বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা
22 August 2017, Tuesday
বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা ও মাত্রা নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতির ওপর। বাংলাদেশে আজ যে ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালু রয়েছে এই পরিপ্রেক্ষিতে তা অর্থহীন, নিরর্থক। যে মানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আজ দেশে বিদ্যমান তা অপ্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অতীতমুখী। একুশ শতকের দাবি কিন্তু ভিন্ন। অতীতকে শুধু স্মরণ রাখাই যথেষ্ট। বর্তমানই হলো আসল। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত হয়নি। ইরাজিম কোহাক বলেছেন, ‘যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে, সৈন্যাধ্যক্ষরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারই প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং রাজনীতিবিদরাও আরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত প্রজন্মের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেসব সমস্যা পূর্ব দিগন্তে সবেমাত্র উঁকি দিতে শুরু করেছে, সে সম্পর্কে তারা মোটেই সজাগ নন। ওইসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। তারা অতীতে বসবাস করতে ভালোবাসেন এবং অতীতের ইস্যু নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করতে অভ্যন্ত। তারা বর্তমানকে কাটাছেঁড়া করেন। অতীতকে বুকে চেপে বেঁচে থাকতে চান। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্নে তারা কদাচিৎ উদ্বেল হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেহারা এমনি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে আঁকড়ে ধরে এ দেশের নেতা-নেত্রীরা অগ্রসর হতে শেখেননি। এমনকি কার্যকারণের বিন্যাসে পর্যন্ত অবহেলা আর ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে থাকেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’র নামে উচ্চকণ্ঠ হয়েও বিনিয়োগ বৃদ্ধির যেসব মৌলিক শর্ত রয়েছে তার প্রতি উদাসীন। দেশি বিনিয়োগকারীদের যথাযথ উৎসাহদানে তারা কুণ্ঠিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে তেমন আগ্রহী নন। উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিনির্মাণে ভীষণ অনীহা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণে দেখা যায়, হয় উত্তাপের অভাব, না হয় উদ্যোগের কমতি। সমাজে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বনাগরিকতার যে চেতনা, তার দিকে কোনো খেয়াল নেই।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকটা অক্ষম ও অযোগ্য সন্তানরা যেমন সব সময় পৈতৃক সম্পত্তির দিকে নজর রেখে হালকা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চলে ও অতীতের সম্পত্তিতে ভাগ বসিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, ঠিক তেমনি জাতীয় পর্যায়ে অতীত অর্জনকে নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদে প্রবৃত্ত হতে ভালোবাসে। নিজেরা বড় কিছু অর্জনে হয় অক্ষম, না হয় আগ্রহহীন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা ভাগাভাগি করে উপভোগ করতে চান। স্বাধীনতার তিন দশক পরও ‘স্বাধীনতার পক্ষ’ ও ‘বিপক্ষ শক্তি’র সেøাগান তুলে জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে তারা তৎপর। ভবিষ্যতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের ফসল যথার্থরূপে তুলে দেওয়া যায়Ñ এসব বিষয়ে সবাই হয় অসচেতন, না হয় অজ্ঞ। এ অবস্থা লক্ষ করে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন, ‘যারা আমাদের ১৯৭১ সালের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন তারা এরই মধ্যে ভীষণভাবে সামঞ্জস্যহীন হয়ে উঠেছেন, যেমন ১৯৭১ সালে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়েছিলেন যারা আমাদের ১৯৪৭ সালের জন্য তৈরি করেছিলেন, বরং তার চেয়েও বেশি।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিন্তু এখনো ১৯৭১ সালেই আটকে রয়েছে। সরকারি তথ্যমাধ্যমগুলোর দিকে দৃষ্টি দিন, বিশেষ করে টেলিভিশনের দিকে, বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্য আরেকটি কারণেও বর্তমানের জন্য, বিশেষ করে ভবিষ্যতের জন্য পুরোপুরি অনুপযোগী। একুশ শতকে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন সব ‘অপ্রীতিকর’ সিদ্ধান্তের ওপর, যার সঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর বিশ্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এমন পরিবেশে কাজ করেছে, যেখানে শত্রুর ওপর বিজয় অর্জনই ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। একুশ শতকে রাজনৈতিক নেতাদের এমন পরিবেশে কাজ করতে হবে, যেখানে বন্ধুত্ব স্থাপনই হয়ে উঠবে প্রধান গন্তব্য। রক্তসিক্ত প্রান্তরে শত্রু নিধনের পরিবর্তে তাদের শস্য-শ্যামল মাঠে নতুন নতুন বন্ধু সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। ফলে কোনো কোনো সমাজে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ সমাজে দেখা দেবে এক ধরনের ‘প্রশিক্ষিত অযোগ্যতা’। শুধু সৃষ্টিশীল, অগ্রগামী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব হবে সেই প্রশিক্ষিত অযোগ্যতার কবল থেকে মুক্তি লাভ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে তেমন নেতৃত্বের গুণাবলির অপ্রতুলতা অত্যন্ত প্রকট। সোভিয়েত ইউনিয়ন খ--ছিন্ন হয়ে পড়লেও বিশ্বময় সমাজতন্ত্রের পতনের পর যেমন ‘কমিউনিজমবিরোধী’ সেøাগানের আবেদন অর্থহীন হয়ে পড়ে, অনেকটা সেই কিংবদন্তি বংশীবাদকের বাঁশির সুর যেমন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে ইঁদুরগুলো নদীতে ডুবে যাওয়ার পর, তেমনি একুশ শতকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এখনো বিশ শতকের উপযোগী গুণাবলিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির বিতর্কের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। উন্নততর আদর্শের হাতছানিতে তারা উদাসীন।
বিশ্বব্যাংকের ধারণায়, ২০২০ সালে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স ও তাইওয়ান। এই ১০টির সাতটিই এশিয়ায়। সাতটিই বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক দিক থেকেও গতিশীল। সাতটিই রয়েছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে। কোনো রাষ্ট্র একবার অর্থনৈতিক পেশি অর্জন করলে তার পক্ষে সামরিক শক্তি অর্জন অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনুমান করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না, একুশ শতকে এই ১০টি রাষ্ট্র বিশ্বের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এমনকি সামরিক কর্মকা-ের নাটকে নাম ভূমিকায় থাকবে। রঙ্গমঞ্চ হবে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, বিশ শতকে যেমনটি ছিল ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকায়।
দীর্ঘদিন পর সাধারণ অবস্থান থেকে একুশ শতকের মহাসমারোহে যোগ দেওয়ার পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এসেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘সংযোগ পয়েন্ট’ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থানের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ভারত-চীন-থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়ার সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সৃজনশীল কূটনীতির মাধ্যমে শুধু নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবে না, অন্যান্য বৃহৎ শক্তির গতিবিধিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন