জয় হোক গণতন্ত্রের
30 September 2018, Sunday
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করবেÑ এ কথা তারা এ পর্যন্ত বলেনি। ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার প্রয়োজনে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাসহ বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং কারারুদ্ধ খালেদা জিয়াকে মুক্তিদানের ব্যাপারে তারা দাবি জানিয়ে আসছে। তারা আগামী নির্বাচনে সমতল ভূমি তৈরির নিশ্চয়তাও চাচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের দৃষ্টিতে মূল্যায়িত পরিস্থিতির আলোকে নানারকম দাবি জানাতেই পারেন এবং সেসব দাবি যদি আমলযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য হয়, তা হলে সেসব উপেক্ষা করা ক্ষমতাসীন মহলের উচিত নয়। কিছু দিন আগে বিএনপির তিনজন শীর্ষ নেতা কারারুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেল, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এর পর বিএনপির যৌথ সভায় দলের কয়েকজন নেতা মতামত ব্যক্ত করেছেন, খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়ানো ঠিক হবে না।
তারা দলের চেয়ারপারসনকে কারাবন্দি রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করতে চান না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। বেশ কিছু কেন্দ্র ছিল ভোটারবিহীন। নির্বাচনী উৎসব কার্যত দেশের কোথাও ছিল না; কিন্তু বহু কেন্দ্রে দেখা গেছে জালভোটের মহোৎসব! তখনকার পত্রপত্রিকার পাতা ওল্টালে এসব বিষয় স্পষ্টাক্ষরে মুদ্রিত দেখা যাবে। মানুষের ওপর আমি আস্থা রাখি। এ দেশের গণতন্ত্র সুরক্ষায় তারাই সব সময় এগিয়ে এসেছে। প্রয়োজনে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই প্রত্যাশা করি ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। তাদের মধ্যে এমনটির প্রকাশ ঘটলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতা-সদিচ্ছা এবং জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা-সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য এসবই প্রয়োজন।
অনেকেই বলেন, বিএনপির পক্ষে যথেষ্ট জনসমর্থন থাকার পরও কেন ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের পর সরকারকে তারা ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি! হ্যাঁ অবশ্যই সত্য বটে, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন কোনো দল নয়। কিন্তু সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের অনুপ্রাণিত করতে শক্তি জোগাতে, মাঠে তাদের আন্দোলন বেগবান করতে নেতাদের সামনে থাকা খুব জরুরি। কিন্তু বিএনপির নেতারা তো মাঠেই নামতে পারেন না, কোনো সভা-সমাবেশ করার অনুমতি সহজে পান না। পেলেও তা পাচ্ছেন খুব সীমিত পরিসরে। হামলা-মামলায় তারা বিপর্যস্ত। নানাভাবে তাদের ওপর হামলা হয়েছে, হচ্ছে এবং মামলার তো অন্তই নেই। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক অধিকার সবার সমান থাকবেÑ এটিই তো সঙ্গত। কিন্তু বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা কি তাদের অধিকার ভোগ করতে পারছেন? রাজনীতির মাঠ অধিকারের ক্ষেত্রে সবার জন্য যদি সমতল না হয়, তা হলে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্যদের অবস্থা বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিএনপির নেতারা চাচ্ছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক সবার অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ। কিন্তু এমনটির জন্য যা যা প্রয়োজন, সেসব কি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা গেছে? এমতাবস্থায় বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের সফলতা-ব্যর্থতার বিষয়টি মূল্যায়ন কঠিন থেকে হয়ে ওঠে কঠিনতর।
নির্বাচন একটি জাতীয় ব্যাপার, মোটেও দলীয় ব্যাপার নয়। নির্বাচন কমিশনের একক কাজও নয় নির্বাচন করা; যদিও এ ক্ষেত্রে তারাই মুখ্য। নির্বাচন সফল করার জন্য সবার সহযোগিতা দরকার। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন মহলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ক্ষমতাসীন মহল যদি সহযোগিতা না করে, তা হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। কখনো কোথাও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ব্যবস্থায় হবে, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে। এই বিতর্কের নিরসন করতে খোলামনে আলোচনার বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে এর আগে সংলাপ করেছে। অতীতের দিকে তাদের দৃষ্টি দিতে হবে এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অনেকেরই অভিমত হলো, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি তারাও মূল্যায়ন করুক। বিভিন্ন পরীক্ষা তাদের সামনে আসবে, সেসব ক্ষেত্রে তাদের উতরাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, তখনই নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। অন্য দলগুলোর জন্যও কি এই সুযোগটা থাকা উচিত নয়? সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি না করে আন্দোলন কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্যদের সফলতা-ব্যর্থতার বিষয়গুলো নির্ণয় করা দুরূহ বিষয়। আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হোক। আবারও বলি, নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সঠিকভাবে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্বাচন একটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেখা গেল, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনেই আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোট মিত্ররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন। বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচন হলেও দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা পেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। গণতন্ত্রে এমন পরিস্থিতি কোন ধরনের জয় হিসেবে মূল্যায়িত হতে পারে? সরকার গঠন করেই বিরোধীদের দমন-পীড়ন শুরু হয় অর্থাৎ আবার সেই পুরনো প্রক্রিয়া। এত সব চাপ সামলে বিরোধীদের রাজনীতির মাঠে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। বিএনপি যেহেতু জনবিচ্ছিন্ন কোনো রাজনৈতিক দল নয়, সেহেতু এত চাপ সহ্য করেও এগিয়ে চলেছে। ওই প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মাঝে গণতন্ত্র কী করে বিকশিত হতে পারে? কিংবা অধিকারের সমতল ভূমি নিশ্চিত হতে পারে? গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেওয়ার বিষয়টি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনোভাবেই সিদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ময়দানে সবার সমান অধিকার থাকবে, এটিই রীতি কিংবা নিয়ম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ধারণা দিয়েছিলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করতে হচ্ছে। তিনি যথাশিগগির সম্ভব একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর শপথ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছে। এই ভুলের জন্য তাদের মাশুল দিতে হবে।’
রাজনীতিতে ভুল হতেই পারে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি পদ্ধতি। ক্ষমতায় থেকে কোনো মহল যদি নেতিবাচক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারে, তা হলে বহুবিধ ঝুঁকি থেকে যায়। এ দেশের রাজনীতিতে সহনশীলতার খুব অভাব। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য। আমাদের রাজনীতিকদের গঠনমূলক রাজনীতির পথ অনুসরণ করতে হবে। তাদের প্রতি বরাবরই আমি শ্রদ্ধাশীল। সেটা মনে রেখেই বলছি, তারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেনÑ এটাই প্রত্যাশা। আলোচনার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সব সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। দুই প্রধান দলের নেত্রীই অভিজ্ঞ। তারা উভয়েই বুঝবেন যে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতিটুকু হচ্ছে, তা ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন হওয়াটা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি। গণতন্ত্রের জন্যও তা অপরিহার্য।
অনাকাক্সিক্ষত প্রেক্ষাপটে দশম জাতীয় সংসদ নামে নির্বাচনটি হয়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এমনটি না হয়, এই প্রচেষ্টা থাকুক। দেশ শান্তি-সমৃদ্ধির পথে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবেÑ এটাই আমাদের কামনা। অনেক হতাশার মধ্যেও রাজনীতিবিদদের কাছে আমরা আশার বাণী শুনতে চাই। সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে কাজ করতে হবে রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনÑ এটি যেন আমরা ভুলে না যাই। ভবিষ্যতের নির্বাচন হোক অনুসরণ ও দৃষ্টান্তযোগ্য। জয় হোক গণতন্ত্রের। বিএনপিসহ প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল যাতে রাজনৈতিক কর্মসূচি সমঅধিকার নিয়ে সুচারুভাবে পালন করার অধিকার পায়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অনুমতির রাজনীতি কিংবা অনুমতির গণতন্ত্র কাম্য নয়। অনুমতির রাজনীতি গণতন্ত্রে স্বীকৃত নয়। গণতন্ত্র হলো সবার অংশগ্রহণমূলক একটি প্রক্রিয়া। সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করা সম্ভব।
য় ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন