চলতে চাই আলোকিত পথে
01 January 2017, Sunday
ব্রিটেনের খ্যাতিমান কবি জন কিটস তার On Seeing the Elgin Marbles কবিতায় লিখেছেন: আর চোখের জল ফেলোনা/ওগো চোখের জল আর ফেলো নয়!/নতুন বছরে ফুল ফুটবেই।/কেঁদো না আর ওগো আর কেঁদো না!/ শিকড়ের শ্বেত মূলে নতুন কুঁড়ি পল্লবিত হবার অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১৬-এর ১ জানুয়ারিতে প্রার্থনা করেছিলাম হে পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা, নতুন বছরটা যেন ভালো যায়। যায়নি। হয়তো সঠিকভাবে দয়াময়ের নিকট প্রার্থনা উচ্চারণে সক্ষম হইনি। হয়তোবা মনের জোর তেমন ছিল না। তাই হয়তো যা চাই অথবা যেভাবে চাই অথবা যেভাবে চাওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। ২০১৬ সালটা তাই এমনভাবে কাটল। আবারো বলছি স্বাগত নতুন বছর দু’ হাজার সতেরো। আবারো বলছি, হে পরম দয়ালু মহান সৃষ্টিকর্তা, তুমি কি পারবে না ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে আমাদের মনটা। অনেক ময়লা-জঞ্জালে ভয়ঙ্কর অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের মন। বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বিস্তর হলাহলের স্পর্শে। হিংসা-প্রতিহিংসার নোংরা পরশে। বিস্ময়কর অসুয়ার প্রভাবে মন এত অপরিচ্ছন্ন হলে পথ চলব কীভাবে? কিন্তু পথ তো আমাদের দীর্ঘ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। দৃষ্টি শক্তি এখনো দুর্বল হয়নি বটে, কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য অনুধাবনের জন্য, সৎ-অসতের ব্যবধান ঘুচাতে, ভালোমন্দের বাছ-বিচারে যে মনটা আমাদের পরিচালক তা হয়ে পড়েছে অসুস্থ, অস্বচ্ছ। হয়ে উঠেছে কালিমালিপ্ত, অহিতপূর্ণ, অকল্যাণকর। তাই তো বলি, নতুন বছরে আমাদের মনকে নির্মল করে দাও প্রভু, যেন স্বাচ্ছন্দ্যে পথ চলতে পারি। যেন পৌঁছুতে পারি অভীষ্ট লক্ষ্যে। যেন স্পর্শ করতে পারি বিজয় স্তম্ভ। জাতীয় ঐক্যের দিকে তাকাতে পারি না। জাতি হিসেবে আমরা এখন ভীষণভাবে বিভক্ত।
উদ্বেগের কথা, এই বিভক্তিরেখা কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। জনপদের প্রত্যেকটি সামাজিক শক্তি আজ খণ্ডবিচ্ছিন্ন, দ্বিধা বিভক্ত। বিভক্ত দেশের শিক্ষক সমাজ। বিভক্ত আমাদের ছাত্রছাত্রীরা, আমাদের তরুণ-তরুণীরা। বিভক্ত দেশের প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, ব্যবহারবিদ প্রমুখ পেশাজীবী। সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু যেসব রাষ্ট্রীয় কৃত্যক নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে, ঝড়-ঝাপটা এড়িয়ে প্রশাসনকে কর্মচঞ্চল রাখে তারাও এখন বিভক্ত। ভীষণভাবে বিভক্ত দেশের বুদ্ধিজীবীরা। এই বিভক্তি নিরসনে ব্যর্থ হলে এক কথা, কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, এই বিভক্তি বেড়েই চলেছে। আমাদের নেই কি! সব আছে আমাদের। আছে আমাদের উর্বরতম মাটি। আলগোছে ছোট্ট একটা চারা পুঁতলে কিছুদিনের মধ্যে তা বেড়ে ওঠে লকলক করে। ছুঁতে চায় আকাশ। পরিণত হয় অনতিবিলম্বে এক বিরাট মহীরুহে। মাটির নিচে যে সম্পদ রয়েছে তাই বা কম কিসে? মাটির বুক চিরে প্রবাহিত নদ-নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়। একটু যতœ পেলে রূপান্তরিত হতে পারে এক একটা স্বর্ণখনিতে। মাথার উপরে সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশ তো আমাদের অফুরন্ত সম্পদ। মাটির ওপরে বসবাসকারী আমাদের সন্তানরা মানব উপাদান হিসেবে বিশ্বে অদ্বিতীয়।
আন্তর্জাতিক মহামন্দার কালেও আকাশছোঁয়া স্পর্ধায় সচকিত আমাদের তারুণ্য প্রিয় মাতৃভূমিতে বিদেশে নিজেদের ঘাম ঝরা পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত পারিশ্রমিক দিয়ে অর্থনীতির গতি সচল রেখেছে। চলতে চাই আলোকিত পথেমনটা যদি আমাদের পরিচ্ছন্ন হতো, হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত না হয়ে যদি শির দাঁড়াটা সোজা রাখতে সক্ষম হতাম, নির্ভরশীলতাকে জয় করে যদি আত্মনির্ভরতার পাঠগ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে এরই মধ্যে অগ্রগতির পথে চলতে পারতাম হাজার যোজন পথ। হয়নি তা। নিজেরা নিজেদের শত্রুজ্ঞান করে শক্তি ক্ষয় করছি আত্মঘাতী যুদ্ধে। হিংসা-প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে নিজেদের সৃজনশীলতার বিনাশ ঘটাচ্ছি ষড়যন্ত্রের গ্রন্থি রচনা করতে করতে। যুক্তিবাদের সৌকর্য হারিয়েছি। মন-মানস-মননশীলতার যে দৈন্য তা তুলনাহীন। মনে কদর্য হিংসা-প্রতিহিংসার আধিক্য আমাদের প্রত্যেককে যেন এক একটা সুন্দ বা উপসুন্দে রূপান্তরিত করেছে। গতিবিধি এবং চালচলনে আমরা হয়ে পড়েছি এক একটা দনুজ। পারলে প্রতিপক্ষকে গিলে খাই। প্রকাশভঙ্গিতে একদিকে যেমন নির্মম, অন্যদিকে তেমনি অনুচ্চারণীয়, অশ্লীল, অপরিশীলিত। অধিকাংশ সময় দুর্গন্ধময়, অমার্জিত, অলম্বুস। যা বিদ্যমান তা ভাঙতে পারঙ্গম। নতুন সৃষ্টিতে অক্ষম। এই তো আমরা। এর বেশি কী? হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত। আশা নেই। সুন্দর ভাষা নেই। ক্ষমতার দাপটে চারদিককে জীর্ণ ও বিশীর্ণ করে তুলেছি। বিভক্ত করে ফেলেছি সমগ্র সমাজকে। ঐক্যবোধের মহান চেতনাকে দলিত-মথিত করেছি।
তাই দু’ হাজার সতেরো (২০১৭) এইদিনে বলি, মহাকালের এই ক্ষণে এই জনপদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো আলো। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রজ্ঞার আলো, বাচালতার ঘন অন্ধকার নয়। এই সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো সমাজব্যাপী সহজ-সরল জীবনের পরশমণির আলো, বিভাজন সৃষ্টিকারী বিদ্যুতের চমক নয়। প্রয়োজন হলো কল্যাণকামী মনের প্রভা। অপরিচ্ছন্ন মানসিকতার কালবৈশাখী নয়। এই জাতির স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন আত্মনির্ভরশীলতা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাধার বিন্ধ্যাচল উল্লঙ্ঘনের দিক-নির্দেশনার আলো। জন কিটসের মতো অত জোরেশোরে বলতে পারছি না যে, নতুন বছরে ফুল ফুটবেই। তারপরেও আশা করব, সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত দুর্দৈব নিঃশেষ হবে। জীবন জীবন্ত হয়ে উঠবে নতুন বছরে। যা বলতে চাই তা বলতে পারব। কারো রক্তচক্ষু আমাদের অধিকার আর কেড়ে নেবে না। আইন আমাদের পথ চলাকে সহজ-সরল করে তুলবে। যে হাজারো অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আমরা চলছি তা আলোকিত হবে। নতুন বছরের শুরুতে সৃষ্টিকর্তার নিকট তাই আমাদের আকুতি। তিনি আমাদের আলোর পথে পরিচালিত করুন।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাবেক
উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
manobkantha.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন