বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র
03 May 2017, Wednesday
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থি’তি অত্যন্ত সংকটময়। সব মহলেই একটা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যেন চারদিক থেকে গ্রাস করে ফেলেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের খুব নিকট-সম্পর্ক দেখি না। অতীতেও দেখিনি এবং এখনো দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র যেন একসঙ্গে চলতে পারে না। নিরাপত্তা সংকট তো দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি যদি এভাবে চলতে থাকে, জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের নীতি যদি গ্রহণ করা না হয় এবং ক্ষমতা যদি এই সরকারের হাতে থাকে তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক কাঠামো, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে সংসদীয় গণতন্ত্র যে সমাজব্যবস্থায় প্রবর্তিত আছে, সেই সমাজের কোথাও দেখা যাবে না যে সরকার তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সুনির্দিষ্ট দলের দিকে লেলিয়ে দিয়েছে। দেশের আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব তারা তা তো করছেই না বরং নিজেরাই পরিস্থিতিকে অশান্ত করছে। অপহরণ, ছোট শিশুদের হত্যা, নারী নির্যাতন, হত্যা-খুন কী করছে না তারা! সর্বত্র একটা নৈরাজ্য চলছে। এই নৈরাজ্যকে প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা, যাদের কাজ জনসেবা দেওয়া, তারাও তা করছে না। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে, তারা কিন্তু রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। তাদের এখন প্রধান কাজ হলো বিএনপিকে দমন করা। বিএনপি দলের ব্যক্তিদের নামে মামলা, হয়রানি। শুধু যদি সংখ্যার দিকে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে কী বিপুলসংখ্যক মামলা একেকজনের নামে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে কি দেখা গেছে? পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক সমাজেও এই অবস্থা নেই। বিএনপির মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের দমন-পীড়নের ভীতি বিরাজ করছে। বিএনপিতে কোনো রাজনৈতিক সংকট নেই। সংকট এসব। এটা ক্ষমতাসীন দল ও সরকার কর্তৃক সৃষ্ট সংকট। যেটা করা তাদের কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কেন এই আচরণ করবেন? এমন অবস্থার পরিবর্তন আশা করছে জনগণ। তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। জনগণ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে।
এই মুহূর্তে জাতি আশা করে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রটি শস্য-শ্যামল হয়ে উঠুক। হয়ে উঠুক ফল প্রসবিনী। আক্রোশ, প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার উদ্যত ফণা অবনত হোক। সহনশীলতা, সহযোগিতা ও রুচিশীলতার সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত হোক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্রটুকু। গণতন্ত্রের প্রত্যাশিত সাফল্য জনগণের জীবনকে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান করে তুলুক।
আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি হলো জনকল্যাণকর এক জাতীয় উদ্যোগ। সৃজনশীল এক কর্মপ্রবাহ। তাই রাজনৈতিক কর্মকা- বর্তমানকে ঘিরে রচনা করে তার পরিধি। ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অগ্রগতির মহাসড়ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি কিন্তু জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার পরিবর্তে রূপান্তরিত হয়েছে হিংসা-প্রতিহিংসার এক উত্তপ্ত শক্তিশালী মাধ্যমে।
গণতান্ত্রিক সমাজে সব দলের মধ্যে রাজনীতি ঐক্যের সেতুবন্ধ রচনা করে। অনৈক্যের মধ্যেও ঐক্যের সুরব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে রাজনীতি কিন্তু হয়ে উঠেছে বিভেদ, বিভাজন ও অনৈক্যের অন্ধ গলি। ফলে সমাজ হয়েছে বিভক্ত। কোনো আদর্শের ভিত্তিতে নয়, নয় কোনো কর্মসূচির ভিত্তিতে। বিভক্ত হয়েছে শুধু ক্ষমতা প্রয়োগকে কেন্দ্র করে। ক্ষমতার কাছাকাছি যারা তারাই যেন সরকারের, রাষ্ট্রের। প্রতিপক্ষ বিরোধী দল বা ভিন্নমতের অনুসারীরা শত্রুশিবিরের। তারা অবাঞ্ছিত। নির্যাতনই তাদের প্রাপ্য। নিপীড়নই তাদের জন্য। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে এসব ক্ষীয়মাণ ধারণার অবসান ঘটবে। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি বিতর্কের অবসান ঘটায়। বাংলাদেশে রাজনীতি কিন্তু সৃষ্টি করে চলেছে নব নব ক্ষেত্রে অসংখ্য বিতর্ক। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের বিতর্ক, এমনকি জাতিসত্তার মৌল বৈশিষ্ট্য এবং ভিত্তি সম্পর্কেও বিতর্ক। এসবই অপেরণ, বিচ্যুতি। জনগণকে আস্থায় নিয়েই সরকার অগ্রসর হয় জটিল জাতীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, সঙ্গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। নীরবে নয়, সরবে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। বাংলাদেশে কিন্তু জনগণ আজ গৌণ। মুখ্য হলো রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জনগণের সার্বিক স্বার্থ আজ উপেক্ষিত, বিপন্ন। দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের দুর্বিনীত প্রক্রিয়া রুচিশীলতার সব স্তর ছাড়িয়ে গেছে।
নতুন আশায় সবাই বুক বাঁধে। বাংলাদেশে আমরাও সেই আশায় বুক বেঁধেছি। গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হোকÑ এমনই আমরা আশা করি। প্রতিহিংসা আর নয়, সহনশীলতাই হোক পথের সঙ্গী। সংগ্রাম-সংঘর্ষ আর নয়, সহযোগিতাই হোক আগামী দিনের সুর। বিভেদ আর নয়, ঐক্যই হোক আগামী দিনের উচ্চারণ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন