দোটানায় ভারত-চীন ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ
22 September 2017, Friday
এত বড় মানবিক বিপর্যয় আর একবার দেখেছিলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর, পূর্ব- সব দিক দিয়ে মাথায় ছোট্ট একটা বাক্স অথবা পুঁটলি নিয়ে সারিবদ্ধ মানুষ ছুটে চলেছে সীমান্ত পার হয়ে একটু নিরাপত্তার জন্য ভারতে। শিশু-বৃদ্ধ-তরুণ-তরুণীর এমন অসহায় মিছিল আবার দেখতে হলো এই সময়ে মিয়ানমার থেকে আসা অসহায় মানুষদের তেমনি মিছিল বাংলাদেশের দিকে।
একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় সেই ছবিটি- ‘বিপম্ন মানবতা : মা তার কাঁদে ছেলেটি মরে গেছে।’ মাত্র ৪০ দিনের বাচ্চাটি মায়ের কোলে। মা বাচ্চাকে হয়তো আশ্বস্ত করছিল- এই তো এসে গেছি, একটু ধৈর্য ধরো, বাপ আমার। বারে বারে চুমু দিয়ে তাকে সাহস দিচ্ছিল- আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর আমরা নিরাপদে ঠিক জায়গায় চলে যাব। বাপ আমার কেঁদো না। হায়রে মায়ের মন। ছেলেটি চলে গেছে অতি নিরাপদ স্থানে। কোনো শত্রু আর তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু স্টেম্নহময়ী মায়ের মন। তার পরও মা বাচ্চাটির মুখে মুখ লাগিয়েই রয়েছে। এমন দৃশ্যের বিবরণ হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও ঠিক ঠিক দেওয়া সম্ভব নয়। এই মাকেও বেঁচে থাকতে হবে অন্য ছেলেমেয়ের জন্য। খেতে হবে। পরতে হবে। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যারা আহত হয়েছে তাদের সেবা করতে হবে। একটু ঠাঁইয়ের জন্য সংগ্রাম করতে হবে।
আর একটা ছবি সমিরা বেগমের। বয়স ষোল কি সতের। উদ্ভ্রান্তের মতো টেকনাফের শ্যামলপুর বাজারে। মিয়ানমার থেকে কোনো রকমে পালিয়ে আসা এক কিশোরী। অন্যদের থেকে একটু স্বতন্ত্র। চোখে-মুখে বেদনার ছাপ সুস্পষ্ট। এই ছোট্ট জীবনে, মাত্র ষোল বছরের জীবনে এমন নির্মম ঝড়। সবকিছু যেন তার উজাড় করে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে বাবা-মা আর দুই ভাই শয়তানদের হাতে খুন হয়েছে। চার বোন হয়েছে ধর্ষিতা। নিজে কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচেছে। এসেছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য। আছে কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। জাতিসংঘের চলমান ৭২তম অধিবেশনে এসব বিষয়ে বিস্তর আলোচনাক্রমে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও মানুষের অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থার পথ রচিত হবে, এটি শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা। নির্যাতনকারীদের যথাযথ বিচারের পথটিও একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে, এটিও কাম্য।
একাত্তরে প্রায় কোটি খানেক মানুষ- আবালবৃদ্ধবনিতা জীবন বাঁচিয়েছিল ভারতে গিয়ে। ভাগ্য ভালো, বছরখানেকের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছিল। আবার সাহস নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিল। সেবার দিল্লি সব প্রকার সহায়তা দিয়েছিল। এবার? এবার অবস্থা একটু ভিম্ন। দিল্লি অনেকটাই দোটানায়। একদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। দু’জনই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কর্ণধার। দিল্লি কোন নেত্রীকে কতটুকু সহায়তা দেবে তা এখনও ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ মিয়ানমারকে খোলাখুলি জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা না হলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে যাবে ঢাকা। এর শেষ দেখে ছাড়বে। চীনের সঙ্গে ডোকলাম সমস্যা শেষ হলে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে চীনে গমন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখান থেকে তিনি যান মিয়ানমারে। সেখানে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্পর্কিত অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এমনকি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগসূত্র বাড়ছে তাও বলেন। তিনি দেশে ফিরে ভারতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রুখতে বিভিম্ন প্রদেশকে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি বিজেপিশাসিত প্রদেশগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। আরও লক্ষণীয়, জম্মু-কাশ্মীরে থাকা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও ভারতের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়েছে। দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিজেদের অবস্থান জানালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে জানান, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনসমষ্টির আলাদা পরিচয় মানতে রাজি নয়। তাদের মতে, রোহিঙ্গারা বাঙালি মুসলিম। এই যুক্তি মেনে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। জাতিসংঘ অবশ্য তা স্বীকার করে না। জাতিসংঘ চায়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারেই স্থায়ীভাবে আশ্রয় দিতে হবে। তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাও মিয়ানমারকে স্বীকার করতে হবে। সু চি ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে (?) ভাষণে যা যা বলেছেন তার সবকিছুতেই পাওয়া গেছে সেনাশাসকের সুর। কী বিস্ট্ময়কর কান্ড যে, সু চি জানেনই না কেন তার দেশ থেকে লাখে লাখে রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছেঙ্ঘ কী বিস্ট্ময়কর তার মন্তব্যঙ্ঘ দোটানায় দীর্ঘদিন থাকলে দিল্লিই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। কেননা বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান মিয়ানমারের অবস্থানের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের মাত্রা, অনেক ভারতীয় নেতাই বলেছেন, অনেক উচ্চ। এই বন্ধুত্বে কোনোরূপ অবিশ্বাসের ছায়াপাত ঘটলে বাংলাদেশের চেয়ে দিল্লি হবে সে জন্য দায়ী।
আগামী দশকে বা তার পরে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা যখন আরও তীব্র হয়ে উঠবে, যখন চীন-ভারতের সম্পর্ক আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে উঠবে, তখন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তখন বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে বিদ্যমান বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে অন্তত শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যারা ছোট্ট বাংলাদেশের যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, তারাই বাংলাদেশের বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির বক্তব্য, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিবাচক বক্তব্য তারই নমুনা। জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযানের প্রেক্ষাপটে অং সান সু চির প্রতি যে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাও এর নির্দেশক। মিয়ানমার সেনাপ্রধানের হুঙ্কারের অর্থই হলো, মিয়ানমার আবারও সামরিক শাসনের নিগড়ে বন্দি হতে পারে। কফি আনানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে আলোচনা হবে এবং সেই আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হলে সুচতুর চীন আর যাই হোক, ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ওই দায়িত্ব পালন করতে পারে। অগ্রসরমান বাংলাদেশকে লাখ দশেক রোহিঙ্গার ভার বহনে কোনো অগ্রগামী চিন্তার রাষ্ট্র বাধ্য করতে চাইবে না। তাই বলি, অং সান সু চির মতো সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল নেতার কথায় সায় দেওয়া কোনোক্রমেই যথার্থ নয়।
গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের গুরুত্বের একালে প্রাচীন আরাকান সাম্রাজ্যের জনগণকে ‘সন্ত্রাসী বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ এক ধরনের অজ্ঞতা মাত্র। সু চির সেদিনের বক্তব্যে দায় এড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট। তবে তিনি যে সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন এর বাস্তবায়ন তার পক্ষে কতটাই-বা সম্ভব- এই প্রশ্নও থেকে যায়। সু চির বক্তব্যে অনেক মিথ্যা তথ্য আছে এবং সত্য লুকানোর অপচেষ্টা রয়েছে। সবচেয়ে বিস্ট্ময়কর হলো, মিয়ানমারের যে জেনারেলরা তাকে দুই দশকের বেশিরভাগ সময় বন্দি করে রেখেছিলেন, আজ তিনি তাদের সুরে কথা বলছেনঙ্ঘ কত দিন সু চি চোখ বুজে থাকবেন? নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশিক্ষিত করলে সমগ্র দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আবারও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হবে। বিপম্ন মানবতা আবারও সৃজনশীল মানবতায় রূপান্তরিত হবে। নরেন্দ্র মোদির কর্মসূচি তেমনি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এখন রাশিয়া, চীন ও ভারত যে দোটানার মধ্যে রয়েছে এবং সুস্পষ্ট বিষয়কে যেভাবে ঘোলাটে করা হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিকতার আলো-আঁধারি পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমার মস্ত বড় ফ্যাক্টর হিসেবে তাদের চোখে পড়ছে। কিন্তু এই আলো-আঁধারি আবছায়া কেটে গেলে একই ভূরাজনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব নতুনভাবে অনুভূত হবে। সেদিনও খুব বেশি দূরে নেই। ভারত ও চীনের, বিশেষ করে ভারতের আজকের দোটানা মনোভাব তখন আর থাকবে না।
রোহিঙ্গারা চরম অমানবিকতার শিকার। মিয়ানমারে মানবতা ভয়াবহভাবে বিপম্ন। এমতাবস্থায়ও শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি বালিতে যেন মুখ গুঁজে আছেন। রোহিঙ্গারা কোন প্রেক্ষাপটে সু চির ওপর আস্থা রাখবেন, দাঁড়াতে পারে এই প্রশ্নও। গণতন্ত্রের নামে যে সেনাতন্ত্র মিয়ানমারে জেঁকে বসে আছে এমতাবস্থায় তাদেরকে গণতন্ত্রের তকমা কী দেওয়া যেতে পারে? মিয়ানমারে চলছে গণহত্যা। রোহিঙ্গারা কতখানি বিপজ্জনক, ভারত কখনও কখনও তাও প্রমাণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও চীন মানবতা রক্ষায় শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান মানবতার পক্ষে সুদৃঢ় করবে, এটিই প্রত্যাশা।
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন