। এখানে ফরাসিদের পাশাপাশি মুসলমানপ্রধান দেশগুলো (মরক্কো, আলজেরিয়া, লেবানন ইত্যাদি) থেকে আসা অভিবাসীদের প্রাধান্য বেশি। দেখলে বোঝার উপায় নেই কে ফরাসি, কে আরব দেশ থেকে আসা। এই মিশ্র জাতি নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে এখানে। আমার এক আত্মীয়, যার দুই সন্তান, এক ছেলে ও এক মেয়ে। ওদের সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলতে পারিনি। ইংরেজি বোঝে কম। স্কুলে যায়। মায়ের সঙ্গেও কথা বলে ফ্রান্স ভাষায়। মাও এখানে স্কুলে গেছে। স্কুল পাস করেছে। মাও সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন ফ্রান্স ভাষায়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি। বাংলাদেশের সঙ্গে যে সন্তানের (ইসরাত ওর নাম) রক্তের সম্পর্ক, সে কিনা বড় হচ্ছে ফরাসি সংস্কৃতি ধারণ করে! ইশরাতদের মতো শিশুরা ফরাসি নাগরিক। বাংলা আর ফরাসি এক হয়ে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। ঠিক তেমনি আরবি আর ফরাসি সংস্কৃতি মিলনের ফলে জন্ম হচ্ছে নতুন সংস্কৃতির। চোখে পড়ে যখন আফ্রিকা থেকে আসা এক তরুণ প্রবাসী কোনো তরুণীকে বিয়ে করে অথবা একসঙ্গে থাকে। তাদের ঘরে যে সন্তান আসে, তা পূর্ণ শ্বেতাঙ্গও নয়, আবার পূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গও নয়। এ সংখ্যা লাখ লাখ। রাস্তাঘাটে চলাচল করলে এদের দেখা যায়। এদের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মূল ফরাসিরা। তিন. মাগরেবভুক্ত দেশগুলো (আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া ইত্যাদি) থেকে যারাই এসেছে, তারা শতকরা ১০০ ভাগ মুসলমান। এদের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় জেনারেশন উগ্র ইসলামিক চিন্তা-চেতনায় আকৃষ্ট হচ্ছে। এরা জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে ইসলামি জঙ্গিবাদ আদর্শকে গ্রহণ করছে। বেকার। উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই। ভালো চাকরি নেই। হতাশাগ্রস্ত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকাগ্রস্তÑ এসব তরুণকে রিক্রুট করে একদল লোক। তার পর এদের ‘ব্রেন ওয়াশ’ করা হয়। হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়। ওই অস্ত্রই এসব আরবীয় তরুণকে জঙ্গি করে তোলে। এমন নয় যে, এরা নিয়মিত মসজিদে যায়। ধর্মকর্ম করে। ধর্ম সম্পর্কে এদের ধারণাও কম। অথচ এরাই জঙ্গি হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিককালে ফ্রান্সে যতগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে এসব তরুণ (যারা মাগরেবভুক্ত দেশগুলো থেকে এসেছে) জড়িত। ফলে ফ্রান্সের সমাজে এই জঙ্গিবিরোধী তথা ইসলামবিরোধী একটা জনমত আছে। এই জনমতকে পুঁজি করেই ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো উগ্রপন্থি দল সামনে চলে এসেছে। মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। এরা ইসলামবিরোধী তথা শরণার্থীবিরোধী। জার্মানিতেও এই উগ্রপন্থিরা বিজয়ী হয়েছে। প্রথমবারের মতো এএফডির মতো দল পার্লামেন্টে এসেছে। এএফডি ও ন্যাশনাল ফ্রন্টের রাজনীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এই উগ্রপন্থি মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপের সর্বত্র, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। উগ্রপন্থিরা শক্তিশালী হচ্ছে। শরণার্থীদের ইউরোপে প্রবেশ করতে দেওয়া এবং এদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে রাজনীতি করা কিংবা শরণার্থীদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করাÑ বর্তমান ইউরোপের রাজনীতির এটাই হচ্ছে চিত্র।
শরণার্থীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশ শুধু জার্মানি, ফ্রান্স আর ইতালির রাজনীতিকেই বদলে দেয়নি, বরং পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক আর সেøাভাকিয়ার রাজনীতিকেও বদলে দিয়েছে। শরণার্থীরা যখন ইউরোপে ব্যাপক হারে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের ‘কোটা সিস্টেম’ আরোপ করেছিল। ওই কোটা সিস্টেমে প্রতিটি দেশকে শরণার্থী গ্রহণে নির্দিষ্ট কোটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক ও সেøাভাকিয়া তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রতিটি দেশকে ১১ হাজার করে শরণার্থী নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই দেশগুলো তা মানেনি। এমনকি হাঙ্গেরি ও সেøাভাকিয়া ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসে আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এসব দেশে শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনকে কেন্দ্র করে যেমনি একদিকে দক্ষিণপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী মনোভাবও শক্তিশালী হচ্ছে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি। নতুন নতুন রাজনীতিবিদের উত্থান ঘটছে ইউরোপে, যারা তথাকথিত ‘পপুলিজম’-এর কারণে জনপ্রিয় হচ্ছেন। সস্তা সেøাগান, জাতীয়তাবোধের ধারণা তাদের জনপ্রিয় করছে। এক সময়ের ট্রেডিশনাল রাজনৈতিক দলগুলো চলে গেছে পেছনের সারিতে। লি পেন, উইলডার্স, গ্রিল্লও, ভিক্টর উরবানÑ এ নামগুলো এখন ইউরোপের রাজনীতিতে বারবার আলোচিত হচ্ছে। হল্যান্ডে গ্রিয়াট উইলডার্সের দল নির্বাচনে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ঠেলে দ্বিতীয় হয়েছিল, অনেকটা মারিয়ান লি পেনের মতো ফ্রান্সে। লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (ফ্রান্সে) দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এদের সবার মাঝে একটা মিল আছে। এরা সবাই মুসলমান তথা শরণার্থীবিরোধী। এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণারও বিরোধী। উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দ্বারা সবাই চালিত। তাই সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যাবে? ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় ৫১০ মিলিয়ন। ১৯৯৯ সালে একক মুদ্রার (ইউরো) সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর হয় ২০০২ সালে। যদিও মাত্র ১৯টি দেশ ইউরো চালু করেছে নিজ দেশের মুদ্রাকে অবলুপ্ত করে। ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি তার যাত্রা শুরু করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৩ সালে। ১৬ দশমিক ৪৭৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ইইউর যে অর্থনীতি, তা বিশ্বের জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। বড় অর্থনীতির এ সংস্থাটি বিশ্ব আসরে এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন এতে বিভক্তি আসছে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। এই জটিলতা, বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান, জার্মানিতে এএফডির পার্লামেন্টে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভাব নিয়ে ইউরোপের সুশীল সমাজ যখন উৎকণ্ঠিত, ঠিক তখনই অস্ট্রিয়া থেকে এলো আরেকটি দুঃসংবাদ। সেখানকার পার্লামেন্ট নির্বাচনে (১৫ অক্টোবর) বিজয়ী হয়েছে উগ্র দক্ষিণপন্থি দল পিপলস পার্টি। মোট ১৮৩ আসনের মধ্যে তার দল পেয়েছে ৬২ সিট। আরেকটি দক্ষিণপন্থি দল ফ্রিডম পার্টি পেয়েছে ৫১ আসন। আর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়েছে ৫২ আসন। পিপলস পার্টি আর ফ্রিডম পার্টি এখন সরকার গঠন করবে। সেবাসটিয়ান ক্রজ যার বয়স মাত্র ৩১ বছর। তিনি এখন হতে যাচ্ছেন অস্ট্রিয়ার পরবর্তী চ্যান্সেলর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। ১৭ বছর ধরে (২০০০ সাল থেকে) দক্ষিণপন্থি দুটি দল পিপলস পার্টি আর ফ্রিডম পার্টি সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। ইসলাম তথা শরণার্থীবিরোধী রাজনীতিকে পুঁজি করে তারা আবারও ক্ষমতায় এলো। তাদের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যে অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। ইউরোপের যেখানে আমি গেছি, সেখানেই এই আতঙ্কের খবর আমি পেয়েছি। ইউরোপের উগ্র ডানপন্থিরা যদি শক্তিশালী হয়, তা হলে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য। মুসলমানরা বারবার আক্রান্ত হবেন। জার্মানিতে নাজি জমানায় ইহুদিদের যেভাবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়েছিল, সেভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আগামীতে। ফ্রান্স বিপ্লব খরাবৎঃু, ঊয়ঁধষরঃু, ঋৎধঃবৎহরঃু, অর্থাৎ স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা আমাদের শিখিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল ছিল ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত। এই বিপ্লব সেখানে গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করেছিল। অতীতে কখনো ফরাসি গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে পড়েনি, এখন পড়েছে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। বদলে যাচ্ছে ফ্রান্সও।
প্যারিস, ফ্রান্স থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন