সংকট নিরসনের পথ
03 August 2017, Thursday
বর্তমানে সমাজজীবনের যেদিকে তাকানো যায়, দেখা মেলে শুধু দুর্নীতি, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা আর সংঘাত। ন্যায়বোধ আজ সমাজ থেকে নির্বাসিত। সুনীতি এক কেতাবি বচন। সুরুচি সেই অতীতের সনাতন গুণপনা। যুক্তি আজ অসহায়। বিবেক-বিচার অপাঙ্ক্তেয়। সমবেদনা নিশ্চিহ্নপ্রায়। প্রীতির অনুভূতি ভীতির রাজ্যের বাসিন্দা। সৎচিন্তা মৃতপ্রায়। এমনি পরিবেশে সমাজজীবন আজ কিষ্ট, পীড়িত, কান্ত। সামাজিক মূল্যবোধের অবয়ের কোন স্তরে আমরা পৌঁছে গেছিÑ তা বর্তমান সমাজের চিত্র দেখেই বোঝা যায়। গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানারকম অপরাধের চিত্র চোখে পড়ে।
আমাদের রাজনীতিকদের উচিত রাষ্ট্রের সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে সদাজাগ্রত রাখা। প্রতিটি অঙ্গকে সম করা এবং সজ্ঞাত রাখা। সমগ্র জনসমষ্টিকে জাতীয় স্বার্থসংরণের ল্েয তৈরি করা, বিশেষ করে দেশপ্রেমের অমৃতরসে সিক্ত করে তাদের মনকে যে কোনো আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা। তাও যদি যথেষ্ট মনে না হয়, তাহলে ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের চাপে জর্জরিত হয়ে সুইজারল্যান্ড যে প্রক্রিয়ায় স্থায়ীভাবে নিরপে (ঘবঁঃৎধষরুবফ) হয়ে উঠেছে বিকল্প হিসেবে তাও চিন্তা করা। সব পদপে কিন্তু গ্রহণ করতে হবে জনসমষ্টির সম্মতি নিয়েই। বাংলাদেশের আকার-আয়তন ক্ষুদ্র বটে। কিন্তু ১৫ কোটি জনসমষ্টির এই দেশটি কোনোক্রমে ক্ষুদ্র নয়। নিজেদের সৌকর্যের মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলে তার প্রকাশ ঘটাতে হবে।
যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে এখনো জনগণের আকাক্সক্ষায়, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়াই তো নির্বাচিত সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ। এ দেশের জনগণকে যদি তারা সত্যি সত্যিই মতার মালিক মনে করেন, তবে এর কি কোনো বিকল্প আছে? গণতন্ত্র বা স্বশাসন কিন্তু সুশাসন ছাড়া কখনো বাস্তবায়িত হয় না। তা ছাড়া গণতন্ত্র শুধু সুনির্দিষ্ট সময়কালের ব্যাপার নয়, ভবিষ্যতেও যেন তা জনগণের জন্য অর্থপূর্ণ হয়ে অব্যাহত থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। আমার ধারণা, আমাদের রাজনীতিকরা দ এবং অভিজ্ঞ। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিার মধ্য দিয়ে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, তার যোগ্য সন্তান তারা। বাংলাদেশে কিন্তু আজ সংঘাত, হিংসা-প্রতিহিংসা বন্ধ হচ্ছে না। ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে বাসের অযোগ্য এক জনপদ। শান্তিপূর্ণ জীবনের অযোগ্য। এ জন্য দায়ী আমরাই। এটা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্দৈব। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখেই বলব। এ জনপদকে আবারও আমরা পরিণত করতে পারি স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য এবং শান্তি ও সুখের স্বপ্নরাজ্যে। এ জন্য প্রয়োজন শুধু রাজনীতিকদের কল্যাণকামী মন। হিংসা-প্রতিহিংসা-জেদশূন্য আকাশের মতো উদার মন।
০২.
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের শাসন নয়। এ েেত্র আইনের প্রাধান্যই মূল কথা। আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্পন্ন হয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক, সংসদে। প্রণীত আইন মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো আইন মন্দ হলেও তা মেনে চলতে হবে যতণ পর্যন্ত তা পরিবর্তিত না হচ্ছে।
অন্য কথায়, আইন সমাজে সবকিছুর নিয়ামক। সমাজে সব শ্রেণি ও গ্রুপের স্বার্থ সংরণ করে আইন। পুরস্কার বা বঞ্চনা, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি, লাভ বা লোকসান সবকিছুর নিয়ন্ত্রক আইন। ব্যক্তি, তা তিনি যত উঁচু পদে থাকুন না কেন, কাউকে কিছু দিতে অম বা কারো কোনো তিসাধনেও অম। মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন হলো আইনের শাসন। এ ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি বিক্ষুব্ধ হলে আইনের আশ্রয় লাভ করে তিনি তার প্রতিবিধান করতে পারেন। কোনো প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলে তিনি আইনের সাহায্য লাভ করতে পারেন।
বাংলাদেশের শাসনকারী এলিটরা রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে কোনোদিন ন্যাসি কর্তৃত্বরূপে (ঞৎঁংঃ) গ্রহণ করেনি। তাদের কাছে রাজনৈতিক মতা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধার উৎসস্বরূপ। প্রভাব-প্রতিপত্তি-বৈভব অর্জনের ল্েয রাজনৈতিক মতার ব্যবহার এবং অধিকাংশ েেত্র অপব্যবহার সর্বজনবিদিত। মতায় একবার এলে নেতৃবৃন্দ কোনো সময় তা হাতছাড়া করতে চাননি। বাংলাদেশের ভাগ্য এদিক থেকে অত্যন্ত প্রসন্ন। আবুল কাসেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের মতো বহু ণজন্মা মহান নেতা এ মাটির সন্তান। ত্যাগ-তিতিা, নৈপুণ্য-দতার যে কোনো মানদ-ে তাদের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু যারা মতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন তারা রাজনৈতিক মতাকে কোনো সময় ন্যাসি মতা হিসেবে দেখেননি। ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েও তারা বিকল্প নীতি ও কর্মসূচির অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের দিকে তাকাননি।
গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক নেতারা এবং শাসনকারী এলিটরা কোনো সময় সবজান্তার ভূমিকা পালন করেন না। তারা সব সময় নিজেদের এবং দলের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকেন। শ্রদ্ধাশীল হন বিকল্প নীতি ও কর্মসূচির প্রতি। যখন তারা নিজেদের ব্যর্থতা সুস্পষ্টরূপে অনুভব করেন অথবা সংবাদপত্র এবং বিরোধী দলের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠান যখন সে ব্যর্থতা তুলে ধরে, তখন বিকল্প নীতি ও কর্মসূচিকে সুযোগদানের ল্েয স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। বিকল্প নেতৃত্বের জন্য স্বেচ্ছায় সুযোগ সৃষ্টি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণস্বরূপ। বিকল্প নেতৃত্বকে সুযোগ দানের জন্য বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রী বা সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি।
তা ছাড়া বাংলাদেশে খুব কম রাজনৈতিক নেতাকে বিরোধী দলের প্রতি, বিরোধী দলের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে দেখা গেছে। সরকারের বিরোধিতা অধিকাংশ েেত্র রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমনকি বিরোধীদলীয় নেতাদের দেশপ্রেমের প্রতিও সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশি রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, এখানে বিরোধিতা সহ্য করা হয় না। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে অত্যাচারিত হয়েও যিনি মতায় এসেছেন তিনিও বিরোধিতা সহ্য করেননি। সংবাদপত্রের ভূমিকা এ দেশে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেননা সংবাদপত্রকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। ছোটখাটো অভিযোগে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। জনমতের অন্য মাধ্যমগুলোও ষড়যন্ত্রমূলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে মতাসীন দল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সরকারে অধিষ্ঠিত দল সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধী দলের ভাব
মূর্তি ক্ষুণœ করতে উদ্যত হয়। নিজেদের মূল্যবান সময় এবং সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়োজিত হয় বিরোধী দলের অতীতকে কালিমালিপ্ত করতে। তাদের বর্তমানকে বিশৃঙ্খলার আবরণে আচ্ছাদিত করতে। শুধু তাই নয়, সরকার তখন সরকারি ব্যয় ও শ্রমে নিজেদের কার্যক্রমকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ করার জন্য সরকারি অর্থ ও প্রয়াসের অপব্যয়ে লিপ্ত হয়। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সরকারি প্রচারমাধ্যমকে দলীয় মাধ্যমে রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রে সমস্যার সমাধান হয় যুক্তিবাদী আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে, উন্নত বিতর্ক বা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে। মূল কথা সংকট নিরসন। এতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তবেই টিকে থাকবে গণতন্ত্র, নিস্তার পাবে জনগণ। এ জনপদ আবারও পরিণত হোক স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য এবং শান্তি ও সুখের স্বপ্নরাজ্যে।
এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন