দেশের অর্থনীতি কোন পথে
20 March 2017, Monday
কিছুদিন আগেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকেই ( Economic Groth) বলা হতো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ( Economic development) । ( GNP Gross National Product ) ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং কোনো কোনো সময় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে চিহ্নিত করা হতো। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলেছেন একটি দেশ উন্নত হয় যখন দেশটি তার নিজের উদ্যোগেই এক উন্নত পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘ পর্যন্ত তার দ্বিতীয় উন্নয়ন দশকের ( Second Development Decade) প্রস্তাবে মাথাপিছু আয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন হিসাবে । ঐ সময়ে অর্থনীতিবিদদের ধারনা বা প্রতীতি ছিল `উন্নত জীবনের সূচনা হয় উন্নত পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের বিশ্বে` ( Real life begins at a higher level of per capital income), কেননা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তখন নিচের দিকে চুইয়ে পড়ে ( Filter down) এবং দেশে দরিদ্রদের জীবন মান উন্নত করে ।
অর্থনীতিবিদদের এই ধারনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে । এই ধরনের অর্থনীতির দেশে একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে আয়ের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য দারিদ্র্য অপুষ্টি ব্যাধি অশিক্ষা নিরক্ষরতা অস্বাস্হ্যকর অবস্হানে বসবাস তেমনি বেরেছে বেকারত্ব আধা বেকারত্ব এবং জনগনের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ যা চূড়ান্ত পর্যয়ে রুপ গ্রহন করতে পারে বিস্ফোরণধর্মী রাজনীতিতে ।
অর্থনৈতিকে উন্নয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত দারিদ্র দূরীকরণের মাধ্যমে ঐসব ব্রক্তিদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ ঘটানো,আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে নিজের ভাগ্য রচনায় উদ্যোগী করানো, সন্মানজনক কর্মের জন্যে প্রণাদিতকরণ, বিশেষ সমাজব্যাপী এমন রাজনৈতিক আবহ৯ তৈরী করা যাতে সুষম বন্টন ত্বরান্বিত হতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্র ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। শিক্ষা ,স্বাস্থ ,বাসস্থানের ক্ষেত্রেও সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হতে পারে। এজন্য সকল প্রকার সামন্তবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সমাজে গণতন্ত্রের শিকড়কে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের ( Participatory ) মানসিকতা সুদৃঢ় করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশে এ ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী , কেননা স্বাধীন সাবর্ভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে প্রায় সকল নাগরিকের অংশগ্রহনের মাধ্যমে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে , সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে ছোট-খাটো বৈষম্য বিপ্লবাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কেননা জনগন এসব বিষয়ে ভীষণ সচেতন। তাছাড়া , দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অনুপস্থিতি তথা কার্র্যত একদলীয় শাসন এবং দলীয় নেতাদের উচ্চবাচ্য ও পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে পারে।
২০১৪ সালের ২০ অক্টবরে মন্ত্রীসভায় পেশকৃত বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জনগনের মাথাপিছু আয় ১৪৬ ডলার বৃদ্ধি পেয়ে এ বছরে তা হয়েছে ১১শ ৯০ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমান হয়েছে ২১,৫০৮বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনেকে আমরা আশাও করি , দু’চার বছরের মধ্যে বাঙলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এসবই ভালো কথা । আশার কথা। কিন্তু অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে ভীত হই। দেশে প্রতিবছর যে সম্পদ সৃস্টি হচ্ছে তা কুক্ষিগত হচ্ছে মা্ত্র অল্প সংখ্যক ব্যক্তির হাতে। কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সাময়িকীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের শীর্র্ষ ধনীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে । তাতে দেখা গেছে মাত্র, ১৬ ব্যক্তির মালিকানায় রয়েছে দেশের মোট সম্পদের সাড়ে ১০ শতাংশের অধিক । আবার আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্টে ( Ultra Wealth report) অনুযায়ী মাত্র ৯০ জনের মালিকানায় রয়েছে দেশের ১১ ভাগ সম্পদ। এই ক’জন ব্যক্তির সম্পদ ১৬ কোটি মানুষের মাথায় ফেলে মাথাপিছু আয় হিসাব করা হচ্ছে । করারোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদ বন্টনের চেষ্টা করলেও তা কার্র্যকর হচ্ছে না। কর ফাঁকির মাধ্যমে তা অর্কাযকর থেকেই যাচ্ছে। রাজস্ব বোর্ডের এক হিসেবে দেখা যায় , শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টি রাজস্ব খেলাপী । বিশ্ব আল্ট্রা ওয়েলথ রির্পোট ২০১৩ প্রতিবেদনে বলা হয় ২৫০ কোটি টাকা সম্পদের মালিকদের সংখ্যা ৯৫ । তাদের নিকট গচ্ছিত মোট সম্পদের পরিমান ১ লক্ষ ২০হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ১১শতাংশ। এক বছর পূর্বে এমন ধনীর সংখ্যা ছিল ৮৫ জন। তাদের নিকট গচ্ছিত সম্পদ ছিল ১লক্ষ ৪ হাজা কোটি টাকা। অন্য কথায়, এক বছরের ব্যবধানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার আড়াই গুন।
জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ হলেও কিছু সংখ্যক সম্পদ কুক্ষিগতকারীর প্রবৃদ্ধির ১৫ শতাংশের বেশি । ২০০৯ সালের ২৫০ কোটি টাকার মালিকদের সংখ্যা ছিল ৫০ জনের মতো।
২০১৫ সালের অর্থনৈতিকখাতে আলোচিত ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের কাহিনী । ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান ( Global Financial Integrity (GFI)) জিএফআই ২০১৩-২০১৪) সময়কালে বাংলাদেশ থেকে এক বছরে প্রায ৭৭ হাজার কোটি টাকা পাচারের সংবাদ প্রকাশ করে তার ৮ ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ( Illicit Financial Close fromDeveloping countries)
এর মতে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সমযকালে পাচার হয়েছে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানীর নামে বিপুল অংকের টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পাচটি ব্যাংকের তথ্য দিয়ে দুদককে সহযোগীতা করে বাংলাদেশ ব্যাংক । কিন্তু দু:খের বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশন চুপ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায় , কোন দৃশ্যমান বিনিয়োগ না থাকলেও গত অর্থ বছরের দশ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর আমদানীর জন্য ঋণপত্র খোলার প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ১৫ শাতাংশ যেখানে প্রবৃদ্ধির সাড়ে ৭ শতাংশ। যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেনার পাওয়া গেছে ছাই -ইট বালি -পাথর। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালি কন্টেনারও পাওয়া গেছে। শুধু আমদানীর নামে টাকা পাচার হচ্ছে তাই নয়, রপ্তানীর নামেও টাকা পাচার হচ্ছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ঠ সূত্রের মতে , সমাজের উচু স্তরের ব্যক্তিরা টাকা পাচার করছেন, বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও এনজিও ব্যক্তিত্ব । এই টাকা দিয়ে কানাডা , যুক্তরাষ্ট্র ,বৃটেন মালয়েশিয়ায় ,ভারত, প্রভৃতি দেশে তারা বাড়ি বানিয়েছেন অথবা ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত সম্পদশালীদের ,লুটেরা উল্লেখ করে বলেন এই দুবৃত্তরা কোন সম্পদ সৃস্টি করেনা , বরং অন্যের বিত্ত দখল – হরণ ও আত্মসাত করেন। নিজেরও বিত্তশালী হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় তারা এখন জনসমস্টির উপর তলায় ১( এক) শতাংশ লোক যারা দেশের সিংহভাগ সম্পদের মালিক । অধ্যাপক বারাকাত তার লেঅক বক্তৃতা ২০১৪ তে বলেছেন, বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক কাঠামো বিকাশ প্রবণতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে , গত ২৪ বছরে সার্বিক দারিদ্র -বৈষম্য – অসমতা অবস্থার অধোগতি হয়েছে। ‘
অন্য কথায় মধ্যবিত্ত শ্রেনির ও নিম্ম মধ্যবিত্ত শ্রেনীর দরিদ্র হবার গতিধারা সুস্পষ্ট ।
একদিকে এই গণদারিদ্র এবং ব্যাপক অসমতা আর অন্যদিকে মধ্যবিত্তের অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এবং নগন্য সংখ্যক ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পদ সমগ্র সমাজব্যাপি অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে যা কালে বিস্ফোরণধর্মী রাজনীতির জন্ম দেবে। তাই বলি, এখনো সময় আছে, সম-বন্টন , দারিদ্র দূরিকরণ, বিত্তশালীদের ওপর উচ্চহারে করআরোপের মাধ্যমে দেশে সামগ্রিকভাবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা সৃস্টি হয়েছে তার সমাধান অপরিহার্য । এর কোন বিকল্প নাই।
লেখক : প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ
উৎসঃ deshjanata.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন