আমাদের জাতীয় জীবনে ২৫ মার্চ এক হৃদয়বিদারক দিন। বিশ্বের ইতিহাসে ঘৃণ্যতম হিংস্রতা ও নির্মম পৈশাচিকতার দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্বর এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় মেতে ওঠে। গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে সশস্ত্র অবস্থায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর। শুরু করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তাই বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই রাত্রিটি নিষ্ঠুরতম ভয়াল কালরাত হিসেবে চিহ্নিত। বিগত প্রায় দুই দশকব্যাপী ‘বাংলাদেশ ছাত্র কল্যাণ সংস্থা’ তথা ‘সিফাদ ফাউন্ডেশন’ ও এর বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান- ইউডা (ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ), কোডা (কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ), সোডা (স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ) প্রতি বছর ২৫ মার্চ সূর্যাস্ত থেকে ২৬ মার্চ সূর্যোদয় পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর মানিক মিয়া এভিনিউতে (সংসদ ভবনের সামনের রাস্তাসংলগ্ন খালি জায়গায়) ২৫ মার্চ কালরাত পালন করার পাশাপাশি দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে থাকে, ২৫ মার্চ সূর্যাস্তের সাথে সাথে কালো পতাকা উত্তোলন, ১৯৭১-এর ওই রাতে নিহত এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া প্রার্থনা, স্বাধীনতার আলো প্রজ্বলন ও মৌন মিছিল, ইউডার চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ দেশের সর্বস্তরের চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে রাতব্যাপী গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক পথচিত্র অঙ্কন, দেশবরেণ্য সঙ্গীতশিল্পীদের অংশগ্রহণে গণসঙ্গীত, কবিতাপাঠ ও পথনাটক মঞ্চায়ন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ এবং রাতব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে ২৬ মার্চ ভোরে স্বাধীনতা দিবসের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও কালো পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন। এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হয় শান্তিপূর্ণ, অহিংস এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশে। দলমত নির্বিশেষে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র, টিভি ও নাট্যব্যক্তিত্ব, দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, মন্ত্রী, এমপিসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কর্মসূচিগুলো হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।
বিগত দিনে জাতীয় পর্যায়ের অনেক সুধী, শিল্পী, রাজনীতিক এবং কৃতীব্যক্তিত্ব আমাদের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত, টিভি ও নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, মোস্তফা মনোয়ার, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল র্বাক আলভী, কালিদাস কর্মকার, বীরেন সোম, মনিরুল ইসলাম, রুহুল আমীন কাজল, ফরিদা জামান, কনক চাঁপা, মনিরুজ্জামান, শহীদ কবীর, নাদিম আহমেদ নাদভী, অলকেশ ঘোষ, চন্দ্র শেখর দে, গোলাম ফারুক বেবুল, সিদ্ধার্থ শংকর তালুকদার, নাট্যব্যক্তিত্ব আফজাল হোসেন ও বিপাশা হায়াত, শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্যসচিব ড. সারোয়ার আলী, সাবেক সেনাপ্রধান অব: মেজর জেনারেল হারুন-অর-রশীদ, মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, কর্নেল জাফর ইমাম, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলাম, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এমপি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী প্রমুখ।
গণহত্যার ৪৬ বছর পরে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করেছে। এটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই জন্য সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্মরণ করছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দিনটি যাতে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবেও স্বীকৃতি পায় তার জন্য সরকার জাতিসঙ্ঘ, মানবাধিকারসহ অন্যান্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হবে।
যেহেতু রাত্রিটি শোকাবহ ও বেদনাময়, তাই দিবসটির সম্মান, মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার্থে ২৫ মার্চ সূর্যাস্ত থেকে ২৬ মার্চ সূর্যোদয় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব মহল যাতে সব ধরণের আলোকসজ্জা ও আনন্দমুখর অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে বিরত থাকে সে বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা কামনা করছি।
বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে এই বছরও আমরা (ইইডা, সোডা, কোডা) মানিক মিয়া এভিনিউতে (যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে) ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রত্যাশা রইলো, গণহত্যা ও স্বাধীনতা দিবস স্মরণে ২৫ মার্চ সূর্যাস্ত থেকে ২৬ মার্চ সূর্যোদয় পর্যন্ত মানিক মিয়া এভিনিউতে আমাদের গৃহীত কর্মসূচিগুলোতে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সংসদের সব সদস্য উপস্থিত হয়ে আমাদের সংগঠনের সাথে এবং সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি পালনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ dailynayadiganta.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন