গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হবে নতুনভাবে প্রাণবন্ত
17 January 2018, Wednesday
ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা কবি জন কিটস John Keats (১৭৯৫-১৮২১) তার Endyrnion গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন : A thing of beauty is a joy for ever : its loveliness increaces; it will never pass into nothingness [একটি চমৎকার জিনিস সব সময়ের জন্য আনন্দদায়ক। এর চমৎকারিত্ব বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। কোনোদিন তা অর্থহীন হয়ে উঠবে না।]
কবি জন কিটসের এই লাইনগুলো ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং এর প্রথম পঙ্্ক্তিটি লাখ লাখ ব্যক্তি উদ্ধৃত করেছেন, কারণে অথবা অকারণে। আমিও আমার ছোট্ট লেখাটি শুরু করছি জন কিটসের অমর এই লাইনগুলো উদ্ধৃত করে আগামী বছরে আমাদের প্রত্যাশার কিছু কথা তুলে ধরছি।
দুই হাজার আঠারো তোমার ওপর ভরসা রেখে সমগ্র বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে। পুরনোকে ভুলে নতুনের আশায় রইলাম।
তুমি ধুয়েমুছে সাফ করে দাও আমাদের চলার পথটা। বড্ড বেশি কাদা জমেছে। ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, ছুটে চলা দূরে থাক। অথচ আমাদের অতিক্রম করতে হবে হাজার যোজন পথ। পৌঁছতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। স্পর্শ করতেই হবে বিজয় স্তম্ভ।
আমাদের নেই কী। আছে তো প্রায় সবই। আকাশছোঁয়ার স্পর্ধায় সচকিত তারুণ্য আমাদের অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। যে মাটির ওপর হামাগুড়ি দিতে দিতে প্রথম মা উচ্চারণে সবাইকে তাক লাগিয়েছি, সেই উর্বর মাটি সীমাহীন মমতায় সবাইকে বুকে ধারণ করে রেখেছে। মাটির নিচে যে সম্পদ সঞ্চিত রয়েছে তাও কী কম? মাটির বুক চিরে প্রবাহিত হাজারো নদ-নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল আর হাওর-বাঁওড় এক একটা স্বর্ণখনি। মাথার ওপর বারো মাসের প্রায় সাত কী আট মাসব্যাপী সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশ তো এ জাতির মস্ত বড় আশীর্বাদ। তার পরও কেন প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছি আমরা?
এ জন্য কে বা কারা দায়ী তা ভেবে মন খারাপ করার তো প্রয়োজন নেই। বাতি জ্বলে উঠলে অন্ধকার দূর হবেই। আবর্জনা-জঞ্জাল অপসারিত হলে পথ সুগম হবেই। কাদামাটির এ দেশে সূর্যের খরতাপ এবং সঞ্জীবনী আলোই পারে চলার গতি দ্রুত করতে। তাই তো এত আবেগ ভরে আমরা চাই খরতাপ আর আলো। আমাদের জন্য এটিই হলো ধ ঃযরহম ড়ভ নবধঁঃু একমাত্র গণতন্ত্রই সবার আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে। সবার জীবনকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। একবার এই চমৎকার জিনিসটির মূল সমাজজীবনের গভীরে প্রবেশ করলে সব সময়ের জন্য এর চমৎকারিত্ব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং হিংসা-প্রতিহিংসার মতো রূঢ়, অমানবিক, অনাকাক্সিক্ষত চেতনা মাটির সঙ্গে মিশে গেলে সমগ্র জাতির জন্য অনাবিল আনন্দের আবহ সৃষ্টি করবে। সামাজিক ক্ষেত্রে এর রমণীয়তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করলে এবং এর গভীরতা জাতীয় মননের সঙ্গে মিশে গেলে কোনোদিন তা আলগা হয়ে ভেদবুদ্ধি বা বিভাজনের করালগ্রাসে অর্থহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এ জন্য চাই জাতীয় নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং সুস্পষ্ট এক ভিশন (ঠরংরড়হ), দুই বা তিন যুগ পরে আমরা দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ব্যাধির মতো ব্যত্যয়ের ওপর কতটুকু বিজয় অর্জন করব বা সার্বিক অগ্রগতির পথে কতটুকু অগ্রসর হব সে দিকনির্দেশনার জন্য নেতৃত্বের সৃজনশীলতাই সেই খরতাপ। নেতৃত্বের দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ হয় তা হলে হিংসা-প্রতিহিংসা-আবর্জনা রাজনৈতিক জীবনকে আর কলঙ্কিত করবে না। আলো যদি উজ্জ্বল হয় তা হলে দুর্নীতির অভিশাপ অর্থনীতির গতি মন্থর করবে না। সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় সমাজজীবনের মৌল সূত্রগুলো আর আচ্ছন্ন হবে না। অতীতমুখী প্রবণতা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নকে আর আবছা করতে পারবে না। সর্বোপরি সূর্যের খরতাপ এবং আলো অর্থাৎ আমাদের কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি সমাজের সর্বস্তরে কার্যকর করতে হয় তা হলে নতুন জীবনীশক্তির পরশমণির ছোঁয়ায় জাতির চিৎশক্তিকে নতুনভাবে জাগ্রত করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা হবে স্বচ্ছ, অবাধ, গ্রহণযোগ্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। রাজনীতি হবে কল্যাণমুখী। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সুখদ গণতন্ত্রের আলোয় আলোকিত হয়ে হিংসা-প্রতিহিংসার পরিবর্তে জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হবে নতুনভাবে প্রাণবন্ত।
পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় রাজনীতিকে সৃজনশীল ধারায় প্রবাহিত করতে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। রাষ্ট্রীয় কৃত্যকরা দলীয় আনুগত্য পরিহার করে জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠবেন। হাজারো শর্তে বিভক্ত জাতি আবারও ঐক্যবদ্ধ হবে। নিজেদের অধিকার উপভোগ করে জনগণ সার্বিক নিরাপত্তায় স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবেন। দুই হাজার আঠারো, তোমার আমলেই আমরা এর শুভ সূচনা দেখতে চাই। দেখতে চাই চারদিকে আমরা সবাই যেন নতুন বছরে খোলামন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখেছি।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন