নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্তকরণ সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক
13 April 2017, Thursday
কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের জাতীয় সংসদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, কেননা সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের সদস্যগণ নির্বাচিত। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংসদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, কেননা সংসদ যদি সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদবিরোধী আইন প্রণয়ন করেন যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করেছে তা হলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি বা সংস্থাকে উপযুক্ত নির্দেশ বা আদেশ দিতে পারিবেন। অন্য কথায়, জাতীয় সংসদ যেমন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, তেমনি সুপ্রিম কোর্টও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন। কেননা সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণেরও অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৯৬)। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিশ্বে অতীতের মোগল সম্রাটদের মতো অথবা রাশিয়ার জারদের (ঈুধৎ) মতো প্রায় সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, কিন্তু তার সাংবিধানিক ক্ষমতারও সীমারেখা রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৫৭)। সীমারেখা রয়েছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতারও। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। তা হলে বাংলাদেশে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে?
সংবিধানের প্রস্তাবনার দিকে দৃষ্টি দিন, অনুধাবনে কোনো অসুবিধা হবে না গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক কে বা কারা তা জানার। অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে লিখিত রয়েছে : ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া [জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।
অন্য কথায়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের ইচ্ছার পরম অভিব্যক্তিরূপে সংবিধান হলো প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এ ক্ষেত্রে এটিও উল্লেখযোগ্য যে, অন্য কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয় তা হলে সেই আইনের যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততটুকু বাতিল হইবে।
সরকার এই সত্য সম্পর্কে অবহিত থেকেও গত কয়েক বছরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে। এ পদক্ষেপ অগণতান্ত্রিক, অগ্রহণযোগ্য এবং রক্তের আখরে লিখিত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটি উত্তম লক্ষণ এই যে, এর মধ্যে সরকার যে বরখাস্তের আদেশ দিয়েছে, এর অধিকাংশই স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ৪ মেয়র, ৩০ পৌর মেয়র, ৪৬ কাউন্সিলর, ৩৯ উপজেলা চেয়ারম্যান, ৫৬ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৯১ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ৭৪ জন মেম্বারসহ প্রায় ৩০০ জন জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন গত সাড়ে তিন বছরে। তাদের প্রায় সবাই বিরোধী দলের। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক বিধি মোতাবেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের লক্ষ্য কী? শাসন-প্রশাসনের সব স্তর থেকে বিরোধীমতের ব্যক্তিদের, তা তারা নির্বাচিত হোন বা নিয়োজিত হোন, তাদের দূর করে দেওয়া? নিজেদের অনুগতদের দ্বারা ওই সব শূন্যস্থান পূরণ করা? দেশটাকে একদলীয় শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ করা? জানি না এর লক্ষ্য কী। কিন্তু এটি সুস্পষ্ট যে, এর ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে একদলীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন। তা অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ও অগ্রহণযোগ্য।
এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন