বাজেটের পরিসংখ্যান নিয়ে তর্কাতর্কি পরে করুন। গণিত পরে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেবেন না। সহজ করে ভাবুন, যাতে সাধারণ মানুষ সহজভাবে ট্যাক্স ব্যাপারটা কী এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চাইলেই সে রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য কিনা বুঝতে পারে। রাষ্ট্র আপনার কাছ থেকে খাজনা নিচ্ছে। কেন নিচ্ছে? কারণ রাষ্ট্রের খর্চাখরচ আছে। যেমন- পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী-আমলাদের বেতন, জাতীয় সংসদের সদস্যদের বেতন, রাস্তাঘাট তৈরিতে খরচ, বড় বড় প্রকল্পের জন্য খরচ, ইত্যাদি। তো ঠিক আছে। এটা তো মোগল আমলে রাজরাজড়াও নিত, তাই না? ইংরেজ আমলে নিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারপর নিতেন বিলাতের রানী, সেটা ঔপনিবেশিক শাসন বলবৎ রাখার জন্য। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ নেটিভদের কাছ থেকে খাজনা বা ট্যাক্স নিয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অর্থের জোগানের জন্য ট্যাক্স। আপনার আয় দিয়ে আপনাকে ঔপনিবেশিক শৃংখলে বেঁধে রাখা হতো, বিলাতি শাসন চালানোর অর্থ জোগানো হতো। কী সুন্দর ব্যবস্থা! কিন্তু এখন? মোগলাই কিংবা ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য কী?
আপনার ট্যাক্স নিয়ে একশ্রেণীর বড়লোককে আরও ধনী করা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমনকি পাকিস্তান বা ঔপনিবেশিক আমলেও এটা হয়নি। লর্ড ক্লাইভের আমলে দেশের সামগ্রিক আয়ের অনুপাতে হিসাব করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এভাবে লুণ্ঠন এবং শোষণ করেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যেভাবে অল্প কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তার তুলনা ইতিহাসে আছে কিনা সন্দেহ।
বাংলাদেশ কি তাহলে মোগলদের মনসবদারি? লর্ড ক্লাইভের নতুন কর্পোরেট সাম্রাজ্য? পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির অর্থনৈতিক অসাম্য? আমরা নাকি বাইশ পরিবারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি? এখন কয় পরিবার আমাদের নির্বিঘ্নে লুটতরাজ করছে? আপনি দেখছেন, নিয়মিত লুট হচ্ছে ব্যাংক। এ তো দুই-একটি ব্যাংকের দুর্নীতি না। ব্যাংকব্যবস্থাই এ রাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে যাতে লুটতরাজ সহজ হয়। এমনকি ব্যাংক আইনও বদলানো হচ্ছে। ব্যাংক ডাকাতি কাঠামোগত ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। সেটা এমনই যে, বাংলাদেশ ব্যাংকও লুট হয়েছে। তাহলে ট্যাক্স নিয়ে প্রাথমিক তর্ক হচ্ছে, ঘটনা কী আসলে?
পুরনো সামন্ত বা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কী তফাৎ? এটাই এখনকার প্রশ্ন। সামন্ত বা মোগলাই শাসনব্যবস্থায় রাজামাত্রই বৈধ, তার অস্ত্রের জোরই আপনার কাছ থেকে খাজনা আদায় করার বৈধতা। আপনাকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে বলে আপনি তাকে খাজনা বা ট্যাক্স দিতেন। ঔপনিবেশিক আমলও চরিত্রের দিক থেকে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ঔপনিবেশিক বল প্রয়োগের ক্ষমতাই এ ক্ষেত্রে বৈধতা। ইংরেজ আপনার প্রভু হয়েই এসেছে, তাকে খাজনা দিতে আপনি বাধ্য। তথাকথিত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈধতা তাহলে কী দ্বারা নির্ণয় করা হয়?
ইউরোপে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঠিক এ প্রশ্নটাই সামনে চলে এসেছিল। ট্যাক্স নেয়ার বৈধ অধিকারী কে? রাষ্ট্র? কিন্তু কী ধরনের রাষ্ট্র? এ প্রশ্নটা জারি রাখলে আমরা রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের বৈপ্লবিক পর্বটা বুঝব। সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নতুন গড়ে ওঠা ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণী আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের স্লোগান তুলছে ও কার্যকর করছে সেটা আমরা বুঝব, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার মর্ম আমরা ধরতে পারব। রাষ্ট্রের ন্যূনতম যে চরিত্র না থাকলে আপনি রাষ্ট্রকে খাজনা বা ট্যাক্স দিতে বাধ্য না, অন্তত পক্ষে সেটা বুঝবেন। ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবার খুবই গোড়ার জায়গা সেটা। অর্থাৎ পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ কোন্ অধিকারে জনগণের ওপর ট্যাক্স আরোপ, আদায় ও খরচ করতে পারে? আধুনিক রাষ্ট্র তো রাজতন্ত্র নয় যে, রাজার দৈবশক্তির বলেই রাজা ট্যাক্স বসাতে পারেন। আধুনিক রাষ্ট্র কোন্ অধিকারে পারে? কোথা থেকে জাতীয় সংসদ এ শক্তি পায়? এ শক্তির বৈধতা কী? এটা বোঝা বাংলাদেশে আমাদের জন্য খুবই জরুরি। এটা বুঝতে পারলে আধুনিক গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতাও আমরা বুঝব।
বামপন্থীদের লেখালেখিতে বাংলাভাষায় ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি ধনীদের গালি দেয়ার ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সমাজ ও রাজনীতি বোঝার গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হিসেবে নয়। সে কারণে বামপন্থীরা ‘ধনিক শ্রেণী’ আর ‘বুর্জোয়া’ পালটাপালটি করে ব্যবহার করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। বোঝার উপায় নাই, ধনী মানেই বুর্জোয়া আর বুর্জোয়া মানেই ধনী কিনা। ধনী কথাটা ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান বোঝায়। সে বুর্জোয়া চেতনার ধারক নাকি ধারক নয়, সেটা ব্যক্তির কর্মকাণ্ড দ্বারা বোঝা যায়, তার অর্থনৈতিক অবস্থান দ্বারা না। তবে ধরে নেয়া হয়, ধনী পরিবারের সন্তান ধনী শ্রেণীর চেতনাই সাধারণত ধারণ করে। যে কেউই ধনী কিংবা গরিব হতেই পারে; কিন্তু বুর্জোয়া হওয়া না হওয়া তার নিজের অর্থনৈতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক চেতনাগত ব্যাপার। সামন্তব্যবস্থা ও সামন্ত সংস্কৃতির বিপরীতে ব্যক্তির স্বাধীন কর্তাসত্তা ও অধিকারবোধ ইতিহাসে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে সেটা আমরা ইউরোপে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর ইতিহাস বা সরল ভাষায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাস পাঠ করলে দেখি। সেখানে জন্মসূত্রে সমাজে অভিজাতদের শাসন মেনে নেয়ার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া তার নিজের মর্যাদা ও ব্যক্তি অধিকারের জন্য লড়ে। দাবি তোলে- কার জন্ম কীভাবে হল, কে অভিজাত কে নিন্মবর্গ, কে ধনী কে গরিব সেটা বিবেচনার বিষয় না। মানুষ মাত্রই এক, তাই তারা সমান। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যক্তির ঐতিহাসিক আবির্ভাবকে নিশ্চিত করে।
বুর্জোয়া মতবাদ তাই ব্যক্তিতান্ত্রিক; কিন্তু সাম্যবাদী মতবাদ। ব্যক্তি হিসেবে আমি আর তুমি এক, আমরা সমান, তাই অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা আমরা কে ছোট কে বড় ঠিক হবে না; বরং রাজনৈতিক পরিসর ও রাষ্ট্রে আমাদের অধিকার একই। সমান। সম্পত্তিতে ব্যক্তি অধিকার বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি সে কারণে বুর্জোয়া সমাজ রক্ষা করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেউ ধনী কিংবা গরিব হতে পারে, কিংবা অভিজাত অথবা নিন্মবর্গ, কিংবা বাংলাদেশের কথা ভেবে বলা যায় হতে পারে হিন্দু-মুসলমান-আস্তিক-নাস্তিক ইত্যাদি। কিন্তু সমাজে সবার জন্য সামষ্টিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন, রাষ্ট্র গঠন, শাসনব্যবস্থা নির্ণয়, বিচারব্যবস্থা পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই- আমাদের সবারই একই অধিকার। ব্যক্তিই এখানে সার্বভৌম, কোনো রাজা, কিংবা অভিজাত নন। এমনকি সমাজও নয়। সমাজ চাইলেই ব্যক্তির অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার বলে থাকে।
বুর্জোয়া বা সাম্যবাদী সমাজ আর কমিউনিজম অবশ্য এক কথা নয়। সমাজ বা সমষ্টির অধিকার ছাড়া ব্যক্তির অধিকার কথাটার কোনো অর্থ হয় না। কারণ ব্যক্তি আকাশে বা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একা একা বাস করে না। ব্যক্তির অধিকার অতএব সমষ্টির অধিকারের অধীন। কমিউনিজম গড়তে হলে এমন এক ‘উম্মাহ’ গড়তে হবে, যেখানে ব্যক্তি নিজেই তার সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার দ্বারা উপলব্ধি করে যে, সমাজেই তার মুক্তি, সমাজের মধ্যেই তার বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব। কমিউনিজম এ উপলব্ধির সম্ভাব্য ঐতিহাসিক পরিণতির অধিক কিছু নয়। এ উপলব্ধির রাজনীতি সমাজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের জায়গা ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট করে তোলে। ব্যক্তি-অধিকার হরণ করে যেমন কমিউনিজম গঠন করা যায় না, তেমনি সমাজ, উম্মাহ বা সামষ্টিকতার বিপরীতে ব্যক্তির অধিকারকে সার্বভৌম গণ্য করলে সমাজ টেকে না। আমরা দেখেছি, ডিক্রি জারি করে সমাজতন্ত্র গড়বার পরীক্ষা ইতিহাসে ব্যর্থ হয়েছে; কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই থেমে নাই। কারণ এটাই মানবেতিহাসের শেষ গন্তব্য নয়। ব্যক্তির ‘আধ্যাত্মিক’ অর্থাৎ মানুষের চিত্তবৃত্তি, চিন্তাচেতনা ও প্রজ্ঞার বিকাশ ছাড়া ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব নিরসন করে ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
গণতন্ত্রে ধনী-গরিব, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার একটাই ভোট, এটাও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সার্বজনীন ভোটাধিকার আদায় ইতিহাসে তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজার বিরুদ্ধে ব্যক্তির আবির্ভাব কীভাবে ঘটছিল, কীভাবে সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছিল এবং কীভাবে ব্যক্তি রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আদায় করে নিয়েছিল সেসব বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ইংল্যান্ডে সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে যখন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চলছিল, তখন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান উঠেছিল, সেটা হল ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশন’; যদি আমরা তোমাদের নির্বাচিত না করে থাকি তাহলে আমাদের কাছ থেকে খাজনা বা ট্যাক্স নেয়ার কোনো অধিকার কিংবা বৈধতা তোমার নাই। তুমি নির্বাচিত না হলে তোমাকে খাজনা বা ট্যাক্স দেব না। বাংলাদেশে কিন্তু আমরা এ বাস্তবতার মধ্যেই এখন নিপতিত হয়েছি। যারা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে আসেননি, জনগণের ওপর ট্যাক্স বা খাজনা আরোপ করবার কোনো অধিকার বা বৈধতা তাদের নাই। এটা গণতন্ত্রের একদমই গোড়ার কথা: নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশন। আমরা যদি তোমাদের নির্বাচিত না করে থাকি আমরা তোমাদের ট্যাক্স দিতে বাধ্য নই।
দুটো স্তরে এর মানে আছে। এক হচ্ছে বৈধতার প্রশ্ন, বর্তমান জাতীয় সংসদকে যদি জনগণ নির্বাচিত না করে থাকে তাহলে ক্ষমতাসীনদের আরোপ করা ট্যাক্স জনগণ দিতে বাধ্য না। আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদের ট্যাক্স আরোপ করার বৈধতার এটাই ভিত্তি। দ্বিতীয় মানে হচ্ছে, জনগণের কাছ থেকে নেয়া অর্থ কীভাবে খরচ হয়েছে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান থাকা চাই। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে কার্যত কিছু নাই, অর্থাৎ জাতীয় সংসদে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নাই। রাষ্ট্রের আর কোনো প্রতিষ্ঠান নাই যার দ্বারা ডাকাতি ও লুণ্ঠনের অর্থের জন্য ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আমরা জবাবদিহি চাইতে পারি। তৃতীয় মানে হচ্ছে, ট্যাক্স আরোপ করে রাজস্ব খাতে জমা হওয়া টাকা কীভাবে খরচ করা হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার। সেটাও অনুপস্থিত। অতএব ক্ষমতাসীনরা গায়ের জোরে ডাকাতদের মতো ট্যাক্স নিতে পারে বটে, তবে তা স্রেফ ডাকাতি হবে। এর সঙ্গে গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রের কোনো সম্বন্ধ নাই। রাষ্ট্র অল্পকিছু ব্যক্তি বা পরিবারের লুণ্ঠনের হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে।
ইংরেজদের ১৬৮৯ সালের অধিকারের সনদ (English Bill of Rights 1689)- সংসদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ট্যাক্স আরোপ করা যাবে না, সেই বিধি প্রবর্তন করে। প্রতিনিধিত্ব না থাকলে ট্যাক্স দেব না এ দাবি প্রবলভাবে ওঠে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংল্যান্ড থেকে যাওয়া সেটলারদের। তারা দাবি করল, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমাদের কোনো রিপ্রেজেন্টেশন নাই, কোনো প্রতিনিধিত্ব নাই। তাহলে একজন ইংলিশম্যানের যে অধিকার (Rights of Englishmen), সেটা এই ক্ষেত্রে লংঘিত হচ্ছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দাবি করে তাদের ‘ভার্চুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন’ আছে; কিন্তু সেটলাররা তা মানেনি। যদি পার্লামেন্টে আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকে, তাহলে আমরা ব্রিটেনকে কোনো ট্যাক্স দেব না। মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের স্বাধীনতার বীজ এ প্রতিনিধিত্ব ছাড়া ট্যাক্স নাই দাবির ওপর গড়ে ওঠে।
তাহলে নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দাবি। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে হোক কিংবা হোক জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, প্রতিনিধিত্ব না থাকলে ট্যাক্স দেব না- সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে উত্থাপিত হয়ই। হতে বাধ্য। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণা করে। এতে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর তিনটি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয় : বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সেখানে আন্দোলনের ধারা হিসেবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়। ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার ইতিহাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িত। কারণ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে এ দাবি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মাসাচুসেটস থেকে ১৭৬৪ সালে জেমস অটিস জুনিয়র লিখছেন, ম্যাগনা চার্টারের অধিকার বলে নিজের প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্তে বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে পার্লামেন্টে একজন ব্রিটিশ যে ট্যাক্স দিতে কবুল করে, তার বাইরে অন্য কোন ট্যাক্স দেয়ার দায় থেকে সে মুক্ত। এ অধিকার যদি ম্যাগনা চার্টার অধিকারের অতিরিক্ত না হয়ে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই একজন ব্রিটিশের জন্মগত অধিকার, এই অধিকার ব্রিটিশ কমন ল’য়ের অন্তর্গত। আমি পুরো ইংরেজি উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি।
When the parliament shall think fit to allwo the colonists a representation in the house of commons, the equity of their taxing the colonies, will be as clear as their power is at present of doing it without, if they please...But if it was thought hard that charter privileges should be taken away by act of parliament, is it not much harder to be in part, or in whole, disfranchised of rights, that have been always thought inherent to a British subject, namely, to be free from all taxes, but what he consents to in person, or by his representative? This right, if it could be traced no higher than Magna Charta, is part of the common law, part of a British subjects birthright, and as inherent and perpetual, as the duty of allegiance; both which have been brought to these colonies, and have been hitherto held sacred and inviolable, and I hope and trust ever will. It is humbly conceived, that the British colonists (except only the conquered, if aû) are, by Magna Charta, as well entitled to have a voice in their taxes, as the subjects within the realm. Are we not as really deprived of that right, by the parliament assessing us before we are represented in the house of commons, as if the King should do it by his prerogative? Can it be said with aû colour of truth or justice, that we are represented in parliament? (In 1764, the Massachusetts politician James Otis, Jr.).
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, গণতন্ত্রের কথা বলতে মুখে ফেনা তুলি; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খুবই গোড়ার ব্যাপার, যার ওপর রাষ্ট্র দাঁড়াত, আমরা উপেক্ষা করি। গণতন্ত্রে আপনি যদি পার্লামেন্টে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ভোটের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি না পাঠাতে পারেন, রাষ্ট্র যদি তা নিশ্চিত করতে না পারে, সেই পার্লামেন্টের বাজেট অবৈধ। তার ট্যাক্স বসাবার, আদায় করবার বা খরচ করবার কোনো নৈতিক কিংবা বৈধ অধিকার নাই।
এ কথাটাই আগে বোঝা দরকার।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন