আমাদের পথচলা হয়ে উঠবে দুর্দমনীয়
28 October 2018, Sunday
মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন স্মরণ করি, তখনই অনুধাবনে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এই জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রতœভা-ার সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনী বালুবাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালি দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এ প্রক্রিয়ার শুরু কখন তা কেউ জানি না বটে; কিন্তু ইতিহাসবিদদের ধারণায় এই জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছরেরও আগে। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এই জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম অথবা মধ্য ভারতে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে, যদিও এই জনপদ দীর্ঘদিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম এই জনপদ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং এর শাসন-প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই মাটির সন্তানরা। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অন্বেষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ১৩টি কলোনিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে, বাংলাদেশের জনগণও তেমনি সাম্য-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে জনগণের সাহস-শৌর্য ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে। একাত্তরের মার্চ মাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ার অধ্যায়টি বিশ্ব ইতিহাসে অন্যরকমভাবে স্বীকৃত। মার্চ আমাদের স্বাধীনতা আর ডিসেম্বর বিজয়ের মাস।
একাত্তরের মার্চে যার সূচনা ডিসেম্বরেই তার চূড়ান্ত পরিণতি। তাই মার্চ ও ডিসেম্বর এলেই অনিন্দ্য এক অনুভূতির স্পন্দন পাই। মার্চ ও ডিসেম্বরে পা দিয়েই অনুভব করি পায়ের নিচে শক্ত মাটির স্পর্শ। লাভ করি অনির্বাচনীয় আত্মবিশ্বাস। ফিরে পাই এক অনিন্দ্যসুন্দর আত্মশ্লাঘা। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত পেরিয়ে ২৬ মার্চ যে নতুন সূর্য উঠেছিল সেই সূর্য ছিল স্বাধীনতার। ২৫ মার্চ রাতের প্রতিরোধ শেষে ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো জাতি। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। আমাদের তো সবারই জানা যে, এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। টানা নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে। তারও আগে নিতে হয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কেউ পেছন ফিরে তাকায়নি। মা তার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন অশ্রু আড়াল করে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বাবা ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল মুক্তিকামী বাঙালি। একাত্তরের এ জনপদের মানুষ ছিল অরক্ষিত। বাংলাদেশের অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
স্বাধীনতা অর্থাৎ আমাদের বৃহৎ অর্জনের পরও জাতি হিসেবে আমরা তা কতটা ধরে রাখতে পেরেছি, এমন প্রশ্ন কখনো কখনো ওঠে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই। আমরা আজও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে পারিনি। জাতীয় লক্ষ্য কতটা স্পষ্ট, প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। জাতিসত্তার যে অমিত তেজ অসম্ভবের বিন্দাচল টলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল তা কখনো যেন হয়ে পড়ে চলৎশক্তিহীন, নিশ্চল। এমনটি তো আমাদের কাক্সিক্ষত নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জনÑ এ নিয়ে কোনো দ্বিমত বা সংশয় নেই। এই অর্জনের তাৎপর্য হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির পথ নির্বিঘœ করে তোলা, যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা ও উচ্চারণ জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। এই অর্জনের মৌল তাৎপর্য হলো, এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, এই বিজয় পুরো জাতির বিজয়।
ভাবতে হবে দেশের কোটি কোটি সন্তানের কথা। তাদের ভাবনা-চিন্তা ও আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। যেভাবে হিংসাত্মক মনোভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের উগ্র কিংবা বিদ্বেষী করে রেখেছে তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সার্থকভাবে মোকাবিলা করার কথা। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ মূলধন ছিল জনসমষ্টির মধ্যে এক ইস্পাতকঠিন ঐক্যবোধ। কিছুসংখ্যক বিপথগামী ছাড়া দেশের সব ধর্মের অনুসারী, সব মত ও পথের অনুসারী তাদের ভাগ্যকে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন ওই সঙ্কটকালে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার সংগ্রামে। কেউ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কেউ তরুণদের প্রেরণা জুগিয়েছেন, কেউ অর্থ বা অন্যান্য সামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়ে সংগ্রামে অংশ নেন। কেউ কেউ সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কেউ বা অংশ নিয়েছেন সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি জানিয়ে এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করে। মোট কথা, জাতীয় সংকটকালে জাতির মুক্তির জন্য এই জাতির সবাই অংশ নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে। তাই সম্ভব হয়েছিল নয় মাসে বিজয় অর্জন অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটানো।
এ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে এমনভাবে সাজানো, যেখানে থাকবে না নির্যাতনের কোনো লেশমাত্র। থাকবে না নিপীড়নের কোনো চিহ্ন। শোনা যাবে না বঞ্চনার কোনো করুণ কাহিনি। দেখা যাবে না শোষণের কোনো ক্ষতচিহ্ন। কেউ শুনবে না শোষিতের ক্রন্দন। এমন প্রত্যাশা নিয়েই তো এই জনপদের জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করে এই সংগ্রামে স্বাধীনভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দিকে না তাকিয়ে, বিশ্বের তাবৎ বড় শক্তি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে গ্রহণ করবে, সেদিকে কোনো দৃষ্টি না দিয়ে এ দেশের মানুষ ছুটে গিয়েছিল শত্রু নিধনে। এই জীবন-মরণ সংগ্রামে কেউ সহায়তা করবে কিনা, এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা কখনো সন্দেহপীড়িত হয়নি। কোনো রাষ্ট্র ভালো বলবে, এমন চিন্তা-ভাবনায় সেদিন আমাদের জাতীয় মনীষা বিচলিত হননি। যারা শহীদ হয়েছেন জাতির প্রতি শ্রদ্ধাসিক্ত হয়ে, আজও তারা মাথা উঁচু করেই রয়েছেন। থাকবেন অনন্তকাল। এই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপদ নয়। বিশ্বের প্রতি ৪৬ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। কারো কারো জীবজন্তু নিয়ে খেলা করার অভ্যাস রয়েছে। কিন্তু ওই সব জীবজন্তু সব সময় হয় অতি ক্ষুদ্র। ইঁদুর, বিড়াল, পাখি ইত্যাদি। হাতি কিন্তু কারো খেলার সঙ্গী হয় না। জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশ তো নিশ্চয় হাতি, হোক না বাংলাদেশ হাজারো সমস্যাকিষ্ট। তাই বাংলাদেশকে কেউ খেলনা হিসেবে ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে না, যদি না বাংলাদেশ নিজেই অন্যের খেলনা হিসেবে ববহৃত হতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেহতনায় উদীপ্ত হয়েছিল পুরো জাতি। এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার সম্পর্কে। আমাদের বিদ্যমান জাতীয় সংকট উত্তরণে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছিল জাতীয় জীবনের তিনটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্জন। তা হলোÑ ১. আমাদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য, ২. নেতৃত্বের আত্মনির্ভরশীলতা, ৩. আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য। এগুলো আমাদের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারগুলোকে প্রতিবাদে প্রতিক্ষণে যদি আমরা শানিত রাখতে পারি তা হলে অতীতে যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে আমরা সংকটকাল অতিক্রম করেছি বর্তমানেও তা সম্ভব হবে। যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আত্মত্যাগের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন, তাও আমাদের নাগালের মধ্যে আসবে।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাইরের কোনো শক্তির নির্দেশ বা প্রণোদনায় নয় বরং স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। পথ চলতে চলতে কিছু সুহৃদের কোমল পরশ আমরা লাভ করেছিলাম, যা ছিল হঠাৎ পাওয়া সুখের স্পর্শ। লক্ষ্য কিন্তু নির্ধারিত হয়েছিল এ মাটিতেই, এ মাটির সন্তানদের দ্বারা। এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। মুক্তিযুদ্ধের এই উত্তরাধিকার প্রতি প্রজন্মকে ধারণ করাতে পারলে আমাদের পথচলা হয়ে উঠবে দুর্দমনীয়। আর দুর্দমনীয় হবে চলতি পথে যদি সংযুক্ত হয় জাতীয় মেধা আর ধীশক্তি।
য় ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন