নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হোক
25 November 2018, Sunday
গণতন্ত্রী ব্যবস্থার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১. সুষ্ঠু ও অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই ধরনের নির্বাচনের মধ্যে কোনো জনপদ গণতন্ত্রের মহাসড়কে উঠতে সক্ষম হয়। ২. কোনো সরকারের কার্যকাল সমাপ্ত হলে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর। কোনো জনপদে এই দুটির যে কোনো একটি অনুপস্থিতি ঘটলে তখন তার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশে নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজন অথবা যে কোনো সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহের উদ্বেগ ঘটলে প্রয়োজন হয় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংলাপ এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে অবশ্য ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে গভীর অনাস্থা। তীব্র অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সম্পর্কের মারাত্মক অভাব। ফলে বহুবার অতীতে সংকট সমাধানের জন্য সংলাপের ব্যবস্থা হয়েছে কিন্তু কোনো সময় তা ফলপ্রসূ হয়নি। এর কারণ হয়তো এসব সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণকারী বিদেশি বন্ধু অথবা জাতিসংঘের মতো কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্য কোনো সহৃদয় উদ্যোগী মহল। এবারের সংলাপের উদ্যোগকারী বাংলাদেশি কৃতী ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেনের মতো প্রবীণ আইনজীবী। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। চিঠি পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরে জানালেন, ঠিক আছে আমরা সংলাপের জন্য প্রস্তুত। এর আগে অবশ্য সংলাপ কিসের জন্য? সংলাপ কাদের সঙ্গে? সংলাপ কোন প্রয়োজনে? সংলাপের কথা উঠলে এ ধরনের উত্তর এসেছিল। এবার কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যজোটের নেতাদের এবং তার দলীয় নেতাদের সঙ্গে বসে প্রথমে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আলোচনা-পর্যালোচনায় রত ছিলেন। তার পরও দ্বিতীয় দফায় আবারও ক্ষুদ্র পরিসরে বেশকিছু সময় ধরে আলোচনা করেন।
এই সংলাপ কতটুকু সফল হয়েছে সে প্রশ্নের দিকে না গিয়ে জাতীয় পর্যায়ে নেতাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে যে বসেছেন তাও দীর্ঘদিন পর, এটাও কি কম বড় সাফল্য। অবশ্যই এটা গণতন্ত্র ও দেশের জন্য বড় সাফল্য বলে মনে করি। দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় একই ধরনের কাজে রত থেকে পরস্পরে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত যেখানে মেলে না, পরস্পরকে শ্রদ্ধাবোধের বিন্দুমাত্র প্রদর্শিত হয়নি সে ক্ষেত্রে নেতারা একসঙ্গে বসে দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসলেন, আলোচনা করলেন। এটিকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। কতটুকু সফল হয়েছে সে নিয়ে প্রশ্ন থাকবে কিন্তু নিজের ঘরের সমস্যা সমাধানের জন্য এই ধরনের সংলাপ যে বাংলাদেশে সম্ভব হলো তাও কি কম। তা ছাড়া আলোচনায় একজনের মুখ থেকে অন্যজনের মুখের কথা কেড়ে না নিয়ে সম্ভাবনার আবহে একত্রে অন্যের কথা ধৈর্য ধরে শোনার বিষয়টা উল্লেখযোগ্য। যার ফলে বাংলাদেশে এখন রাজনীতির পরিবেশ অনেকটাই বদলে গেছে। সবাই নির্বাচনমুখী হয়েছে।
ভবিষ্যতে যদি জাতীয় সমাধানের জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এভাবে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সমাধানে উদ্যোগী হোন তা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলজনক।
আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকার যে স্বতন্ত্র এবং সরকার ও দল যে সম্পূর্ণরূপে আলাদা নিজেদের দলীয় স্বার্থে আমরা তা ভুলে গেছি। সরকারের সমালোচনা করার জন্যই বিরোধী দলের জন্ম হয়েছে। সমাজে ওই কারণে বিরোধী দলের একজন মন্ত্রীর ক্ষমতা ভোগ করেন। সরকারি ব্যয় তার অবকাঠামো ব্যবস্থায় হয়। কিন্তু রাষ্ট্র এবং সরকার এক করে ফেলে অথবা সরকার এবং দল অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় তা হলে সরকারের সমালোচনা করবে কে, তার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে। তা ছাড়া এই কারণে গত কয়েক বছরের ক্ষমতাসীন সরকারবিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১৮ হাজার মামলা করেছে। এর সঙ্গে জড়িত করেছেন প্রায় ২২-২৩ লাখ নাগরিককে। এর কারণ হলো দেশের শাসন-প্রশাসনে যারা রয়েছে অথবা দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব যাদের এমনকি শিক্ষা, স্বার্থ প্রমুখ বিভাগ কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের বড় একটা অংশ নিয়োগ লাভ করেছেন মেধাভিত্তিক নয় বরং দলের ভিত্তিতে। ফলে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে এবং সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনাস্থার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ধারণা এসব বিষয়ও যদি রাজনৈতিক সমাজ থেকে দূর করতে হয় এবং সরকারকে জনগণের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে হয় তা হলে এই ধরনের সংলাপ বারবার অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। ফলে সরকারি কাজকর্মে যেমন স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে, তেমনি সরকারের গৃহীত পরিকল্পনায় জনগণের আস্থা অনেক বৃদ্ধি পাবে। দেশে অগ্রগতির ধারা ত্বরান্বিত হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এই সংলাপের সাফল্য তেমন বেশি নেই, তার পরও দেশের সংকটকালে বিভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতারা একসঙ্গে বসে নিজের দেশের অবস্থা আলোচনা ও পর্যালোচান করেছেন তা বিশ্বময় প্রশংসিত হয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এই বক্তব্য সঠিক নয়। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য এবং সরকার চাইলেই তা সম্ভব। যে কোনো রাজনৈতিক সমাজে মতনৈক্য থাকবেই। মতানৈক্য আছে বলেই তো সমাজজীবনে গতি রয়েছে। সমাজে সৃষ্টি হয় ভিন্নমত ও ভিন্নপথের সমন্বয়ের পার্থক্যের জন্যই তো রাজনীতি। সুষ্ঠু সমন্বয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণ হবে এবং দুই দলের সংলাপে যা ঘটেছে তাতে বোঝা যায় ভুল বোঝাবুঝি অবসান হয়েছে বলে মনে হয়। কয়েকদিন আগে যে সংলাপ হলো, তা আংশিক সফল নিশ্চয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গায়েবি মামলা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সভা-সমাবেশে বাধা দিচ্ছেন না, তবে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও এখনো মামলা ও গ্রেপ্তার চলছে। এসব মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের জনগণের শ্রেষ্ঠতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণও ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগের বিজয়কে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন দেশের মানুষ গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে থাকে। ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত সংলাপের পর সাধারণ তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী মাঠে মনোনয়নপ্রার্থীদের হৈ-হুল্লোড়মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। আশা করি এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এবং সবাই মিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের যোগ্য নাগরিক দায়িত্ব পালন করবে। ভোট দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
য় ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন