মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের কথা যখন স্মরণ করি তখনই অনুধাবনে আসে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় ছিল এ জাতির চার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রতœভাণ্ডার সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনী বাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালী দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এ প্রক্রিয়ার শুরু কখন তা কেউ জানি না বটে, ইতিহাসবিদদের ধারণায় কিন্তু এ জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার বছরেরও আগে। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সবসময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম অথবা মধ্য ভারতের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সাথে, যদিও এ জনপদ দীর্ঘ দিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম এ জনপদ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং এর শাসন-প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই সন্তানেরা। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় এ জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক।
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহানমন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অšে¦ষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ১৩টি কলোনিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে, বাংলাদেশের জনগণও তেমনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে জনগণের সাহস, শৌর্য ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে। এ জন্য ডিসেম্বরকে আমরা বিজয়ের মাসরূপে চিহ্নিত করি। একাত্তরের মার্চে যার সূচনা, ডিসেম্বরেই তার চূড়ান্ত পরিণতি। তাই ডিসেম্বর এলেই অনিন্দিত এক অনুভূতির সন্ধান পাই। ডিসেম্বরে পা দিয়েই অনুভব করি পায়ের নিচে শক্ত মাটির স্পর্শ। লাভ করি অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাস। ফিরে পাই এক অনিন্দ্যসুন্দর আত্মশ্লাঘা।
আমি স্বপ্ন দেখি আমার জন্মভূমিকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের- যা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, যুক্তিবাদী মুক্তমনের অধিকারী, হৃদয়বান নাগরিকের বাংলাদেশ। আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ, সৃজনশীলতায় উদ্দীপ্ত, নিজেদের ভাগ্য গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আস্থাশীল নাগরিকের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে থাকবে না দারিদ্র্য, থাকবে না অপুষ্টি, ব্যাধি। সমাজ থাকবে দুর্নীতির কলুষমুক্ত, স্বার্থপরতা এবং সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, আকাশের মতো উদার, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পশূন্য, সব মত-পথ-বিশ্বাসের অবাধ চারণক্ষেত্র। মিলনের তীর্থক্ষেত্র, শহীদ মিনারের মতো। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কেন্দ্র হয়েও আন্তর্জাতিকতা এবং মানবমুখিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের এক দিকে যেমন রূপান্তরিত হতে হবে দক্ষ, সুশিক্ষিত, সৃজনশীল মানবসম্পদে, অন্য দিকে তেমনি পরিণত হতে হবে উত্তম ব্যক্তিতে। প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিতে। বিশাল জনসমষ্টির এই দেশটাকে তার ঐতিহাসিক গন্তব্যে উপনীত হতে হলে, বিশেষ করে তার উন্নত সাংস্কৃতিক আবহ সংরক্ষণে সক্ষম হতে হলে বৃহত্তর বৈশ্বিক আরণ্যে সুদৃশ্য এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছোট্ট বাগানের মতো হয়েই বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করতে হবে। মানব উপাদান হিসেবে উন্নত বিশাল জনসমষ্টির এই বাংলাদেশকে আমি দেখি শত সম্ভাবনাময়, প্রগতিশীল, অগ্রগামী, শান্তিপূর্ণ, কল্যাণমুখী, সৃজনশীল এক জনপদরূপে।
এমন বৃহৎ অর্জনের পরও কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে হয়। জাতীয় ঐক্য খণ্ড-ছিন্ন হয়েছে। জাতীয় লক্ষ্যও অস্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। জাতিসত্তার যে অমিত তেজ অসম্ভবের বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল, তা যেন চলৎশক্তিহীন ও নিশ্চল। কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর এই লেখায় নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনের তাৎপর্য হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির শত পথকে নির্বিঘ্ন করে তোলা যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা ও উচ্চারণ জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। এই অর্জনের মৌল তাৎপর্য হলো, এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই বিজয় পুরো জাতির বিজয়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিজয় নয়। এই সত্যের বিকৃতি ঘটানোর স্পর্ধা যেন কারো না হয়। ভাবতে হবে, দেশের কোটি কোটি সন্তানের কথা। তাদের ভাবনাচিন্তা এবং আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। যেভাবে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছে, তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সার্থকভাবে মোকাবেলা করার কথা।
মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ মূলধন ছিল জনসমষ্টির মধ্যে এক ইস্পাতকঠিন ঐক্যবোধ। কিছুসংখ্যক বিপথগামী ছাড়া দেশের সব ধর্মের অনুসারী, সব মত ও পথের অনুসারী তাদের ভাগ্যকে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সাথে। তাই জাতি-ধর্ম-পুরুষ-ধনী-নিধন নির্বিশেষে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন ওই সঙ্কটকালে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার সংগ্রামে। কেউ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কেউ তরুণদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। কেউ অর্থ বা অন্যান্য সামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়ে সংগ্রামে অংশ নেন। কেউ কেউ সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কেউবা অংশ নিয়েছেন সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি জানিয়ে এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করে। মোটকথা, জাতীয় সঙ্কটকালে জাতির মুক্তির জন্য এই জাতির সবাই অংশ নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে। তাই সম্ভব হয়েছে মাত্র ৯ মাসে বিজয় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি।
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি প্রকৃতি ছিল এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। এ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে এমনভাবে সাজানো, যেখানে থাকবে না কোনো নির্যাতনের লেশমাত্র। থাকবে না নিপীড়নের কোনো চিহ্ন। শোনা যাবে না বঞ্চনার কোনো করুণ কাহিনী। দেখা যাবে না শোষণের কোনো ক্ষতচিহ্ন। কেউ শুনবে না শোষিতের ক্রন্দন। এমনি প্রত্যাশা নিয়েই বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার এই সংগ্রামে স্বাধীনভাবেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কারো ওপর নির্ভর না করে, কারো নির্দেশ না মেনে, কারো ভয়ে ভীত না হয়ে অথবা কারো সাহসে সাহসী না হয়ে, নিজেদের ওপর আস্থা রেখে সবাই অগ্রসর হয়েছেন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) দিকে না তাকিয়ে, বিশ্বের তাবৎ বড় শক্তি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে গ্রহণ করবে, সেদিকে কোনো দৃষ্টি না দিয়ে এ দেশের গণমানুষ ছুটে গিয়েছিলেন শত্রু নিধনে। এই জীবন-মরণ সংগ্রামে কেউ সহায়তা করবে কি নাÑ এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা কখনো সন্দেহপীড়িত হয়নি। কোন রাষ্ট্র ভালো বলবেÑ এমন চিন্তাভাবনায় সেদিন আমাদের জাতীয় মনীষা বিচলিত হয়নি। যারা শহীদ হয়েছেন জাতির শ্রদ্ধাসিক্ত হয়ে আজো তারা মাথা উঁচু করেই রয়েছেন। থাকবেন অনন্তকাল। এই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। বাংলাদেশ ছোট্ট কোনো জনপদ নয়। বিশ্বের প্রতি ৪৬ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশই সর্বশেষ স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র। জাতিসঙ্ঘের ১৩৩তম সদস্য।
কারো কারো জীবজন্তু নিয়ে খেলা করার অভ্যাস রয়েছে বটে; কিন্তু ওই সব জীবজন্তু সবসময় হয় অতি ক্ষুদ্র। সাদা ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, শুশুক বা ছোট পাখি। হাতি কিন্তু কারো খেলার সাথী হয় না। জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশ তো হাতি নিশ্চয়ই, হোক না এর জনগণ দরিদ্র, হোক না বাংলাদেশ হাজারো সমস্যাক্লিষ্ট। তাই বাংলাদেশকে কেউ খেলনা হিসেবে ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে না, যদি না বাংলাদেশ নিজেই অন্যের খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো কোনো ব্যক্তির নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল পুরো জাতি। এখন এসব বাণী প্রচার অর্থহীন। এতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে। ফাটল ধরতে পারে জাতীয় সংহতিবোধে। এখন সবচেয়ে বেশি করে মনোযোগ দেয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার সম্পর্কে।
সেই জাতীয় সঙ্কট থেকে উত্তরণে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছিল আমাদের জাতীয় জীবনের তিনটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্জন : আমাদের ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য, নেতৃত্বের আত্মনির্ভরশীলতা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য। এগুলোই আমাদের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারগুলোকে প্রতিপদে ও প্রতিক্ষণে যদি আমরা শাণিত রাখতে পারি, তাহলে অতীতে যেভাবে সাফল্যের সাথে সঙ্কটকাল অতিক্রম করেছি; বর্তমানেও তা সম্ভব হবে এবং যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আত্মত্যাগের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন, তা-ও আমাদের নাগালের মধ্যে আসবে।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাইরের কোনো শক্তির নির্দেশ বা প্রণোদনায় নয়; বরং স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ওই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। পথ চলতে চলতে কিছু সুহৃদের কোমল পরশ আমরা লাভ করেছিলাম, তা কিন্তু ছিল হঠাৎ পাওয়া সুখের স্পর্শ। লক্ষ্য কিন্তু নির্ধারিত হয়েছিল এ মাটিতেই, এ মাটির সন্তানদের দ্বারাই, এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। আবারো বলব, মুক্তিযুদ্ধের এই উত্তরাধিকার ধারণ করতে পারলে আমাদের পথচলা হয়ে উঠবে দুর্দমনীয়। আর দুর্দমনীয় হবে চলতি পথে যদি সংযুক্ত হয় জাতীয় মেধা আর ধীশক্তি।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন