এক.
করোনাভাইরাস নিয়ে যত আলোচনা দেখছি তার প্রায় সবই এই সংক্রামক ব্যাধি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বা নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিখুঁত করবার সঙ্গে যুক্ত। সংক্ষেপে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নীতিগত মূল্যায়ন, কারিগরি বা চিকিৎসাশাস্ত্রীয় সামর্থ্য বিচার এবং এপিডিওমেলজি- অর্থাৎ কোথায় কয়জন আক্রান্ত হোল, কয়জন মরল এবং কয়জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা বা পর্যালোচনা। বাড়তি ভূ-রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল চীন কিভাবে কঠোরভাবে তার নাগরিকদের কার্যত ‘শহরবন্দী’ করেছে যা তথাকথিত পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব হোত না। রাষ্ট্র ও প্রশাসন শুধু ‘শহরবন্দী’ করে ক্ষান্ত থাকে নি, নিরাপত্তার নামে নানা প্রকার নজরদারি, চলাচল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা এবং স্বেচ্ছায় কিম্বা জবরদস্তি কোরান্টাইন ব্যবস্থা চালু করেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে একদম নিম্ন পর্যায়ের কমিউনিটি কর্মী সকলেরই নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোর করে আরোপ করার পক্ষে একই কথা বারবার বলেছে : এটা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, অতএব অস্বাভাবিক নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ শাসন ও বিধিবিধান আরোপ জরুরি। চীনা ভাষায় এটা feichang shiqi বা বিপজ্জনক মূহূর্ত (দেখুন, (Quo, 2020)।
নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের ভালো দিক এবং মন্দ দিক নিয়ে বেশ গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণও দুই-একটি হয়েছে। তবে সব আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ভয়ানক আতঙ্ক ছড়ানো। সার কথা হচ্ছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ একটি ভয়ঙ্কর সংক্রামক ও ঘাতক ভাইরাস। ফুসফুসের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে কিংবা নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় বাধা ঘটিয়ে এই নতুন ধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে।
কারা মরবে বেশি? বিশেষত যারা বুকের কিম্বা ফুসফুসের রোগে ভুগছেন, বয়স ৫৫ পেরিয়ে গিয়েছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিম্বা কোনো বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই একে ‘বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগ’ (Pandemic) হিশাবে ঘোষণা দিয়েছে। বলছে, এর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ এখনও সম্ভব। কিন্তু কোত্থেকে কিভাবে এই নতুন ধরনের ভাইরাস (নোভেল) এলো বা তৈরি হোল এবং কিভাবে হঠাৎ ছড়িয়ে গেল, সে সম্পর্কে কমবেশী প্রায় সকলেই নীরব। চতুর্দিকে সাজ সাজ রব। কোত্থেকে এলো, কিভাবে হোল, কারা ঘটাল, বিজ্ঞান ও কৃৎ কৌশল, বিশেষভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভূমিকা এখানে কী ছিল ইত্যাদি কোনো বিষয়েই সঠিক তথ্য পাওয়া ভয়ানক কঠিন হয়ে গিয়েছে। জরুরি ও সঠিক তথ্যের কোনো হদিস নাই, কিন্তু ভাইরাস ব্যবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক কাঠামো এবং আইন ও বিধিবিধানের ক্ষেত্রে মারাত্মক গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। অর্থাৎ ‘বৈশ্বিক মারী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ এখন আন্তর্জাতিক রোগ ব্যবস্থাপনা নীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে চলেছে। অর্থাৎ অস্বাভাবিক রোগতাত্ত্বিক বা মহামারীর আতঙ্ক সৃষ্টি করে শক্তিশালী দেশগুলো একটি নজরদারি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছে যার দ্বারা তারা আমাদের আচরণ, চলা ফেরা- বিশেষত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া ইত্যাদি সবকিছু ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’র নামে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আশ্চর্যজনকভাবে এই ভাইরাস ১৫-১৬ বছরের কম বয়েসী শিশুদের হামলা করছে না। শিশুবান্ধব ভাইরাস! বলা যায় এটা ‘বুড়াদের রোগ’। বুড়া বা সিনিয়র সিটিজনদের এখানে ভাবনার বিষয় আছে। বৃদ্ধ ও অথর্ব, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব অর্থনীতিতে যারা আর কোনো অবদান রাখতে পারছেন না, অর্থনীতির বোঝা হয়ে আছেন, তাদেরকে এই প্রথম কোভিড-১৯ জাতীয় ভাইরাস আক্রমণ করছে এবং অনেককে মেরে ফেলছে। যদি আপনি বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আর কোনো উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনে অবদান রাখতে না পারেন, তাহলে আপনার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার এবং ভবলীলা সাঙ্গ করবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আপনি পুঁজির দুনিয়ায় বোঝা হয়ে গিয়েছেন। সেটা করোনাভাইরাসও বুঝে গিয়েছে!
দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক মারী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এখন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বিষয়। কোভিড-১৯ মানুষের ওপর বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের এবং কঠোর নিরাপত্তামূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার (security State) ধারণা বাস্তবায়নের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করেছে। চিন যেভাবে উহানের অধিবাসীদের ‘শহরবন্দী’ ও গৃহে অন্তরীণ করেছে তা থেকে আমরা আগামী দিনে আমাদের মতো দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে তার ছবি দেখতে পারব। তাই আতঙ্ক উৎপাদন করে এবং সাজসাজ রব তুলে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে যে বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে সেটাই মূলত আমাদের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হওয়া উচিত। সেই আলোচনা আমরা কোথাও দেখছি না। বিস্ময়কর হোল, উহানে চিনের ল্যাবরেটরি থেকে এই নতুন ধরনের ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিম্বা অন্য কোনো পরাশক্তি এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করছে না। যেন পুরা ঘটনাটাই যৌথ সম্মতিতে ঘটেছে এবং সারা বিশ্বের মানুষের চলা ফেরা, সমাবেশ এবং একত্রিত হবার স্বাভাবিক মানবিক স্বভাব দমন এবং নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। আমরা সকলে স্বেচ্ছায় এই পরীক্ষার গিনিপিগ হয়েছি।
যে আলোচনা খানিক উঠেও বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেটা হোল, জীবাণু মারণাস্ত্র সংক্রান্ত আলোচনা। যুদ্ধে জীবাণুর ব্যবহার নতুন নয়। যদি যুদ্ধাস্ত্র হিশাবে ‘নোভেল’ বা নতুন যুদ্ধগুণসম্পন্ন করোনাভাইরাস তৈরি করা চীনের উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে উহানে কিসের গবেষণা হচ্ছিল? কিম্বা কিসের গবেষয়ান হয়? করোনাভাইরাসে এই নতুন স্ট্রেইন বা নতুন জাত তৈরি হোল কীভাবে? আমরা জানতাম যে, করোনাভাইরাস জীব বা জন্তুর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই থাকে এবং অনেক সময় তা মানুষকেও আক্রমণ করে। প্রাকৃতিকভাবেই বাদুড় করোনাভাইরাসের ‘হোস্ট’ বা জীবাবাস। আমাদের আলেম ওলেমা মুফতি বা ইউটিউবে যারা ওয়াজ করে বিনোদন দিয়ে থাকেন, তাঁরা না জানলেও আমরা জানতাম করোনাভাইরাস মধ্য প্রাচ্যে উট থেকে মানুষকেও আক্রমণ করেছিল। আমাদের নবী-রসুলদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাস আরবদের মাফ করে নি। আরেক প্রকার করোনাভাইরাস আছে যার প্রাকৃতিক আবাস হচ্ছে খাটাশ বা গন্ধগোকুল। এর নাম Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus-1 (SARS-CoV-1)। পরিচিত ও প্রচলিত করোনাভাইরাসের চেয়ে ভিন্ন হবার কারণে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ২০১৯ সালে দৃশ্যমান এই নতুন ভাইরাসের নাম Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus-2 (SARS-CoV-2) বা সংক্ষেপে COVID।
কারা তৈরি করল এই নতুন করোনা ভাইরাস যখনই এই প্রশ্ন উঠানোর চেষ্টা হোল তখন বলা হোল, না না, এটা ছিল স্রেফ গবেষণা, কোনো যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা উদ্দেশ্য ছিল না। মনে রাখতে হবে, একদা এই বিশ্বে মনুষ্য প্রজাতির একমাত্র যুদ্ধাস্ত্র ছিল দুই হাত, পাথর, লাঠি এবং ধাতুর আবিষ্কারের পরে তলোয়ার। পরবর্তীতে যুদ্ধাস্ত্র হিশাবে ঘোড়া কিংবা হাতির ব্যবহার যুদ্ধের জয়পরাজয় নতুনভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অর্থাৎ যুদ্ধে জীবের ব্যবহার নতুন কিছু না। এরপর বারুদ বন্দুক কামান জাহাজ বোমারু বিমান ড্রোনসহ হাজার প্রকার যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার হোল, আমরা পারমাণবিক বোমার যুগে প্রবেশ করলাম। পাশাপাশি জীবাণু মারণাস্ত্রের ব্যবহারও হতে থাকল। জীবাণু মারণাস্ত্র সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নাই তাদের সুবিধার জন্য কয়েকটির নাম উল্লেখ করে রাখছি। পরে আলোচনা করা যাবে : এন্থ্রাক্স, বটুলিনাম টক্সিন, গুটি বসন্ত, কলেরা, টুলামেরিয়া, ইবোলা, প্লেগ, বুনিয়া, আফ্লাটক্সিন, মারবুর্গ ভাইরাস, ইত্যাদি।
আমরা অতএব, প্রথাগত আলোচনার বাইরে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল কিভাবে আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসবার জন্য আধুনিক নিরাপত্তা ও নজরদারিমূলক রাষ্ট্রের জন্ম দিচ্ছে এবং আমরা ক্রমেই স্বাধীনতা হারিয়ে জন্তু জানোয়ারের মতো কোয়ারান্টাইনের অধীন হয়ে পড়েছি, সেই বিষয়ে কয়েকটি সিরিজে আলোচনা করব। এটি নতুন কিছু নয়। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো অনেক আগেই সাবধান করেছেন, আধুনিক রাষ্ট্র যখন আমাদের ‘নিরাপত্তা’র কথা বলে তখনই আমাদের ঘোরতর সন্দেহ করা উচিত। রাজনীতি শাস্ত্রে যেদিন থেকে ‘নিরাপত্তা’ বা সিকিউরিটি’ শব্দটি প্রথমবার দানা বাঁধল বা উৎপত্তি ঘটল, সেদিন থেকেই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়- যেমন, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, মড়ক ইত্যাদি প্রতিরোধ করা নয়, বরং এসব ঘটতে দেওয়া যেন তার নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষগুলোকে স্রেফ একেকটি সজীব মাংসপিণ্ড রূপে গণ্য করে তাদের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করা যায়। বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সে ফিজিওক্রেটদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব বিচার করে ফুকো এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় তা আরো প্রকট ও দৃশ্যমান হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রকে দুনিয়াব্যাপী পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের হাতিয়ারে পরিণত করা। অর্থাৎ নিখুঁত নিরাপত্তা সর্বস্ব রাষ্ট্রে পর্যবসিত করা। এ নিয়ে আমরা আরো বিস্তৃত আলোচনার আশা রাখি।
কোভিড-১৯ জাত মারীর বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ মূলত একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা যেখান থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। কোন দেশের মানুষ কোয়ারান্টাইনে থাকবে, কারা থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত নেবে সেই কেন্দ্র। বর্ডার অতিক্রম করে মানুষের বিভিন্ন দেশে যাবার যে সুযোগটুকু এখনো আছে, তাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের নামে বাতিল করা হবে। যে দেশের নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা দুর্বল সেই দেশকে নিরাপত্তার নামে নিজেদের অবশিষ্ট সার্বভৌমত্ব বৈশ্বিক মুরুব্বি বা কর্তাদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে। এই সকল বিষয়ে কয়েকটি সিরিজে আমরা কথা বলব। করোনাভাইরাস থেকে অবশ্যই বাঁচতে হবে। কিন্তু আমরা যেন স্টুপিড জনগোষ্ঠীতে পরিণত না হই।
[আগামীকাল দ্বিতীয় কিস্তি]
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন