চলমান রাজনীতি :ভিশন ২০৩০
16 May 2017, Tuesday
বিশ্বময় সংসদীয় রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে এটি নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয় যে, সুনীতি, সু-সরকার এবং সুশাসনই হলো উন্নত ধরনের রাজনীতির মণিমুক্তা। এই সম্পদ আমাদের লাভ করতে হবে আজ হোক কাল হোক। বেগম খালেদা জিয়া ১০ মে’র উপস্থাপনায় এই সত্যই প্রকাশিত হলো। যাদের অভ্যাস সমালোচনা করা তারা সমালোচনা করুক, কিন্তু দেশের বৃহত্ বোদ্ধা-নাগরিক এর সুবিচারে কার্পণ্য করবেন না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে প্রস্তুতি শুরু করেছে বেশ ক’দিন আগেই। ১৭ এপ্রিলে ধানমন্ডিতে নির্বাচনী কার্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে শোনা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই নির্বাচনের কথা বলছেন, বিশেষ করে সভা-সমাবেশে নৌকার প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্যে জনগণকে বলা শুরু করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে, বেগম খালেদা জিয়ার ২৫৬ দফার ঘোষণাপত্রটি অনেকের নিকট অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শুভ পদক্ষেপ হিসেবে গৃহীত হচ্ছে, যদিও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা বিএনপির ভিশন-২০৩০-এর সমালোচনায় মুখর। এই সমালোচনা ‘ভিশন-২০৩০’-কে কিন্তু আরো জনপ্রিয় করে তুলছে। গত বছর মার্চে বিএনপির দলীয় সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া ২০৩০ রূপকল্পে যা উপস্থাপিত হয়েছে তার কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন “থ্রিজি বা তিন ‘সু’—সুনীতি, সুসরকার এবং সুশাসন [Good Policy, Good Govement and Good Goveance] সম্পর্কে। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকবে অথচ থাকবে না সুশাসন, সুনীতি বা সুসরকার—তা হয় না। নীতিগতভাবেই তা হয় না। ব্রিটেনের খ্যাতনামা কবি জন কিটস (John Keats) তার On Seeing The Elgin Marbles কবিতায় লিখেছেন :
আর চোখের জল ফেলো না
ওগো চোখের জল আর ফেলো না
নতুন বছরে ফুল ফুটবেই।
কেঁদো না আর—ওগো আর কেঁদো না
শিকড়ের শ্বেত মূলে নতুন কুঁড়ি পল্লবিত হবার অপেক্ষায় বয়েছে।
(Shed no Tear Ño shed no tear!
The flower with blom another year.
Weep no more-o weep no more!
Young buds sleep in the root’s white care.)
বিএনপি ক্ষমতাসীন হলে, বেগম খালেদা জিয়ার অঙ্গীকার:
বাংলাদেশের শাসন-প্রশাসনে যেটির অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় তা হলো—সুশাসন। সুশাসনকে কার্যকর করতে হলে সুশাসনের উপস্থিতি অপরিহার্য এবং সুশাসন প্রাণবন্ত হয় স্বশাসনের তীর ঘেঁষেই, সুনীতির শুভ স্পর্শে। হিংসার নোংরা পরশে এবং প্রতিহিংসার দাপটে ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা রাজনৈতিক সমাজ থেকে নির্বাসিত হয়। আইনের শাসন তথা বিবেকের অনুশাসন সমাজ থেকে দূরে সরে যায়। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতি তথা শাসন-প্রশাসনের চত্বরে এই তিন ‘সু’কে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এ জন্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা গভীর হতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে তিনি বিরোধী দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনীতির নতুন ধারা চালু করতে চান। জাতীয় কোনো সমস্যা জটিল হয়ে উঠলে গণপ্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক-মোক্তার যে জনগণ—তাদের মতামত গ্রহণ করে তার সমাধান আনয়ন করা হবে। স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার ছাড়াও বিরোধীদল বা দলগুলোর আস্থা বা দায় সৃষ্টির জন্যে তাদের মধ্য থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি তিনি দেন।
এসব কিছুর ক্ষেত্র তৈরির জন্য, তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা দিলেন যে, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার (top priority) দেওয়া হবে যেন সুশিক্ষার মাধ্যমে শাসন-প্রশাসনের বিচ্যুতি বিদূরিত হতে পারে। এ জন্য তিনি ঘোষণা দেন মোট GDP-এর শতকরা ৫ ভাগ ব্যয়িত হবে সুশিক্ষার জন্য, যেন সমাজ কালক্রমে হয়ে ওঠে ‘জ্ঞানভিত্তিক’। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে, আগামী দশকেই দেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর হবে যাতে দক্ষ এবং সক্ষম জনগণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে সমাজ। সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ একদিকে যেমন দক্ষতা এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকবেন, অন্যদিকে তেমনি নিজের দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান এবং নিজে প্রজ্ঞা ও বিবেকের নিকট পরিচ্ছন্ন থাকবেন। ফলে জাতি লাভ করবে জনসেবায় নিবেদিত একরাশ মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বিশ্বময় এই সত্য স্বীকৃত যে, একটি রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় সেই রাষ্ট্রের বিচার-বিভাগ কতটুকু স্বাধীন এবং কতটুকু জনগণের আস্থাভাজন। দেশের সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে উচ্চতর আদালতের বিচারক নিয়োগ এবং তাদের পদোন্নতি নির্ধারণ। যোগ্য এবং মেধাবী বিচারক সমন্বয়ে সংগঠিত সুপ্রীম কোর্ট সংগঠন এবং স্বাধীন সুপ্রীম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে দেশের নিম্ন পর্যায়ের আদালতসমূহের কার্যক্রম পরিচালনা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য। বিচার বিভাগের সকল স্তরে দক্ষতা এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ব্যবস্থা প্রচলিত হতে হবে। দলীয় আনুগত্য এক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য।
দেশের সংবিধানের এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ বা পদোন্নতির সকল ব্যবস্থা রহিত করে শুধু মেধা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের সকল দরজা উন্মুক্ত করতে হবে। ফলে জাতি পাবে মেধাবীদের সেবা এবং মেধাবীরা লাভ করবে যোগ্যতার পুরস্কার। এই লক্ষ্যে যথাযোগ্য সংস্কারসাধন অপরিহার্য। শুধু কাঠামোগত সংস্কার এজন্য যথেষ্ট নয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নৈতিক মূল্যবোধ ব্যাপক পরিবর্তনও প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রম এবং ক্ষমতা সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যও অর্থপূর্ণ। নিজে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি নিজেই অনুভব করেছেন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।
রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমে পরিবর্তন এনে এবং প্রধানমন্ত্রীর অনেকটা সীমাহীন ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতার সুষম বিন্যাস সাধন করে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং বিশ্বময় সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। মোটকথা, রাজনীতিকে জনকল্যাণের উপযোগী করে, হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে এবং আইনের শাসনকে শাসন-প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বিনির্মাণ করে অগ্রসর হলে এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব। আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য রচনা করা সম্ভব। বেগম খালেদা জিয়ার এই সাহসী বক্তব্য জাতিকে ভাবিয়ে তুলুক—এই কামনা করি।
বেগম খালেদা জিয়ার এই উপস্থাপনা বিতর্কের ঝড় তুলতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে শীতল বারি-বর্ষণের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিতর্কের উত্তাপ যেমন আশঙ্কা করা যায়, তা থেকে আলোকপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও তেমনি আশা করা যায়। জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় কক্ষ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বেগম খালেদা জিয়া নিজেই বলেছেন, সুতরাং এ-বিষয়ে কোনো কথা নেই। তবে যেসব বিষয় তিনি উল্লেখ করেছেন সেজন্য আরো একটু বেশি সময় হলে ভালো হয়। তাই ‘ভিশন-২০৩০’-কে ‘ভিশন-২০৫০’ পর্যায়ে টেনে নেওয়াই উত্তম হবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন