গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাণবন্ত হলে
11 July 2017, Tuesday
জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সংগঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত রাখতে এবং রাজনৈতিক সমাজে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সন্তোষজনক সমাধান আনতেই জন্ম হয়েছে রাজনীতির। অনৈক্যের মধ্যেই রাজনীতির জন্ম। অনৈক্যের মধ্যেই তা বেড়ে ওঠে। কিন্তু রাজনীতি যেহেতু সামাজিক সমস্যা সমাধানমুখী যৌথ কর্ম, তাই এর অস্তিত্ব এবং সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো অনৈক্যের সীমিত মাত্রা। ব্যক্তি, সমষ্টি বা দলের মধ্যে অনৈক্য দেখা না দিলে যেমন রাজনীতির জন্ম হতো না, ঠিক তেমনি ব্যক্তি, সমষ্টি বা দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য যদি অনতিক্রম হয়ে ওঠে তাহলেও রাজনীতি টিকে থাকে না। তখন সমাজে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ‘মাৎস্যন্যায়।’ তখন শক্তিশালী ও হিংস্র বোয়াল ও হাঙ্গররা ছোটদের গ্রাস করে ফেলে। এজন্য সুস্থ রাজনীতিতে বিদ্যমান থাকে প্রথমত, অনৈক্যের মধ্যেও কোনো কোনো বিষয়ে ঐকমত্য যেন ভিন্নমতের ঝড়ো হাওয়ায় জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বস্ত না হয়। দ্বিতীয়ত, সুস্থ রাজনীতি ক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকে তীব্র প্রতিযোগিতা, কিন্তু থাকে না বৈরিতা। বরং সুস্থ রাজনীতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো রাজনীতিকদের মধ্যে সমঝোতার এক সুদৃঢ় বন্ধন, পারস্পরিক সহিষ্ণুতার এক সুখদ আবহ, এক সঙ্গে মিলেমিশে জাতীয় স্বার্থকে সংরক্ষণের এক দৃঢ় সংকল্প।
এক্ষেত্রে রাজনীতিকদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মবিশ্বাস মণিকাঞ্চন স্বরূপ। জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ ক্ষেত্রে আপসহীনতা এ কারণে রাজনীতিকদের এক অমূল্য গুণ। তৃতীয়ত, যেহেতু রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো সামাজিক জীবনের সমস্যা সমাধান এবং সমস্যার সমাধান আনয়ন ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের পরিবর্তে আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার প্রাধান্য, তাই রাজনীতিকদের কর্মপদ্ধতি এমনভাবে রচিত হয় যেখানে পারস্পরিক আলোচনার পরিধি হয় অতি বিস্তৃত। চতুর্থত, সুস্থ রাজনীতি সব সময় অতীতকে ছাড়িয়ে বর্তমানকেন্দ্রিক এবং ভবিষ্যৎমুখী। অতীতে পা রেখে সফল রাজনীতিকগণ বর্তমানকে সাজিয়ে থাকেন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হন।
এ যুগে সুস্থ রাজনীতির আদল নির্ধারিত হয়েছে সমাজের বৃহত্তর জনসমষ্টির সম্মতির ভিত্তিতে, গণতন্ত্রের মৌলিক বিধি-বিধানের কাঠামোয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া এ কারণে এত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। নির্বাচিত হলেই কিন্তু সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনীতিকে গণতন্ত্রের মহাসড়কে টেনে আনে। সরকারকে গণতন্ত্রের অবয়ব দান করে মাত্র। জার্মানিতে হিটলারের সরকারও নির্বাচিত সরকার ছিল। এ দেশেও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। নির্বাচিত সরকার তখনই গণতন্ত্রের পথে এক পা দু’ পা করে অগ্রসর হয় যখন তাদের উদ্যোগ প্রবাহিত হয় রাজনৈতিক সমাজে আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ব্যক্তির প্রাধান্যকে ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্যকে তুলে ধরার আগ্রহে, নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নের আগ্রহে, নির্ধারিত নীতিগুলো বাস্তবায়নকালে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে, বিশেষ করে সব প্রকার অনুরাগ বা বিরাগ পরিত্যাগ করে জনস্বার্থকে তাদের কর্মের মূল্যায়নের প্রধানতম মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করার অভিপ্রায়ে। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির মৌল অঙ্গীকার হলো রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক জনগণ, রাজনীতিকরা নন এবং রাজনীতিকদের গতিপথের নির্ধারক কোনো নেতার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা নয়, বরং দেশের আইন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি কার্যত বন্দি হয় সংসদে। সংসদ ছেড়ে রাজপথের তপ্ত অঙ্গনে রাজনীতি একবার প্রবেশ করলে তাকে আর সংসদমুখো করা সম্ভব হয় না। এর অনেক কারণ রয়েছে। (ক) দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে দুটি বৃহৎ দল। নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেন শুধু জেতার জন্য। হারতে তারা শিখেনি। (খ) বিভিন্ন চাপের মুখে সংসদে গেলেও জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং কারণে-অকারণে সংসদ ত্যাগের মহড়া দিয়ে থাকেন। (গ) জাতীয় সংসদে স্পিকারের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উপস্থাপন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্পিকারের দলপ্রীতি। (ঘ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সংসদের বাইরে গ্রহণের উদ্যোগ।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ কার্যকর হতে পারে যদি দেশের নির্বাচিত সদস্যগণের মধ্যে ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার শুভ সূচনা হয়। নির্বাচনে আসে গণরায়। এই গণরায়কে অলঙ্ঘনীয় বলে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা বাংলদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করুক-তাই জনগণের প্রত্যাশা। বাংলাদেশে নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করা অপরিহার্য। এমনিতেই ক্ষমতাসীন দলের একটা ঝোঁক হলো মস্তবড় মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা। এই প্রবণতা সরিয়ে রেখে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ নেতাদের সমন্বয়ে একটা ছোট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলে তেমন ক্ষতি হয় না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী কর্তৃত্বের বিন্যাস করতে পারেন সহজে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হতে পারেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। প্রধানমন্ত্রী সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সমন্বয়কারী হলে বিশেষ করে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ স্বচ্ছ হলে নির্বাহী কর্তৃত্ব অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় যেভাবে একটি সুপার সচিবালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া যেভাবে অনেক ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে তা থেকে জাতি মুক্তি লাভ করতে পারে।
অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেভাবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য রচিত হয়, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে তা অপরিহার্য। জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিকদের মধ্যে সুষম সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে তা কার্যকর হতে পারে। আগেই বলেছি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলসমূহের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে প্রধানত জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বডিজগুলোতে দলীয় প্রার্থী নিয়োগের ফলে। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ দান করা হয় রাষ্ট্রপতির নামে, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক। যেহেতু এসব নিয়োগ দান করা হয় রাষ্ট্রপতির নামে তাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বা কমিশনের সুপারিশে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়া হলে দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক মানসিকতা অনেকটা দূর হবে, কেননা সংসদীয় কমিটিগুলোতে সব দলের সদস্যরা থাকবেন আনুপাতিক হারে। দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হতে হবে যাতে বিচার বিভাগের যে কোনো সিদ্ধান্ত কর্তৃত্বব্যঞ্জক হয়ে ওঠে এবং বিনা দ্বিধায় দেশের সব মানুষ তা যে কোনো পেশার হোন না কেন তা মেনে চলতে পারেন।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারগুলোর যথাযথ কার্যক্রম নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। এজন্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ একদিকে যেমন স্বল্পতম হওয়া বাঞ্ছনীয়, অন্যদিকে তেমনি উৎসাহ দান, যথাযথ মজুরি প্রধান, বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বাপেক্ষা বেশি জনসমূহের অংশগ্রহণ নিশ্চিকরণও অত্যন্ত জরুরি। গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের নাটকে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনেকটা নায়কের ভূমিকা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল সংগঠিত হলে কেন্দ্রে যেমন গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটবে তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে ইউনিয়ন ও উপজেলায়, গণতন্ত্রের দলগুলো ক্রমে ক্রমে বিকশিত হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের আত্মনির্ভরশীল এবং তীব্র আত্মমর্যাদাবোধে উদ্দীপ্ত হতে হবে যেন জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজেদের ওপর ভরসা করেই মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ। এর ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে এ দেশেরই সন্তান রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা, সচেতনতা এবং দূরদৃষ্টির ওপর। গণতান্ত্রিক রাজনীতি এরই প্রকৃষ্ট মাধ্যম। রাজনীতি যদি প্রাণবন্ত হয়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মতো অভিশাপ থেকে জাতি মুক্ত হবে, কেননা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কালো টাকা বা পেশিশক্তি কোনো ব্যাধি নয়। এগুলো অসুস্থ রাজনীতির মতো মারাত্মক ব্যাধির উপসর্গ মাত্র। দেশে আইনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে, প্রণীত নীতি স্বচ্ছ হলে এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে দুর্নীতিরও অবসান ঘটবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
উৎসঃ মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন