গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন জরুরি
15 September 2017, Friday
গণতন্ত্র শুধু শাসন পদ্ধতি নয়, গণতন্ত্র সামাজিক নর্ম এবং রীতিনীতিও। গণতন্ত্র এক ধরনের সমষ্টিগত সংস্কৃতিও। কোনো জনপদে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, এ জন্য প্রয়োজন রাজনীতিকদের চিন্তন-মননে গভীর পরিবর্তন। প্রয়োজন সামাজিকব্যবস্থার সঠিক বিন্যাস। প্রয়োজন সামাজিক কার্যক্রমে নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনমানসিকতা। ডায়ান রেভিচের কথায়, ‘গণতন্ত্র একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি মাত্র নয়। গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য অনেকাংশে নির্ভর করে গণতান্ত্রিক পৌর সংস্কৃতির বিকাশের ওপর।’
(Democracy is more than the sum of the institutions. A healthy democracy depends in large part on the development of a democratic civic culture.) সংস্কৃতিচেতনা প্রাণবন্ত না হলে গণতন্ত্র লাভ করে না তার কাক্সিক্ষত উচ্চতা। সংস্কৃতিবোধ জীবন্ত না হলে প্রবেশ করে না সমাজজীবনের গভীরে। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে তাদের নিজস্ব কর্মধারায় প্রতিফলিত হয় না। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমগ্রের হয়ে ওঠে এক পরিচয়, গণতন্ত্রও তেমনি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রূপান্তরিত হয় সামষ্টিক কর্মপ্রবাহে। সংস্কৃতি দেয় পরিশীলিত এক দৃষ্টিভঙ্গি। গণতন্ত্র আনে সমাজজীবনে সৃজনশীলতার এক দুর্বার প্রাণবন্যা। দুই-ই চলে পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে। একটি পিছিয়ে পড়লে অন্যটি হাত বাড়ায় সহায়তার। হাত ধরে টেনে তোলে। পরস্পর পরস্পরের আলোয় পথ চলে। দৈহিক বলের পরিবর্তে যুক্তি যখন কার্যকর হয় তখনই দেখা দেয় সংস্কৃতিচেতনা। পেশির পরিবর্তে মন যখন হয়েছে চালিকাশক্তি তখনই সংস্কৃতির সূচনা হয়। দৈহিক বল আক্রমণ করে, অপরকে দূরে সরিয়ে রাখে। মন কিন্তু কাছে টানে। অপরকে আকর্ষণ করে। অপরের কাছে ছুটে যায়। এভাবে সংস্কৃতিবোধের নব-নব পর্যায়ে মানবের সংঘবদ্ধ জীবনের সূত্রপাত হয়। গড়ে ওঠে পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, সংঘ এবং একপর্যায়ে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্ম ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তারও পরে। সংস্কৃতি তখন উঠে এসেছে পরিণত পর্যায়ে।
সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্র দুয়েরই শুরু ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর ও সুরুচিসম্পন্ন করেই সংস্কৃতি হয়েছে অর্থপূর্ণ। ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে সংকীর্ণতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে সবার সঙ্গে চলার এবং বলার উপযোগী করে সংস্কৃতিই ব্যক্তির সামনে সম্ভাবনাময় উন্নত সামাজিক জীবনের সিংহদ্বার উন্মুক্ত করেছে। তেমনি গণতন্ত্রও ব্যক্তিকে তার অহংবোধের সংকীর্ণ গুহা থেকে টেনে এনে মিলিয়েছে সমাজের বিস্তীর্ণ উদার উপত্যকায়। তাই দেখা যায়, উন্নত সংস্কৃতির ঘাটেই ভিড়েছে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার পণ্যবাহী গণতন্ত্রের সোনার তরী। যে সমাজে সংস্কৃতির মান এখনো উন্নত হয়নি সেখানে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ এখনো রয়েছে বন্ধুর। এখনো ভীষণ পিচ্ছিল।
বাংলাদেশের সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মান অনেক অবনত। পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জমাটবাঁধা পাথরের মতো আগলে রেখেছে সমষ্টিগত জীবনের মহামিলনের উৎসবকে। ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থের অন্ধকারে নিমজ্জিত সামগ্রিক স্বার্থের চেতনা। পেশির সর্বগ্রাসী দাপটে নিস্তেজ হয়ে রয়েছে অন্তঃকরণের কল্যাণময়ী প্রত্যয়। আবেগের প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে যুক্তিবাদিতার গণমুখী ভাবনা, সৃজনশীলতার সার্বিক কলাকৌশল। সবকিছু ভাঙার প্রবণতা নিঃশেষ করেছে গড়ার প্রতিভাকে। ‘আমার’ সুকৌশলী চিন্তাসূত্র প্রতিনিয়ত ছিন্ন করেছে ‘আমাদের’ ব্যাপকভিত্তিক কল্যাণবোধকে। এ অবস্থা আর যাই হোক স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়।
গণতন্ত্রের জন্য তাই ভাঙতে হবে সংকীর্ণতার দেয়াল। আত্মস্বার্থকে প্রক্ষিপ্ত করতে হবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। গড়ে তুলতে হবে আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে সামগ্রিক স্বার্থের উচ্চতর সৌধ। পথ কিন্তু অত্যন্ত বন্ধুর। সুশিক্ষা হয়তো এ পথের দিশারি হতে পারে, তাও কিন্তু এ সমাজে স্বল্পসংখ্যক জনসমষ্টির আয়ত্তে। সুশিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সমাজের বৃহত্তর অংশ। টমাস জেফারসন লিখেছেন, ‘কোনো জাতি অজ্ঞতা দূর না করে মুক্ত হতে চাইলে চূড়ান্ত পর্যায়ে হতাশ হতে বাধ্য। সভ্যতার বৃহত্তর অঙ্গনে তা কখনো ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না।’ [If a nation expects to be ignorant and free, in a state of civilization it expects what never was and never will be.]
যে শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশ সমাজে প্রচলিত রয়েছে তাও গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষের জন্য উপযোগী নয়। উপযোগী নয় বিশেষণাত্মক মন রচনার, নয় যুক্তিবাদী, আবেগবর্জিত পরিবেশে ব্যাখ্যাদানের। গণতন্ত্র কিন্তু চর্চার বিষয়। প্রতিনিয়ত পর্যালোচনার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি হয়। অধ্যাপক ফিনের (Finn) কথায়, ‘ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের স্পৃহা নিয়েই মানুষ জন্মলাভ করে, কিন্তু যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা দীর্ঘকালীন পরিসরে ব্যক্তি ও তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে তার জ্ঞান নিয়ে মানুষ জন্মে না। মানুষকে তা অর্জন করতে হয়। তাকে শিখতে হয়।’ [People are born with an appetite for personal freedom but they are not born with knowledge about the social and political arrangement that make freedom possible overtime for themselves and their children. Such things must be achieved. They must be learned.]
শুধু সাধারণ শিক্ষা নয়, নিজেদের প্রবণতা ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার শিক্ষারও প্রয়োজন। হাজারো স্ববিরোধিতায় ভরা মানুষের মন। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যকে সে যেটুকু ভালোবাসে, ঠিক ততটুকু আগ্রহী সামাজিক সাম্যের জন্য। স্বাধীনতা উপভোগ করতে যতটুকু আগ্রহী, দায়িত্ব পালনে ঠিক তেমনি অনীহা। একদিকে সে চায় নিরাপত্তা, অন্যদিকে অন্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে সে উদাসীন। তাই দেখা যায়, সমাজজীবনের প্রতি ঘাটে জমেছে সংঘাত আর দ্বন্দ্ব। এ দুয়ের সমন্বয় সাধন করতেই হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে সামাজিক দ্বন্দ্বকে রাখতে হবে সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে। বিভিন্ন সামাজিক শক্তিগুলো (Social Forces) যদি দাবি উপস্থাপন ও দাবি আদায়ের মাধ্যম মনে করে তা হলে অভ্যন্তর থেকেই গণতান্ত্রিক সমাজ ধসে পড়বে। অন্যদিকে সমাজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার যদি গণকণ্ঠ রুদ্ধ করে অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে তা হলেও গণতন্ত্র ভেঙে পড়বে বাইরের চাপে। গণতান্ত্রিক সমাজ এমন যান্ত্রিক নয় যে, একবার নীতি এবং প্রক্রিয়া রচিত হয়ে গেলে আপনা-আপনি চলতে থাকবে। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রাণবন্ত থাকে যদি নাগরিকরা আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস করে দ্বন্দ্ব যেমন অপরিহার্য, দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ধৈর্য এবং সহনশীলতাও তেমনি অপরিহার্য। ব্যক্তি এবং ব্যক্তি সমন্বয়ে সংঘটিত বিভিন্ন গ্রুপকে স্মরণ রাখতে হবে, অন্যের অধিকার এবং বক্তব্যও যথার্থ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এ ধরনের সহনশীলতা এবং উদার মনোভাবের সৃষ্টি করে। তাই বলা হয়, গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের বিশিষ্ট অর্জন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি কিন্তু এ পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এ দেশে গণতন্ত্র সবাইকে দিয়েছে দাবি উত্থাপনের অধিকার এবং সরকারকে দিয়েছে যা খুশি করার অধিকার। এ দেশে গণতন্ত্র শুধু আত্মস্বার্থের প্রতীক। সমষ্টিগত স্বার্থ আমাদের গণতন্ত্রে কোনো স্থান পায়নি। সবাই নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা অবলোকন করে। অন্যের বক্তব্য যে যথার্থ হতে পারে তা কেউ ভাবে না। এমনি পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে এ দেশে। চলতে গিয়ে তাই হোঁচট খাচ্ছে বারবার।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের শাসন নয়। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রাধান্যই বড় কথা। আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্পন্ন হয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক, সংসদে। প্রণীত আইন মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো আইন মন্দ হলেও তা মেনে চলতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা পরিবর্তন না হচ্ছে। অন্য কথায়, আইন হলো সমাজে সবকিছুর নিয়ামক। সমাজে সব শ্রেণি এবং গ্রুপের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আইন। পুরস্কার বা বঞ্চনা, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি, লাভ বা লোকসানÑ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক আইন। গণতন্ত্রে ব্যক্তি, তা তিনি যত উঁচু পদে থাকুন না কেন, কাউকে কিছু দিতেও পারেন না বা কারো কোনো ক্ষতি করতেও পারেন না। মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন হলো আইনের শাসন।
এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন