এক জায়গা থেকে সরিয়ে শাড়ি পরা দেবী থেমিসকে আবারও পুনর্স্থাপন করা হয়েছে। হেফাজত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, ‘গ্রিক দেবী থেমিসের এই প্রতীককে চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে।’ কারণ হিসাবে বলেছেন, শাড়ি পরা দেবী থেমিসকে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্থাপন করা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরোধী এই দেবীকে বাংলাদেশের কোথাও স্থান দেয়া যাবে না। ‘গণমানুষের সকল আবেদন নিবেদন এবং শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ আন্দোলন’কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে থেমিসের পুনর্স্থাপন এটাই প্রমাণ করে, ‘এ দেশের মানুষের সম্মিলিত আকাক্সক্ষা’কে সরকার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিচ্ছে না। তার মানে দেবী থেমিস নিয়ে বিতর্ক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বীজ পুরোপুরি রয়ে গেল। যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। সরানোই বা কেন, আবার বসানোই বা কী উদ্দেশ্য?
সাম্প্র্রতিক বিবৃতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী যেটা স্পষ্ট করেছেন সেটা হোল, ‘থেমিস সুপ্রিম কোর্টের সামনে থাকবে, নাকি পিছনে থাকবে, এইটা কোন ইস্যু কখনোই ছিল না। নামাজের সময় কালো কাপড়ে মুড়ে দেয়া হবে কি হবে না; এইটাও ইস্যু ছিল না। ইস্যু ছিল, থেমিস থাকবে কি থাকবে না। এইখানে মধ্যপন্থা নেয়ার কোন সুযোগ নাই’। কিন্তু বাংলাদেশে মতাদর্শিক লড়াইয়ের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন সেটা হচ্ছে, ‘ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারণা একটি মৌলিক ধারণা বা গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা ঘোষণার ঘোষিত লক্ষ্যও। সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোনো প্রতীকায়ন যদি গ্রিক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোনো ধারণা বা অবস্থান ছিল না। এটা ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শ’। তাহলে দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ‘আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইউরোপের ইতিহাসকে বাংলাদেশে আত্তীকরণ করানোর অপচেষ্টা’ রুখে দেয়াই এই ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য। মূর্তি বা ভাস্কর্যের ফারাক নিয়া তুলকালাম ফালতু তর্ক কিম্বা ইসলামে মূর্তি হারাম কি না সেই সকল ক্লিশে তর্ক এখানে মুখ্য বিষয় নয়। হেফাজতে ইসলাম তুলছে না।
আপাতত দেবী মূর্তি পুনর্স্থাপিত হলেও এটা স্পষ্ট যে দেবী থেমিস নিয়ে বিতর্কে হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় ঘটেছে। ফলে আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের জমিন থেকে এর উৎখাত সময়ের ব্যাপার মাত্র। হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক দল নয়। ফলে এই বিজয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কী রূপ নেবে আমরা তা জানি না। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্কে হেফাজতে ইসলাম তাদের নিজেদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আদায় করে নিলো, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। টেলিভিশনে একজন হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধিকে চার-পাঁচজন যেভাবে হামলে পড়ে নাস্তানাবুদ করতে চাইছে, কিন্তু পালটা নিজেরা নিজেদের স্টুপিড প্রমাণ করছে সেটা দেখে সত্যি করুণা হয়। ইসলাম সম্পর্কে গণ্ডমূর্খদের কোনো ধারণা নাই। তা না থাকুক, কিন্তু হেফাজতে ইসলাম কী বলছে তার কিছুই তারা জানে না। হাওয়ায় ছড়ি ঘুরাচ্ছে। ইসলামপন্থীদের তুলনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও ঔপনিবেশিক বদ্ধ চিন্তার পরিণতি সাধারণ মানুষ দেখছে। এ তো হেফাজতে ইসলামের বিজয়।
দেবী থেমিসের মূর্তি বিচার বিভাগ থেকে অপসারণের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ কুতর্কের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারত। বোঝা গেল, দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণের দাবির মুখে বিচার বিভাগ স্রেফ ছলনার আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। এর উদ্দেশ্য কি শুধু হেফাজতে ইসলামের দাবিকে উপেক্ষা করা? সেকুলারদের কিছুটা তুষ্ট রাখা? সব দিক রক্ষা করা? নাকি সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা উসকে দেয়া এবং উত্তপ্ত করে তোলা? কেন? দেবী মূর্তি নামানো সরানোই কি বিচার বিভাগের কাজ?
দেবী থেমিসকে উচ্চ আদালতের যেকোনো প্রাঙ্গণে স্থাপন করে রাখা ক্ষমতাসীনদের অবস্থানকেও চ্যালেঞ্জ করা। অর্থাৎ কেউ চাইছে বিচার বিভাগের ও নির্বাহী বিভাগের বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে আরো বড় করা। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের ঘাড়ে অনেক বড় দায় নিলেন। বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারদের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে তিনি কিভাবে বিচার বিভাগের আসল কাজÑ অর্থাৎ নাগরিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন সেটা একমাত্র তার ভগবানই জানে। দেবী থেমিসকে সরানোতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু তিনি পুরানা অস্বস্তিকে শুধু পুনর্স্থাপনই করেননি, ক্ষতস্থানে মরিচ দেবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর কাজ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, মূর্তি বসানো আর সরানো নয়।
এখন স্পষ্ট হচ্ছে, দেবী থেমিসকে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে বসানোই হয়েছে রাজনৈতিক মন্দ উদ্দেশ্য- অর্থাৎ বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করা ছাড়া বাংলাদেশে দেবী থেমিসকে বিচার বিভাগের সামনে স্থাপন করার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হবে প্রধান বিচারপতির তা না জানার কথা নয়। যেহেতু ইসলামপন্থীরা এটা মেনে নেবে না, তখন পুরানা খেলাটা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ময়দানে মহানন্দে খেলা যাবে। যথা, ইসলাম একটি বর্বরদের ধর্ম; তারা শিল্প-সংস্কৃতি মূর্তি-ভাস্কর্য ইত্যাদির দুশমন, আফগানিস্তানের তালেবানরা হাজার বছরের বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ভেঙেছিল, অতএব যারা বাংলাদেশেকে তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায় তারা মূর্তি ভাঙবার দাবি তুলবে। তখন বলা যাবে বাংলাদেশ তালেবানদের দেশ হয়ে যাচ্ছে, অতএব দিল্লি-ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশ রক্ষা করবার জন্য ছুটে আসতে আহ্বান জানানো যাবে। বাংলাদেশ ইসলামি বর্বরদের হাতে চলে গিয়েছে এখন দেশটিকে আর বাংলাদেশীদের হাতে রেখে দেওয়া যায় না, ইত্যাদি আসবে সামনে।
বাংলাদেশের জনগণকে এতো বোকা ভাবা কি ঠিক? ঠিক না। তারা এইসব বোঝে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মিসরে কী হচ্ছে সেইসব বোঝার ক্ষমতা শহরের মূর্খ সেকুলারদের চেয়ে তারা অনেক বেশি সহজে বোঝে। যদি না বুঝত তাহলে বাংলাদেশ এতদিনে সিরিয়া হয়ে যেত এবং সেটা দ্রুত পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। বিচারপতি সিনহা কি আসলে তাই চান?
দুই
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ চরমভাবে ব্যর্থ। দেশে আইনের শাসন নাই, সেটা প্রধান বিচারপতি নিজেই স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি সংসদে বলেছেন, আমি জানি না আমাদের চিফ জাস্টিস কিভাবে বললেন- আইনের শাসন নাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই! ইত্যাদি। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব চলছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলা সওয়াল জওয়াবের দুই পক্ষের বাদানুবাদে সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রধান বিচারপতিকে মিনতি করে বলি, দেবী থেমিস নিয়ে আপনি কি সমাজে তর্ক তৈরি করবেন? নাকি এই দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন? কোনটা আপনার কাজ?
প্রধান বিচারপতির কথাই আমরা ধরি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিচারিক স্বাধীনতা মানে কোনো ধরনের প্রভাব বা হস্তক্ষেপ ছাড়া বিচারকের ক্ষমতা প্রয়োগ করা’। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার মূল ও ঐতিহ্যগত অর্থ হলো- সরকারের রাজনৈতিক শাখাগুলো থেকে বিশেষত নির্বাহী সরকার থেকে বিচারকদের সামষ্টিক ও স্বতন্ত্র স্বাধীনতা। ব্যক্তিগতভাবে একজন বিচারকের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উপাদানগুলো হোল- ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, পারিপার্শ্বিক স্বাধীনতা এবং অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা। বেশ তো। তাহলে নিজে যা বিশ্বাস করেন তা বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দিন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন। আমরা চাই না নিজের কাজ বাদ দিয়ে উচ্চ আদালত শাড়ি পরা দেবী থেমিসের মূর্তি সংরক্ষকের কাজ করুক। এটা আদালতের কাজ নয়।
হেফাজতে ইসলামের আপত্তি বাদ দিন। ধরুন, বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম নাই। ধরুন এই দেশে ইসলাম বলে কিছু নাই (নাউজুবিল্লাহ!), আছে শুধু শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য (এখন অট্টহাসি দিতে পারেন)। তাহলে শিল্পকলার সর্দাররা কী বলছে দেখুন। তারা বলছে, ‘শিল্পের বিচারে শুধু এটাই নয়, (অর্থাৎ দেবী থেমিসের মূর্তি শুধু নয়) ঢাকা শহরের ৯০ ভাগ ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া উচিত। এত নিম্নমানের, লজ্জাজনক, কী বলব। আমি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম ঢাকা শহরের অধিকাংশ সড়কদ্বীপ, রাস্তার ওপরে, রাস্তার মধ্যে, যেসব ভাস্কর্য আছে, অধিকাংশের দিকে তাকানো যায় না, নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ’। এটা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন, নিসার হোসেন।
তাহলে মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আপনি শিল্পকলা বা স্থাপত্যের কী এমন মহৎ জিনিস রক্ষার জন্য ‘নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ ও লজ্জাজনক’ মূর্তিটি উচ্চ আদালতের এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করলেন? এর পেছনে কোনো শৈল্পিক বিবেচনা নাই। তাহলে কোন বৈচারিক বিবেচনায় আপনি এই কাজ করলেন?
প্রধান বিচারপতি দেবী থেমিসের মূর্তি সরানোর পর নির্বাহী ও বিচার বিভাগের চলমান দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সোস্যাল নেটওয়ার্কে প্রধান বিচারপতির সমর্থনে একটি মন্তব্য করেছিলাম। তখন যতটুকু তথ্য আমার হাতে ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমার মনে হয়েছিল যে যুক্তিতে দেবী মূর্তিটি সরানো হয়েছে তা বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য জরুরি। দ্বিতীয়ত প্রধান বিচারপতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেবী থেমিস সরিয়েছেন, সেটা প্রধান বিচারপতির জন্য চরম অবমাননাকর। তাই আমি লিখেছিলাম, দেবী থেমিস সম্পর্কে শেখ হাসিনা তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন ঠিকই, এমনকি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেছেন, কিন্তু মূর্তি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরানো হয়নি। প্রধান বিচারপতি স্বয়ং নিজ সিদ্ধান্তে এই মূর্তি সরিয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার আওয়ামী লীগ বারবার দাবি করছে থেমিস সরানো বা না সরানো একান্তই সুপ্রিম কোর্ট- অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব। এখানে রাজনীতির দিকটা হোল, সেকুলার কিম্বা ইসলামপন্থীদের খেপানো কিম্বা খুশি করার দায় তারা প্রধান বিচারপতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারে নাই। এটি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত।
অতএব যে যুক্তিতে প্রধান বিচারপতি দেবী থেমিস সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পত্রিকায় দেখেছি তার জন্য আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। অভিনন্দন জানিয়েছিলাম স্রেফ দেবী মূর্তি অপসারণের জন্য নয়। খবরে যা পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে প্রধান বিচারপতি যে যুক্তিতে দেবী থেমিস অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা বিচার বিভাগকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা এবং বিচার বিভাগের নৈতিক বৈধতা সুরক্ষার দরকারে। দৈনিক প্রথম আলোর খবরেই দেখেছি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশে নয়, প্রধান বিচারপতি নিজে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্যটি সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মওদুদ আহমদ জানিয়েছেন, ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ২৫ মে তারিখ বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে সভা করেন। সেখানে আইনজীবীরা তাঁকে এটি সরানোর জন্যই পরামর্শ দেন। কেন চান না তার পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কারণ এই ভাস্কর্য নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকুক বা প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করা হোক এটা আইনজীবীরা চান না’। খবর পড়ে মনে হয়েছিল উচ্চ আদালতের কোনো বিচারক বা আইনজীবী চাননা দেবী থেমিস নিয়ে সমাজের বিতর্ক বিচার বিভাগ কিম্বা প্রধান বিচারপতিকেও বিতর্কিত করুক। এটা কোনো আইনি মামলার বিষয় নয়। আইন ও বিচার ব্যবস্থার পরিমণ্ডলের বাইরে বিতর্কে জড়ালে বিচারব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি এবং মর্যাদা ক্ষুণœ হবার বিপদ ঘটে। বিচারক ও আইনজীবীরা যদি তা বুঝে থাকেন তাহলে সেটা সঠিক উপলব্ধি। সে কারণে প্রধান বিচারপতি ও বিচারকদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি আমি উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদেরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
কিন্তু এখন যখন আবার ‘নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ ও লজ্জাজনক’ মূর্তিটি উচ্চ আদালতের এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় স্থাপন করা হোল, তখন মনে হোল প্রধান বিচারপতি আদালতকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে আগ্রহী নন, বরং বিতর্কিত করে রাখতেই যেন অধিকতর উৎসাহী। নৈতিক ও আইনি বৈধতা টিকিয়ে রাখতে হলে বাজে, নিষ্ফল ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন বিশেষত আদালতের ভূমিকাকে ধোয়াশা করে সেই প্রকার তর্ক থেকে অবশ্যই বিচার বিভাগকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঊর্ধ্বে রাখা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব। কিন্তু তিনি বিতর্ক টিকিয়ে রাখলেন। বিতর্ক টিকিয়ে রাখার সঙ্গে আইনের শাসন মজবুত করা কিম্বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সঙ্গে কী সম্পর্ক? দেবী থেমিসের পক্ষে বিপক্ষে কে সঠিক কিম্বা কে বেঠিক সেটা নির্ণয় করা বিচার বিভাগের কাজ না। আদালত দেবী থেমিস সংক্রান্ত কোনো মামলার রায় দিতে বসেনি। একে কেন্দ্র করে সমাজে ব্যক্তি, শ্রেণী ও গোষ্ঠীর চিন্তা ও অবস্থানের যে ভেদ ও বিভাজন সেটা সমাজের ডাইনামিজম বা গতিশীলতার লক্ষণ। কিন্তু এতে জড়ানো বিচার বিভাগের কাজ না। এর বাইরে বিচার বিভাগকে নিয়ে আসাই সঠিক ছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি স্বেচ্ছায় নিজেকে আপদে জড়ালেন।
আদালত গণপূর্ত বিভাগ নয়। তাহলে আদালত প্রাঙ্গণ প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে নাকি নির্বাহী বিভাগের, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অতএব কার এখতিয়ার বা সিদ্ধান্তে দেবী থেমিসকে আবার আদালত এলাকায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হোল তা জানবার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এটা অনুমান করতে পারি যে প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া পুনর্স্থাপন সম্ভব হতো না।
তিন
দেখা যাচ্ছে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে থেমিস মূর্তি সরানোর ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলাম শেষাবধি জয়ী হতে পারে নি। এই পরিস্থিতিতে তারা আগামি দিনে কী করবে সেটা তাদের বিষয়। ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, ‘গ্রিক দেবীকে পুনঃস্থাপন করায় আমরা বিস্মিত হতবাক, বাকরুদ্ধ’।
প্রশ্ন হচ্ছে এরপরও আমি একে হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় বলছি কেন? এর কারণ হচ্ছে শুরু থেকেই হেফাজতে ইসলাম দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণ এবং বাংলাদেশের কোথাও থাকুক চায় নি তার যে যুক্তি দিয়েছি তা ছিল পরিণত, সংযত এবং নতুন। ইমান আকিদার জায়গা থেকে ইসলাম সুরক্ষার লড়াই সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান বাংলাদেশের তরুণদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। এটা এখনি হয়তো বোঝা যাবে না, কারণ হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি ও বক্তব্য কেউই ভালো করে পড়েনি। শতকরা নিরানব্বই ভাগ ব্যক্তি যারা উঠতে বসতে হেফাজতে ইসলামকে গালিগালাজ করে বেড়ায় তারা হেফাজতে ইসলামের কোনো বিবৃতি বা ভাষ্য এক বাক্য পড়েও দেখে না। প্রসঙ্গ ছাড়া একটা কি দুইটা বাক্য নিয়েই হৈ চৈ শুরু করে দেয়। প্রধান প্রধান গণমাধ্যম তাদের বক্তব্য বিবৃতি পারতপক্ষে প্রচার করে না। শুধু নিন্দা করবার কিছু থাকলে করে। গণমাধ্যম মনে করে অন্ধ হয়ে থাকলে প্রলয় বন্ধ থাকবে।
হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শিক বিজয় এ কারণে যা হেফাজতের অবস্থান মোকাবিলার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতা করবার হিম্মত দূরে থাকুক, সেটা বোঝার ক্ষমতাও বিরোধী শিবিরে কারো মধ্যে দেখা যায়নি। না লেখালিখিতে না টকশোর ভাঁড়ামিতে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটা ইন্টারেস্টিং নতুন উপাদান। দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম চিন্তাচেতনার দিক থেকে সেকুলার ও তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’দের চেয়ে অনেক অনেক অগ্রসর। মতাদর্শিক তর্কে তথাকথিত ‘সেকুলার’ ও ‘প্রগতিশীল’রা হেফাজতে ইসলামের আসল আপত্তি না বুঝেই খামাখা ঘেউ ঘেউ করে বেড়াচ্ছে। উচ্চ আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং বিচারব্যবস্থার বিপর্যয়ের জন্য জবাবদিহি দাবি করার কর্তব্য বাদ দিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে দেবী থেমিস মূর্তি থাকবে কি থাকবে না তা নিয়েই তারা তর্ক করছে। এটা যেন স্রেফ ইসলাম বনাম মূর্তি, কিম্বা মূর্তি নামক ভাস্কর্য ইত্যাকার প্রাচিন ও ফালতু তর্ক। এখান থেকে তাদের চেতনার মাত্রা সম্পর্কে আমরা অনায়াসেই ধারণা করতে পারি। আধুনিক রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আর কতটুকুই বা থাকবে?
হেফাজতে ইসলামের আপত্তিটা আসলে কোথায়? সেই আপত্তির কোন্ কোন্ বক্তব্য একালে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, আর কোন্ কোন্ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য? নিদেনপক্ষে বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন্ কোন্ ইস্যু নিয়ে সব পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা সম্ভব- সেই সবের পর্যালোচনার অভাব মারাত্মক। খেয়ে-না-খেয়ে হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা সেকুলার-প্রগতিবাজদের হনুমানগিরি মাত্র- অর্থাৎ কিছু না বুঝে এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফানো। একটি শ্রেণির ইসলামবিদ্বেষ এত প্রবল যে ইসলামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বললেও সেটা আমরা শুনতে চাই না : ইসলাম মানেই খারাপ জিনিস, আর আলেম ওলেমারা ‘পশ্চাৎপদ’। এর পরও হাসতে হয় কারণ টেলিভিশনে দেখি হেফাজতের একজন প্রতিনিধিকে ঘায়েল করবার জন্য চার-পাঁচজন শেয়ালের মতো মুখিয়ে থাকে।
ইসলাম মূর্তি পূজা করে না, কিম্বা ইসলাম মূর্তি বা ভাস্কর্যের বিরোধী- সেই সব ক্লিশে- অর্থাৎ জীবনানন্দের ভাষায় অতি ‘ব্যবহারে ব্যবহারে ব্যবহারে শুয়রের মাংস’ হয়ে যাওয়া- এই প্রকার আপত্তি হেফাজতের আপত্তি না। ইনিয়ে বিনিয়ে এই আপত্তিটাই সেকুলাররা ব্যবহার করে। ব্যবহার করতে করতে সেকুলাররা এই ক্লিশে প্রচারকে এমনই চটকিয়েছে যে বলা যায় সেই যুক্তি দেয়া এখন কার্যত ‘হারাম’ হয়ে গিয়েছে। ফালতু তর্ক। থার্ড ক্লাস। অবশ্য হেফাজতে ইসলামের অফিসিয়াল বক্তব্যের বাইরে অনেক আলেম ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন যার দোষ হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে এসে পড়ে এবং পড়ছে। সেই দায় হেফাজতে ইসলামকেই নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে দুই-তিনটা কেন্দ্র থেকে বিবৃতি দেওয়া হয় যা হাটহাজারীর বিবৃতির সঙ্গে অনেক সময় সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। এইগুলো হেফাজতে ইসলামের বিপজ্জনক সাংগঠনিক দুর্বলতা।
তবে যারা আসলেই সেকুলারিজম কিম্বা বাংলাদেশে চিন্তার বিকাশ ঘটুক সেই অর্থে প্রগতিশীলতা বোঝেন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাদের ইতিবাচক মতাদর্শিক তর্কে যুক্ত হবার বিস্তর ক্ষেত্র ছিল এখনো আছে। পুরানা ক্লিশে কোলাহল দেখে মনে হয় সেই প্রকার জীব বাংলাদেশে লুপ্তপ্রায় বটে। যাই হোক, ইতিবাচক তর্কের জায়গাগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি থেকে কয়েকটি প্রসঙ্গ পেশ করে লেখাটি শেষ করব।
১. দেবী থেমিস ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গণমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী... ‘আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইউরোপের ইতিহাসকে বাংলাদেশে আত্তীকরণ করানোর অপচেষ্টা’।
কেন হেফাজতে ইসলাম তা মনে করে তার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে, ‘ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারণা একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্যও। সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোনো প্রতীকায়ন যদি গ্রিক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোনো ধারণা ছিল না। আমাদের ভাবাদর্শ যেন এতই গরিব, যে কারণে নিজেদের ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শে পুষ্ট করতে হবে। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক কোনো নাগরিকের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না’। অর্থাৎ হেফাজতে ইসলাম ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা- বিশেষত নিজেদের ইতিহাস, চিন্তাচেতনার প্রতি হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছে।
হেফাজতে ইসলাম চাইছে সেকুলার বা প্রগতিশীলরা এই প্রশ্নটা ঔপনিবেশিক ভাবাদশের্র বিরুদ্ধে তাদের মতাদর্শিক লড়াই হিসেবে তুলবেন। সেখানে বিরোধ যেমন থাকবে, মিলও থাকবে। আমার ধারণা মিল থাকারই বিশেষ সম্ভাবনা। ইসলামপন্থীদের কাজ হচ্ছে তাদের ‘ইমান ও আকিদার জমিনে দাঁড়িয়ে এই ধার করা ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে’ কথা বলা। সামাজিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য নির্মাণের সুযোগ হয়তো তৈরি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায় তাহলে ইসলামের ইনসাফের ধারণার সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণায় গৃহীত ইনসাফ বা ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এর ধারণার আদৌ কোনো বিরোধ কিম্বা অসঙ্গতি আছে কি না? সেকুলার প্রগতিবাজরা এই ধরনের সামাজিক তর্কে চরমভাবে অক্ষম। এখানেই বাংলাদেশের বিপদ নিহিত।
হেফাজতে ইসলাম আরো বলছে ‘গ্রিক পুরাণ মতে, থেমিস সোস্যাল অর্ডার বা সামাজিক শৃঙ্খলাও রক্ষা করে। সে শুধু ন্যায়বিচারই করে না, সে শক্তি প্রয়োগে সামাজিক শৃঙ্খলাও রক্ষা করে। থেমিসের হাতের তরবারি সেই শক্তি প্রয়োগের প্রতীক। আধুনিক রাষ্ট্র সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগকে দেয় না, বরং তা রাখে নির্বাহী বিভাগের হাতে। তাই, ঠিক কোন যুক্তিতে নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল দাবি করা বাম সেকুলারেরা থেমিসের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সেটা আমাদের কাছে ছিল এক বিস্ময়ের বিষয়’ ... ‘এমনকি আধুনিক রাষ্ট্র ধারণায় বিচার বিভাগের যে অবস্থান, দেবী থেমিস তারও পরিপন্থী। কারণ থেমিস গ্রিক সংস্কৃতির ডিভাইন ল’ বা তাদের ঈশ্বরের ঐশ্বরিক আইনের প্রতীক। যে রাষ্ট্র নিজেকে আলাদাভাবে সেকুলার বলে পরিচয় দিয়ে নিজের কৌলিন্য জারি করে, সে কিভাবে গ্রিক ঐশ্বরিক আইনের প্রতীককে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারে?’- এবার ঠ্যালা সামলান।
তাই বলি, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রিয় কমরেড, প্রগতিশীল ভাই ও ভগিনী এবং বন্ধু কি শত্রু সেকুলারগণ, আপনারা হেফাজতে ইসলামের উপলব্ধি, চিন্তার ক্ষমতা ও ইতিহাস চেতনার তুলনায় কয়েক শ বছর পিছিয়ে আছেন!!
দৌড়ান!!! নইলে এই উপলব্ধির জায়গায় আসতে আপনাদের আরো কয়েক শ বছর লেগে যাবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন